Friday, December 19, 2014

সদ্‌গুরু:------


আমাদের  মাথার  চুলের  অস্তিত্ব  সম্বন্ধে  আমরা  যেমন  সবসময় সজাগ  থাকি  না, কিন্তু  কেউ  যদি  সন্তর্পণে  চুপি  চুপি  এসে  পিছন দিক  থেকে  একটা  চুল  টেনে  ধরে  তাহলে  যেমন  আমরা সঙ্গে সঙ্গে জেগে উঠি, তেমনি  সদ্‌গুরুর  সঙ্গে  শিষ্যের  সেইরকম নিকটতম সম্বন্ধ। শিষ্য  মাত্রই  সদ্‌গুরুর  যেন  মাথার  চুল!  হাজার হাজার মাইল  দূরেও যদি  শিষ্যের  কিছু  বিপদ  ঘটে, যথার্থ  সদ্‌গুরু হলে তিনি  সহজেই  সঙ্গে  সঙ্গে  তা  জানতে  পারবেন ।


শিষ্যের দেহ সদ্‌গুরুর সাধন মন্দির, তিনি শিষ্যের জন্য ক্রিয়া করেন, এটি গভীর উপলব্ধির কথা। দীক্ষালাভান্তে শিষ্যের কোন সংশয় থাকতে পারে না। সদ্‌গুরুকে শিষ্য চিন্তে পারে। দীক্ষালাভের পূর্বে সদ্‌গুরু চিনবার উপায় ---

1. সাপুড়ের সন্নিধানে, তার ঝুলিতে যে সমস্ত বিষঘ্ন লতাপাতা মূল থাকে, তার গন্ধ প্রভাবে বিষধর সর্প যেমন বশীভুত ও শান্ত হয়, তেমনি সদ্‌গুরুর সন্নিধানে উপবিষ্ট হলে মন যতই চঞ্চল, বিষন্ন চিন্তাগ্রস্ত, বিরক্ত, বিক্ষিপ্ত থাকুক না কেন সদ্‌গুরুর দেহ-নিংসৃত অদৃশ্য দিব্য জ্যোতিঃকণা এবং সুগন্ধে মন শান্ত ও স্থির হতে বাধ্য। সদ্‌গুরু শান্তিদাতা। 

2. জলের যেমন নিজস্ব কোন আকার নেই,  যে পাত্রে থাকে তার আকার ধারণ করে, তদ্রূপ সদগুরুর চিত্তবৃত্তি এবং মনোনাশ ঘটে বলে তার নিজস্ব কোন ভাবের লহর খেলে না। যে যেমন ভাবে উপস্থিত হবে লোকটির কর্ম অনুযায়ী তাঁর মধ্যে তদনুরূপ ভাব ও ভাষার প্রকাশ ঘটবে। ফলে সদগুরুরূপী আধারটির মধ্যে আকার, প্রকার, আচরণ, বৈখরীতে ক্ষণে ক্ষণে পটপরিবর্তন ঘটতে পারে। কখনও রুদ্ররূপ কখনও শান্ত প্রসন্ন মূর্তি। অত্যন্ত স্থূল ও দুনিয়াদারীর আলোচনাতেও তিনি যেমন পটু তেমনি শাস্ত্রের দুরাবগাহ তত্ত্বে তাঁর স্বচ্ছন্দে বিচরণ করবার ক্ষমতা ক্ষণে ক্ষণে পরিলক্ষিত হবে। ধৈর্য ধরে কিছুদিন নিরীক্ষণ করলেই এই লক্ষণটি ধরা যায়।


3. একই সময়ে বিভিন্ন লোক সদ্‌গুরুর স্থূলদেহের ফটো তুললে বিভিন্ন লোকের পৃথক পৃথক ভাবানুসারে পৃথক পৃথক ফটো উঠবে। যিনি সদ্‌গুরু, তিনি অহরহ দিব্য ভাবলোকে বিচরণ করেন। স্তর ও মণ্ডল ভেদে বিচ্ছুরিত জ্যোতিছটায় তাঁর দেহে ক্ষণে ক্ষণে পরিণাম ঘটে। স্থূল চোখে ধরা না পড়লেও শক্তিশালী ক্যামারেতে তার ছায়াপাত ঘটে।বস্তুতঃ সদ্‌গুরুর একটি ফটো অন্যটি হতে সর্বদাই পৃথক এবং বৈশিষ্ট্যব্যঞ্জক।


4. যং লব্ধা পুমান্‌ সিদ্ধো ভবতি, অমৃতী ভবতি, তৃপ্তো ভবতি, যৎ প্রাপ্য ন কিঞ্চিৎ বাঞ্ছতি, ন শোচতি, ন দ্বেষ্টি, ন রমতে, নোৎসাহী ভবতি তদেব ব্রহ্মঃ। ব্রহ্মকে জানলে সমুদয় তত্ত্বই বিঞ্জাত হয়। সদ্‌গুরুর ব্রহ্মসিদ্ধির ফলে ঞ্জানসিদ্ধি হয়। তাই যিনি সদ্‌গুরু তিনি স্থূল, সূক্ষ্ম, কারণ কারণাতীত জগতের তাবৎ প্রশ্নের উত্তরদানে সমর্থ। 


5. সদ্‌গুরুর সম্মুখে বিভিন্ন লোক একই প্রশ্ন ভিন্ন ভিন্ন সময়ে উত্থাপন করলে প্রত্যেকের মস্তিষ্ককোষের পৃথক পৃথক স্পন্দনানুসুরে তিনি একই প্রশ্নের ভিন্ন ভিন্ন উত্তরদানে সমর্থ। প্রত্যেকটি উত্তরই শাস্ত্রসম্মত, যুক্তি-সিদ্ধ এবং অনুভব সিদ্ধ হবে। 


6. এমন কি যদি কোন বিঞ্জানী বা বিঞ্জানের গবেষক ছাত্র কোন জটিলতম সূত্রের উদ্ভাবনের জন্য সদ্‌গুরুকে প্রশ্ন করেন তিনি ইচ্ছা করলে সেই জিঞ্জাসুর প্রঞ্জাক্ষেত্রে এমন এক চেতনার উন্মেষ বা এমন এক চিৎ স্পন্দনের উদ্ভব ঘটান যে সেই ব্যক্তির তদ্বিষয়ক ঞ্জান স্বতঃই উপজিত হয়। যা তার অঞ্জাত ছিল, তা আর অঞ্জাত থাকে না।বুদ্ধি ক্ষেত্রে তত্ত্বটির আকস্মিক স্ফুরণ ঘটে। এই অভাবনীয় ঘটনার কারণ- সদ্‌গুরু সমাধিবান, তিনিই প্রকৃত সমাধানমূলক জীবন্ত বিগ্রহ। 


7. সদ্‌গুরুর নিকট বহু লোক বহু প্রশ্ন নিয়ে আসলে তিনি যে কোন একজনের প্রশ্নকে কেন্দ্র করে সকলের জিঞ্জাসার সমাধান করে দেন। পৃথকভাবে আর কাউকেও কোন প্রশ্ন করতে হয় না। 


8. ঞ্জাতসারে বা অঞ্জাতসারে সদ্‌গুরুর দর্শন ঘটলে সঞ্জানে মৃত্যু হয়।সদ্‌গুরুকে সামান্য মানুষ ভেবে কেউ যদি তাঁকে গালি দেয়, তারও সঞ্জানে মৃত্যু হয়। এটি দিব্যৌঘ বস্তুতত্ত্বের সংক্রমণ-জনিত অবশ্যম্ভাবী শুভফল। 


9. সদ্‌গুরু চিনবার বিশিষ্ট লক্ষণ হল--- *সদ্‌গুরু কোন বিভূতি দেখান না। তাঁর বিভূতি বা যোগৈশ্বর্য তাঁর অনুগৃহীত ভক্তের মধ্যে দিয়ে প্রকট হয়। ঐ ভক্ত অবশ্যই আক্ষরিক অর্থে দীক্ষাপ্রাপ্ত হওয়া চাই।


এর বিশদ অর্থ হল দীর্ঘকাল যোগাভ্যাসের ফলে যে সকল যোগৈশ্বর্য যোগীর আয়ত্তে আসে, সদ্‌গুরু-আশ্রিত শিষ্যের তা বিনা সাধনে আয়ত্তে আসে। শিষ্যের ভাব, ভাবনা, ইচ্ছা এবং বাক্যদানকে সত্য করবার জন্য সদ্‌গুরুর কটাক্ষে অলৌকিক বিভূতিগুলির প্রকাশ ঘটে।

10. জীবনের যে কোন সঙ্কটময় মুহূর্তে যদি কেউ তাঁকে স্মরণ করে, কিংবা অনিবার্য বিপৎপাতের সম্ভাবনা দেখে সে যদি সদ্‌গুরুরূপে অনুমিত ব্যক্তিটির দোহাই দেয় তাহলে সে বিপদ নিশ্চয়ই প্রতিহত হবে। কেননা-ভক্তবাৎসল্য এবং রক্ষাকর্ত্তৃত্ব সদ্‌গুরু সত্ত্বার পরিচায়ক। 


*** যোগীসমাজে দশটি সূত্র সংক্ষেপে ‘দশমীয়াঁ’ নামে প্রসিদ্ধ। 
লক্ষণগুলির একটি বা দুটি মিললে চলবে না। সদ্‌গুরুর মধ্যে দশমীয়াঁর সমুদয় লক্ষণগুলিই বর্তমান থাকবে। 


https://www.facebook.com/pages/tapobhuminarmada/454528151310191



Friday, December 12, 2014


"ন গুরোরধিকং তত্ত্বং ন গুরোরধিকং তপঃ" অর্থাৎ গুরুর চেয়ে বড় তত্ত্ব আর নেই  গুরু সেবার মত আর কোন শ্রেষ্ঠ তপস্যা নেই। গুরুভক্তি বিনা সবই নিরর্থক। গুরুঃ ব্রহ্মা, গুরুঃ বিষ্ণু, গুরুদেবঃ মহেশ্বরঃ।


প্রকৃত আধ্যাত্মিক জীবন  লাভ করতে  হলে  বিষয়  বাসনা সর্বতোভাবে  ত্যাগ করে অণুক্ষণ গুরুদত্ত সাধনক্রিয়ার আশ্রয় নিয়ে পড়ে থাকতে হয়। এইভাবে একবার স্বভাবের যোগ পথে পড়তে পারলে আর কোন চিন্তা থাকে না। কোন  দ্রব্যকে  স্রোতে ভাসিয়ে  দিলে তা যেমন আপনা হতেই স্রোতের বেগে ভেসে যায়, তেমনি  গুরুশক্তিই সাধককে পরম বাঞ্ছিত স্থানে পৌঁছিয়ে দেয়। চাই শুধু  গুরুর উপর একান্ত নির্ভরতা এবং পূর্ণ আত্মসমর্পণ।"

Tuesday, December 2, 2014


মা  নর্মদার  কৃপাসিদ্ধ  এক  হরিভক্ত  মহাত্মার  অনুভূতিঃ----


সুরত  যমুনা  বহি  ঞ্জান  মথুরা  বসা। গ্রাম  গোকুল  বিশোয়াস আয়া। শান্তি যশোদা দেত্তকী, সত্‌গুরু নন্দ বসুদেও যদু প্রীতি লায়া। জিও ও বরম্‌  শ্রীকৃষ্ণ  বলদেও জি কংস অহংকার  কো  মার লায়া। বিবেক  বৃন্দাবন  সন্তোষ  কা  কদম্‌  হৈ। গোয়াল  দ্বীং  বিচ দয়া। সন্দেশা শ্রীরাধিকা  শোলকী  গোপ্তা  তত্ত্ব  লৈছিন  খায়া।


মনোরূপী  যমুনা  নদী  প্রবাহিত  হয়ে  চলেছে। ঞ্জানরূপী  মথুরাপুরী বসে  গেছে  বা  ধ্বসে  গেছে। বিশ্বাস-রূপী  গোকুল  গ্রাম  উৎপন্ন হয়েছে। শান্তি  জেগেছে  মনে;  ঐ  শান্তি  হলেন  যশোদা  ও  দেবকী স্বরূপিনী। সদ্‌গুরু  হলেন  নন্দ  ও  বসুদেব  স্বরূপ,  প্রীতি  যদুকূল স্বরূপ।  জীবও  ব্রহ্মরূপ  কৃষ্ণ  ও  বলদেব   অহংকার  রূপ  কংসকে ধ্বংস  করেছে। বিবেক  বৃন্দাবন  স্বরূপ। সন্তোষ  কদম্ব  বৃক্ষস্বরূপ হয়েছে। শরীরের  অভ্যন্তরস্থিত  দয়া  হল  গোপ  ও  গোপাল  স্বরূপ। সন্দেহ  রূপ  অর্থাৎ  জিঞ্জাসা  শ্রীরাধিকা  তত্ত্ব  রূপ (ননী) জোর  করে কেড়ে  নিয়ে  ভক্ষণ  করেছেন।

Wednesday, November 12, 2014

'ন মৃতা তেন নর্মদা' ------


প্রলয়কালে পৃথিবীর সমস্ত নদী এবং সমুদ্র প্রলয়পয়োধি জলে সর্ববিধ্বংশী মহাসমুদ্রে লয় হয়ে যায়। তাদের স্ব স্ব সত্তার বিলুপ্তি ঘটে। সপ্তকল্পান্তজীবী মহামুনি মার্কণ্ডেয় দেখেছিলেন কল্পান্তের মহাপ্রলয়েও নর্মদার সমগ্র সত্তার বিলুপ্তি ঘটে নি। সমস্ত কল্পেই তিনি স্বমহিমায় নিজের রূপ, রঙ ও আকার নিয়ে বিরাজিত থাকেন। 'ন মৃতা তেন নর্মদা' কোন অবস্থায় তিনি ক্ষীণ হন না, তাঁর মৃত্যু ঘটে না। তাই তাঁর নাম নর্মদা।

মহাকুমারী শক্তির প্রতীক, সৃষ্টি ও সভ্যতার বিধাত্রী এবং পালয়িত্রী দেবী  নর্মদার উৎপত্তিস্থল হল মধ্যপ্রদেশের অমরকণ্টক। অমরকণ্টক থেকে নর্মদা পশ্চিমগামিনী হয়ে আরবসাগরে গুজরাট রাজ্যের অন্তর্গত ভারোচ বা ব্রোচে গিয়ে মিলিত হয়েছে, এই স্থানের নাম ভৃগুকচ্ছ। ভৃগুক্ষেত্র, অপভ্রংশে ভড়োচ > ভারোচ > ব্রোচ। ভারোচ ভৃগুদেবের মূল স্থান হলেও হরিধাম থেকে ভারোচ পর্যন্ত সমস্ত স্থানটাই মহর্ষির তপস্যাক্ষেত্র।

সমুদ্র ও রেবার জলমূর্তি আসলে মহাদেবের অষ্টমূর্তির এক মহান মূর্তি --- অপমূর্তি বা ভবমূর্তি। হরিধামই সমুদ্র-রেবার সংগমস্থল। একদিকে মায়ের স্বচ্ছ, স্নিগ্ধ জলপ্রবাহ  অন্যদিকে সমুদ্রের নীলাভ জলপ্রবাহ এই দুই এর সংগমে হরিধাম। খাঁড়ির মধ্যে দিয়ে নর্মদা প্রবেশ করেছেন সমুদ্রে, পশ্চিম সমুদ্রের খাঁড়িকে খাম্বাটের খাঁড়ি বলা হয়।


https://www.facebook.com/pages/tapobhuminarmada/454528151310191

Tuesday, November 4, 2014


"তোমার মাঝে রয়েছি আমি,
জেনেও আমি জানি না।
আমার মাঝে রয়েছ তুমি 
জেনেও আমি জানি না!
আমার গুরু তোমার অঙ্গে
রয়েছে মিশে একই সঙ্গে ---
তোমার রূপ যে বিশ্বভুবন,
চিনেও আমি চিনি না!
মনের ওপারে রয়েছ তুমি
রয়েছি আমি এপারে,
ভাবের খেয়ায় পাল তুলে
দেখতে যাই যে তোমারে!
আমার মনের এপার ওপার
তুফান এলে হয় একাকার --- 
তখন কোথায় তুমি, কোথায় আমি
কিছুই খুঁজে পাই না,
আমার মাঝে রয়েছ তুমি
জেনেও আমি জানি না!!



Wednesday, October 29, 2014


"স্রষ্টা আছেন শুনি ---

তাঁরে চোখে দেখি নি,
মাতাপিতা নিত্য প্রকট
তাঁদেরেই নমি।।"

মাতাপিতার স্বরূপ দর্শনের মহাসিদ্ধবীজ --- "ওঁ  ঐঁ  হ্রীঁ" --- এই মহাবীজের মধ্যে শিবশক্তির সামরস্য ঘটেছে। এই মহাবীজ পরম দুর্লভ বস্তু। কামদমণির কাছে যদৃচ্ছা প্রার্থনা করলে সর্বাভীষ্ট সিদ্ধ হয়। কামদমণি ঞ্জানে এই বীজের ভজনা করা উচিত।।

Wednesday, October 15, 2014

অমরকণ্টকের মহিমা ---


অমরকণ্টক, মধ্যপ্রদেশের শাডোল জেলার পুষ্পরাজগড় তহশিলের দক্ষিণ পূর্বে মেকল পর্বতমালার মধ্যে অবস্থিত। এটি সমুদ্রতল থেকে ৩৫০০ ফুট উঁচু। অমরণ্টকের উত্তরে শাডোল, দক্ষিণ-পশ্চিমে মান্দালা, দক্ষিণ-পূর্বে বিলাসপুর এই তিন জেলার মাঝামাঝি স্থানে অমরকণ্টক। উত্তরে অনুপপুর, পূর্বে পেনড্রা ও পশ্চিমে ডিনডোরী থেকে সোজা পৌঁছানো যায় অমরকণ্টকে।


অমরকণ্টক  মোক্ষদাত্রী, সর্বসিদ্ধিপ্রদায়িনী মহাকুমারী শক্তির প্রতীক মা নর্মদার উৎপত্তিস্থল। অমরকণ্টকের অপর নাম মেকল বা ঋষ্য। রুদ্রতেজাৎসমুদ্ভূতা শিবকন্যা মা নর্মদার উত্তরে বিন্ধ্য পর্বত ও দক্ষিণে সাতপুরা পর্বতমালা। এই দুই পর্বতমালার মধ্যে দিয়ে নর্মদা পশ্চিগামিনী হয়ে আরবসাগরে গুজরাট রাজ্যের অন্তর্গত ভারোচ বা ব্রোচে গিয়ে মিলিত হয়েছে। এই স্থানের নাম ভৃগুকচ্ছ। 


অমরকণ্টকের চারিদিকে ঘনঘোর অরণ্যানি, সেই ভয়ঙ্কর অরণ্যানির তমসা ততধিক ভয়ঙ্কর। ভয়ঙ্কর শ্বাপদ গোষ্ঠীর উপদ্রব সহ্য করে, কণ্টকাকীর্ণ বনভূমি ও পাকদণ্ডী বেয়ে তীর্থযাত্রীদের যেতে হত এই মহাতীর্থে। কোল, ভীল, মুণ্ডা প্রভৃতি উপজাতির বাস এখানে। অমরকণ্টকের এই ঘনঘোর অরণ্যানি শাল, সেগুন, শালাই, বিজা, মহুয়া, লাখ, তেন্দুপাতা, গোঁত এবং অনেক বনৌ ঔষধিতে ভরপুর।


এছাড়া এখানেই আছে শোণ নদীর উৎপত্তিস্থল। আদিকাল থেকে নর্মদা ও শোণ দুই নদীর উদগমস্থল ছিল ঋষিমুণিদের তপস্যাভূমি।


এই নর্মদাক্ষেত্র মহাসিদ্ধপীঠ, শ্রেষ্ঠ তপস্যাস্থল। "নর্মদায়াং তপঃ কুর্যাৎ মরণং জাহ্নবীতটে" --- গঙ্গাতীরে মৃত্যু হলে জীবের উচ্চগতি হয় কিন্তু তপস্যায় সিদ্ধিলাভ করতে হলে আসতে হয় নর্মদাতটে। মহাচৈতন্যময়ী চৈতন্যকারিণী নর্মদা মায়ীর কৃপা কটাক্ষ ছাড়া ঞ্জানসিদ্ধি বা কৈবল্যসিদ্ধি কখনই সম্ভব নয়।

মহর্ষি ভৃগু, মার্কণ্ডেয় থেকে আরম্ভ করে মহর্ষি পতঞ্জলি, গুরু গোবিন্দপাদ, শঙ্করাচার্য, গোরক্ষনাথজী সবাই ছুটে গিয়েছিলেন নর্মদায় তপস্যা করতে। ভারতের শ্রেষ্ঠ মহাত্মা মাত্রেই নর্মদার কৃপাসিদ্ধ, আশীর্বাদধন্য।

জগৎ সংসারে নর্মদা এমনই একমাত্র নদী যার পরিক্রমা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে কারণ পরম পরিতৃপ্ত বিধায়িনী, পরম সুখ ও আনন্দদায়িনী, মহাকুমারী শক্তির প্রতীক হলেন, মা নর্মদা।


তাই বৈদিক ঋষিরা ঘোষণা করেছেন ---



নর্মদা সরিতাং শ্রেষ্ঠা রুদ্রতেজাৎ বিনিঃসৃতা।
তারয়েৎ সর্বভূতানি স্থাবরানি চরানি চ।।

নর্মদা সমস্ত নদীকুলের মধ্যে শ্রেষ্ঠ; রুদ্রের তেজ হতে সমুৎপন্না, স্থাবর জঙ্গম সমস্ত কিছুই তিনি ত্রাণ করেন।

"সর্বসিদ্ধিমেবাপ্নোতি তস্যা তটপরিক্রমাৎ" --- শুদ্ধচিত্তে তাঁর তট পরিক্রমা করলে সর্বসিদ্ধি করায়ত্ত হয়।


****** নর্মদা --- মধুনিস্যন্দিনী সংস্কৃত ভাষায় ঋষিদের অত্যন্ত তাৎপর্যময় এই শব্দটি মূর্তিমতী "গায়েত্রী" র মতই ত্র্যক্ষরা। নর্মন্‌ ধাতু হতে শব্দটি নিষ্পন্ন, নর্মন্‌ দদাতি ইতি নর্মদা। নর্মন হচ্ছে নৃ ধাতুর উত্তর মন্‌ ও কর্তৃবাচ্য। নর্ম মানে হচ্ছে ক্রিয়া, নর্ম মানে হচ্ছে খেলা, প্রিয়ত্ব বা বিহার। নর্ম --- দা + ড = নর্মদা। নর্মন্‌ দদাতি অর্থাৎ আনন্দ-বিলাস যিনি দান করেন। ব্রহ্মের যে আনন্দ-বিলাস, জগৎ জুড়ে যে আনন্দের লীলা চলছে। উপনিষৎ বলছে --- আনন্দ থেকে জাত, আনন্দের বুকেই সবাই আছে। অন্তে এই আনন্দেই সব লয় পাবে --আনন্দ ব্রহ্মের সেই অলৌকিক আনন্দ-বিলাস দেখবার, বুঝবার এবং অনুভব করার ক্ষমতা যিনি দান করেন --- তিনিই নর্মদা।


https://www.facebook.com/pages/tapobhuminarmada/454528151310191



Monday, October 13, 2014


"সন্ত সহহী দুখ পরহিত লাগী। 
পরদুখ হেতু অসন্ত অভাগী।
ভূ-রজ তরু সম সন্ত কৃপালা। 
পরহিত নিত সহ বিপতি বিসাসা।।"

সন্তপুরুষ পরহিতের জন্য দুঃখ সহ্য করেন আর অভাগা অসন্ত ব্যক্তি পরের দুঃখের হেতু। কৃপালু সন্ত পৃথিবীর ধূলা ও তরুর সমান; তিনি পরহিতের জন্য নিত্য মহা বিপত্তি সহ্য করেন।


"কমঠ পীঠি জামহিঁ বরুবারা।
বন্ধ্যাসুত বরু কাহুহি মারা।।
ফুলহিঁ নভ বরু বহু বিধি ফুলা।
জীবন লহ সুখ হরি প্রতিকূলা।।"

কচ্ছপের পিঠে চুল হওয়া, বন্ধ্যার পুত্র হওয়া আর আকাশে ফুল ফোটার মত অসম্ভব ব্যাপারও সম্ভব হতে পারে, কিন্তু হরি প্রতিকূল সুখ পাওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়।


Saturday, October 4, 2014


"তপোভূমি  নর্মদা" র  পক্ষ  থেকে  সমস্ত  পাঠককে  জানাই  শুভ  বিজয়ার  প্রীতি  ও  শুভেচ্ছা।

Wednesday, September 24, 2014

দিব্যগুরুর মন্ত্রমালা ---


ওঁ যদ্‌ ব্রহ্ম শুদ্ধং নিরহং নিরীহং স্বান্তর্বিলীনাত্মসমস্তশক্তি।

সচ্চিৎসুখং চৈকম্‌ অনন্তপারং তং তু আদিনাথং গুরুমানতা স্মঃ।।১

যিনি  শুদ্ধ, নিরহঙ্কার, আপ্তকাম এবং যাঁর অভ্যন্তরে সমস্ত শক্তি বিলীন হয়ে আছে, সেই অনন্ত অপার সচ্চিদানন্দ আদিনাথ নামক পরমাত্মা আমাদের প্রথম দিব্যগুরু। আমরা তাঁকে প্রণাম করি।


ওঁ যাস্তদ্বিলীনামিতশক্তয়ঃ স্যুস্তৎরূপিণী ব্রহ্মণ আদ্যভিন্না।

নিদ্রান্ত আদ্যেব নরস্য বৃত্তির্নতাঃ স্ম স্তাং শক্তিগুরুং দ্বিতীয়ম্‌।।২

পরব্রহ্ম হতে অভিন্না আদ্যাশক্তি --- যিনি বিলীন হয়ে আদিনাথ নামক পরব্রহ্মে  সুপ্তোত্থিত  পুরুষের  বৃত্তিবৎ  অবস্থান  করেন, তিনি আমাদের দ্বিতীয় দিব্যগুরু। আমরা তাঁকে প্রণাম করি।


ওঁ ত্বয়া বিশিষ্টস্তু স আদিনাথো নিরাকৃতির্নির্গুণ উচ্যতেহসৌ।

বৃত্ত্যন্যগোহনুগ্রবাং স্তৃতীয়ং সদাশিবং তং গুরুমানতাঃ স্মঃ।।৩

সেই শক্তিবিশিষ্ট আদিনাথ নির্গুণ ও নীরূপ হলেও নিবৃত্তিক যোগীর প্রঞ্জায় অনুগ্রহবশতঃ আরূঢ় হন বলে তাঁর নাম সদাশিব। সেই সদাশিব আমাদের তৃতীয় দিব্যগুরু। আমরা তাঁকে প্রণাম করি।


ওঁ তদুত্থিতা যা স্বত এব বৃত্তিঃ শ্রুত্যা স নৈকো রমতে ত্বিতীড্যা।

তাং শুদ্ধাবিদ্যাং চ সদাশিবীয়াং শক্তিং চতুর্থং গুরুমাতাঃ স্মঃ।।৪

সদাশিব দ্বিতীয় ব্যতীত একক প্রকাশিত হতে পারেন না বলে যে শক্তিরূপ বৃত্তির আশ্রয় গ্রহণ করেন, সেই শক্তিই আমাদের চতুর্থ দিব্যগুরু। আমরা তাঁকে প্রণাম করি।


ওঁ তদ্বানরূপঃ সগুণঃ স জাতস্তু অপাদপাণিঃ শ্রুতিবাক্‌প্রসিদ্ধঃ।

তিরোহিতং তিষ্ঠতি বিশ্বমস্মি্‌ন তমীশ্বরং পঞ্চমমানতাঃ স্মঃ।।৫

সেই শক্তিযুক্ত আকার বিরহিত কিন্তু ঞ্জানাদি বহুগুণবিশিষ্ট সদাশিব যখন অনুগ্রহ নিগ্রহ-সমর্থ ঈশ্বররূপ ধারণ করেন এবং তাঁর যে ঈশ্বররূপ শ্রুতি চরণহীন হলেও বেগগামী, নয়নহীন হলেও দৃষ্টিমান ও কর্ণহীন হলেও শ্রবণশীল বলে বর্ণনা করেছেন, সেই ঈশ্বর আমাদের পঞ্চম দিব্যগুরু। আমার তাঁকে প্রণাম করি।


ওঁ দ্বিতীয়ম্‌ ঐচ্ছৎ শ্রুতিবর্ণিতা যা তদ্ধৃত্তিরস্মান্‌ মহদাদিগর্ভম্‌।

ধত্তেহন্তরে তাং বয়মীশ্বরস্য শক্তিং তু ষষ্ঠং গুরুমানতাঃ স্মঃ।।৬

লীলার জন্য দ্বৈতভাব গ্রহণ করেছেন বলে শ্রুতি যাঁকে ইচ্ছাময় বলেন এবং তাঁর যে ইচ্ছাশক্তিরূপ বৃত্তি মহাদাদির নিধান বলে অভিহিত। তাঁর সেই বহুভবন শক্তি আমাদের ষষ্ঠ দিব্যগুরু। আমরা তাঁকে প্রণাম করি।


ওঁ তদ্যুগগুণাঢ্যাকৃতিমান্‌ স যা ত রুদ্রেতি বেদোক্তবচঃপ্রসিদ্ধঃ।

লয়ীকৃতং তিষ্ঠতি বিশ্বমস্মিংস্তং সপ্তমং রুদ্রগুরুং নতাঃ স্মঃ।।৭

মহাদাদিনিধানশক্তিযুক্ত যে ঈশ্বর গুণবহুল হয়ে আপনাতে সমস্ত বিশ্ববেগ ধারণ করে থাকেন এবং যজুর্বেদ রুদ্রাধ্যায়ে যাঁকে রুদ্র বলে বর্ণনা করা হয়েছে, তিনি আমাদের সপ্তম দিব্যগুরু। আমরা তাঁকে প্রণাম করি।


ওঁ অহং বহু স্যামিতি যা তদুত্থা বৃত্তির্জনিত্রী মহাদাদিকানাম্‌।

পৃথক পৃথক কৃত্য চ রুদ্রশক্তিং তমষ্টমং স্বীয়গুরুং নতাঃ স্মঃ।।৮

এক থেকে বহু হবার অভিপ্রায়ে ধৃতবেগ রুদ্র হতে বৃত্তিরূপা যে শক্তি অন্তর্নিহিত তত্ত্বসমূহকে পৃথক করার জন্য মহাদাদির জনিত্রী হন, তিনি আমাদের অষ্টম দিব্যগুরু। আমরা তাঁকে প্রণাম করি।


ওঁ ব্যাপ্নোতি তদ্যুক স  মহন্‌মুখেষু  তত্ত্বেষু  তেজস্তু অখিলম্‌ স্বকীয়ম্‌।

নিধায় তৎস্থং পরিপাতি বিশ্বং বিষ্ণুগুরুং তং নবমং নতাঃ নতাঃ স্ম।।৯

সংসৃষ্ট ও বিবিক্ত হওয়ায় বৃত্তি অবলম্বন করে মহাদাদি তত্ত্বে যাঁর স্বকীয় সমগ্র তেজ পালনের জন্য নিহিত থাকে, তিনি আমাদের নবম দিব্যগুরু --- বিষ্ণু। আমরা তাঁকে প্রণাম করি।


ওঁ পুষ্ণাম্যহং বিশ্বমিদং স্বকীয়ং মদীয়শক্ত্যেতি মদীয়বৃত্তিঃ।

পুষ্ণাতি তত্ত্বান্তরগং তু বিশ্বং তাং বিষ্ণুশক্তিং দশমং নতাঃ স্মঃ।।১০

আমি স্বতঃই বিশ্বপোষণকৃৎ --- এইরূপ বৃত্তিগত যে বৈষ্ণবী শক্তি তত্ত্বান্তরে পরিণত বিশ্বের পোষণ করেন, তিনি  আমাদের দশম দিব্যগুরু --- বিষ্ণুশক্তি। আমরা তাঁকে প্রণাম করি।


ওঁ তত্ত্বান্তরস্থং জগদিত্থমন্তঃ পশ্যন্‌ স্ববৃত্ত্যা স বিরাড্‌ বভূব।

সমষ্টিজীবোহখিলসৃড বিধাতা গুরুং তমেকাদশমানতাঃ স্মঃ।।১১

তত্ত্বান্তরে জগৎ পরিণত হবে বলে আপন বৃত্তি দ্বারা যিনি হিরণ্যগর্ভাখ্য বিরাট হয়েছিলেন এবং যাঁর সেই মূর্তি হতে অখিল চরাচর বিবিক্ত হয়েছে, তিনি আমাদের একাদশ দিব্যগুরু। তাঁকে আমরা প্রণাম করি।


ওঁ যঞ্জাদিকং চাত্মভবাঃ সুখাপ্ত্যৈ কুর্বন্ত জীবা ইতি যাস্যবৃত্তিঃ।

বেদত্রয়ী কর্মময়ী কিলাজশক্তিং গুরুং দ্বাদশমানতাঃ স্মঃ।।১২

আপন শরীরবস্তুভূত জীব চিরসুখের জন্য যঞ্জাদি সাধিত উপাসনা করবে, এইরকম তাঁর যে বৃত্তি বেদত্রয়ী কর্মময়ী সাবিত্রী নামে প্রসিদ্ধ, তিনি আমাদের দ্বাদশ দিব্যগুরু। তাঁকে আমরা প্রমাণ করি।



https://www.facebook.com/pages/tapobhuminarmada/454528151310191

Monday, September 1, 2014


Cont (Last) ............


তারপর মন্দিরে ঢুকে পাশাপাশি অবস্থিত ভূতনাথ নামে অভিহিত তিনটি শিবলিঙ্গকে আমি আমার মত করে পূজা করতে আরম্ভ করলাম। শিব তিনটিতে জল ঢেলে মার্জনা করছি, এমন সময় দেখলাম ১২ টি বার রকমের পাখী নানারকম শব্দ যথা --- কেউ কিচিরমিচির, কেউ টুংটুং, কেউ টিয়ার মত বুলি, কেউ ট্যাঁ-অ্যাঁ-অ্যাঁ করতে করতে মন্দিরের চারপাশে ঘুরপাক খেতে লাগল। আমি সেই পক্ষীকুলের কলতানের মধ্যে পূজা করতে লাগলাম ভূতনাথের। পূজা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, এমন সময় মুখ তুলে দেখি, 'ঠুক্‌ ঠুক্‌' লাঠির শব্দ করতে করতে মহাত্মা ফিরে এসেছেন। একটি শাল পাতায় মোড়া এক ডেলা ছানা ও তিনটি কলা ভূতনাথের সম্মুখে রেখে ভোগ নিবেদনের ইঙ্গিত করলেন। আর একটি শাল পাতায় মোড়া পৃথক এক ডেলা ছানা নিয়ে তা ভেঙ্গে ভেঙ্গে পাখীদের মধ্যে বিলোতে লাগলেন।


পাখীরা তাঁর হাতের উপর কাঁধের উপর বসে ঠুকরে ঠুকরে খুঁটে খুঁটে খেতে লাগল। আমার ভোগ নিবেদনও শেষ হল, পাখীরাও তাঁর হাতে ছানা খেয়ে উড়ে গেল বনে। একটা জিনিষ লক্ষ্য করলাম, তিনি ভোগ নিয়ে আসার পূর্বে মন্দিরের মধ্যে ঢুকেও কয়েকটা পাখী যত্রতত্র নেচে বেড়াচ্ছিল, কিন্তু তিনি এসে পৌঁছানো মাত্রই সকলে তাঁকেই ঘিরে ছিল। তাঁর হাতের ছানা শেষ হয়ে গেলেও শিবলিঙ্গের সামনে ছানা শাল পাতাতে থাকলেও কোন পাখী স্বাভাবিক প্রবৃত্তি বশে সেদিকে দৃকপাতও করল না।


পূজা ও প্রণাম করে দরজার বাইরে এসে তাঁর পায়ে ফুল চাপিয়ে সাষ্টাঙ্গে ভক্তি নিবেদন করলাম। তখন থেকে মনের মধ্যে একটা প্রশ্ন উঁকি মারছে, ভারোচে ইনি দেখা দিয়েছিলেন কিনা জিঞ্জাসা করি, কিন্তু খুবই অশোভন হবে বলে জিঞ্জাসা করতে সাহস করলাম না। ভাবলাম, একই গান উভয়ের মুখে শুনেছি বলে যে উভয়েই একই ব্যক্তি হবেন, এমন কোন কথা নেই। একই গানের ভাষা দুজন কেন দুশ জনেরও জানা থাকতে পারে!


---- লেও শৈলেন্দ্রনারায়ণজী! ভুতনাথজীকে কা পরসাদী পা লিজিয়ে।


আমার চিন্তাসূত্র ছিন্ন হল। তিনি কিছু গ্রহণ করবেন কিনা বলতে যাবো, এমন সময় তিনি নিজেই বলে উঠলেন --- লেওজী, ইধর বৈঠকে পা লিজিয়ে, করীব এক বাজ গিয়া হোঙ্গে। আপ তো জানতে হো, হম্‌ কুছ্‌ লেতে নেহি।


সশব্দে একটা উদ্‌গার তুলে বললেন --- কয় রোজ পহেলে ভারভূতি মেঁ ভারভূতেশ্বর জী মুঝে জবর দস্তিসে বহোৎ কেলা ঔর নড়াইল খিলায়ে থা। আভি শ' সাল ইসীমেঁ বীত জায়েঙ্গে।


আমার সংশয় মোচন হল, আমি ভূতনাথের প্রসাদ খেয়ে নিলাম।"




ভূতনাথের মন্দির ---

স্মরণাতীতকাল পূর্বে ঐ ভূতনাথের স্থানে একজন শৈব মহাযোগীর তপস্যায় তুষ্ট হয়ে মহাদেব স্বয়ম্ভূলিঙ্গ রূপে প্রকট হন। শিবলিঙ্গ আবির্ভাবের কালে আকাশ মণ্ডল ভেদ করে তাঁর কাছে একটি একাক্ষরী দিব্যমন্ত্র প্রকট হয়। আনন্দে অভিভূত হয়ে সেই মহাযোগী প্রচণ্ড উল্লাসে নৃত্য করতে করতে প্রাণপণে চিৎকার করে ঐ বীজ দুবার উচ্চারণ করেন এবং অপার বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করেন যে, পূর্বোক্ত শিবলিঙ্গের পাশে আরো দুটি স্বয়ম্ভু লিঙ্গ সঙ্গে সঙ্গে প্রকট হয়েছে। জাপ্য মূলবীজকে প্রকাশ্যে উচ্চারণ করায় সেখানে তৎক্ষণাৎ নন্দী, ভৃঙ্গী, বীরভদ্র, ঘণ্টাকর্ণ বহুতর রুদ্রপিশাচের আবির্ভাব ঘটে।


নিয়মবিরুদ্ধ কাজের জন্য চিরতরে তাঁর জিহ্বা স্তব্ধ হয়। তিনি অতঃপর যতকাল জীবিত ছিলেন ততদিন সংকেতে বা লিখে লিখে সমাগত ভক্তদের কাছে মনের ভাব প্রকাশ করতেন। তাঁর তপস্যার প্রভাবে ভূতনাথ মহাদেবের আবির্ভাব ঘটেছিল বলে, তাঁকে লোকে ভূতনাথ বাবা বলে ডাকতেন।


এই মহাযোগীর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল, তাঁর সামনে কেউ এসে পৌঁছালেই সেই ভক্তের মনে এবং জিহ্বায় আপনা হতেই মহাদেবের একাক্ষরী মহাবীজ স্ফুরিত হত।


কালক্রমে তাঁকে কেন্দ্র করেই একটি বিরাট আখড়া গড়ে ওঠে। আখড়ার নাম হয় ভূতনাথ আখড়া। রুখড়, সুখড় এবং অগন নামক আখড়া এই ভূতনাথ আখড়ারই অন্তর্গত। তাঁর সন্ন্যাসী শিষ্যরা কারিগরী কৌশলে ভূতনাথ মন্দিরের চারদিকে সারি সারি গাছ লাগিয়ে "লক্ষ্মৌ এর ভুলভুলাইয়া" নির্মাণ করেছিলেন। সেইসব গাছপালা ক্রমে জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। "লক্ষ্মৌ এর ভুল ভুলাইয়াতে" প্রবেশ করে সাধারণ যাত্রী যেমন বিভ্রান্ত হয়, সঠিক পথ সহজে খুঁজে পায় না, তেমনি ভূতনাথের জঙ্গলে প্রবেশ করে পথ খুঁজে পাওয়া দুঃসাধ্য।


রুদ্রপিশাচ বা ভূত প্রেতাদির গল্প সম্পূর্ণ কুসংস্কার প্রসূত। যেখানে ভূত আছে সেখানে ভূতনাথও আছেন।



https://www.facebook.com/pages/tapobhuminarmada/454528151310191


".......................  বেলা তখন ৮টা বেজেছে। চমৎকার মিষ্টি রোদে হাঁটতে ভালই লাগছে। দূরে দূরে জনবসতিপূর্ণ শস্যশ্যামল গ্রাম দেখতে দেখতে মনের আনন্দে  হেঁটে চলেছি; আনন্দের কারণ আজ হরিধামে পৌঁছে যাব। আজ না নৌকা পেলেও কাল নিশ্চয়ই নৌকা পেয়ে যাব। মহাত্মা পূষণ গিরিজীর ছাড়পত্র অর্থাৎ নৌকার চিঠি ত কাছেই আছে, ভাবনা কি। প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা হাঁটার পর সামনে জঙ্গল দেখে থমকে দাঁড়ালাম। বুকটা ধ্‌ক করে উঠল। ভূতনাথের জঙ্গল।


ভূতনাথের জঙ্গল যেখানে জনশ্রুতি রুদ্রপিশাচের বাস। রুদ্রপিশাচ থাকুন না থাকুন, সকলের মুখে শুনে আসছি এটি ভয়ঙ্কর স্থান! গতবার মোহান্তজীর সঙ্গে নিজেই ত দেখে গেছি, ভূতনাথের মন্দিরে পৌঁছতে কত ঘুরপাক খেতে হয়েছে। সোজা জঙ্গল অতিক্রম করে যাওয়ার উপায় নেই। নিরাপদে সমুদ্র পেরোতে হলে প্রত্যেক পরিক্রমাবাসীকে ভূতনাথের মন্দিরে প্রণাম ঠুকে যেতেই হবে। তা না হলে সমুদ্রে নৌকাডুবি হয়ে যায়। আমি ঝোলা গাঁঠরী পথের উপর রেখে বাবা এবং মা নর্মদার উদ্দেশ্যে প্রণাম জানালাম। জঙ্গলে ত কোন জন্তু জানোয়ারের ভয় নেই, ভয় কেবল বনের গোলক ধাঁধাকে। যা হবার হবে। হর নর্মদে বলতে বলতে ঢুকে পড়লাম বনের ভিতরে।


আমার খুব ভাল করেই মনে আছে, সেবারে একটা অশ্বত্থ ও পরপর তিনটে শিমূল গাছ অতিক্রম করে একটা বড় বেলগাছ এবং আমলকী গাছের আড়ালে কালচে রং এর প্রাচীন মন্দিরটি চোখে পড়েছিল। আমি বনের মধ্যে বেল ও শিমূল গাছের চূড়া লক্ষ্য করে নানারকম লতাপাতা ঠেলে ঠেলে হাঁটতে লাগলাম। কোথাও কোন পথের চিহ্ন খুঁজে পাচ্ছি না। মিনিট পনেরো হাঁটার পর একটা শিমূল গাছের চূড়া দেখতে পেয়ে সেইদিকে দৃষ্টি রেখে হাঁটতে লাগলাম। কাছাকাছি এসে দেখি প্রায় ১০ ফুট ব্যাস যুক্ত গুঁড়িওয়ালা শিমূলগাছ। তার পিছনে অসংখ্য বনপাদপ, নটরাজের মত তাণ্ডব নৃত্যের ভঙ্গীতে শাখা বাহু ছড়িয়ে বনের শোভা বাড়িয়ে দিয়েছে। শোভা দেখার মন এখন নেই। নিরাশ হলাম! কারণ ভূতনাথের মন্দিরের কাছে এত বড় গাছ ছিল না। সেখানে আছে পরপর তিনটি শিমূল গাছ, বেলগাছ ও আমলকী গাছ। যা এখানে ধারে কাছে দেখছি না।


সে পথ ছেড়ে জঙ্গলের অন্য পথ ধরলাম। শিশিরসিক্ত নিস্তদ্ধ বনস্থলীতে কত রকমের বন্য বিহঙ্গের অদ্ভুত সব কূজন শুনতে পাচ্ছি। একটা পথের চিহ্ন দেখতে পেয়ে আশায় বুক দুলে উঠল। এই পথ নিশ্চয়ই ভূতনাথের মন্দিরে পৌঁচেছে। সেই পথের নিশানা ধরে হাঁটতে লাগলাম। হায় ভগবান, এ যে পৌঁছে গেলাম এমন এক জায়গায় যেখানে অনেকখানি অনাবৃত পাথর বেরিয়ে আছে। পাথরের পাশ দিয়ে হেঁটে মিনিট দশেক পরে পৌঁছলাম বনের এমন একপ্রান্তে যেখানে বন ঢালু হয়ে নিচের দিকে নেমে গেছে, সেখানে এখনও কুয়াশা জড়িয়ে আছে গাছপালায়। মনে হচ্ছে ঢালুতে নিচে কেউ বুঝি আগুন দিয়েছে, তার ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠে আসছে জঙ্গলের ভিতরে। এইভাবে এদিকে ওদিকে ঘুরপাক খেতে খেতে অবশেষে হতাশ হয়ে একটা ফাঁকা জায়গা দেখে বসে পড়লাম গাঁঠরীর উপর।


বড় বড় গাছপালার ফাঁক দিয়ে তির্যকভাবে রোদ এসে পড়েছে গায়ে। আমি হতাশ মনে মা নর্মদার ষড়ক্ষরী মূলবীজ জপ করতে লাগলাম। মিনিট পাঁচেক পরে বনের ভিতরে কোথাও থেকে কানে একটা গান ভেসে এল। কান পাততেই ধীরে ধীরে বুঝতেও পারলাম সেই গানের ভাষা ---



মেরে আখন কে দৌতারে,
পিতা-পুত্রী অভিরাম মনোহর
কৈলাস-কণ্টক মেঁ বাঢ়ে

আমি লাফ দিয়ে উঠে পড়লাম। এ যে ভারোচের সেই 'কঙ্কালসার ভক্ষণাসুর' সাধুর কণ্ঠস্বর! আনন্দে মন নেচে উঠল। গানের সুর লক্ষ্য করে গাছপালা মাড়িয়ে হাঁটতে লাগলাম।

শুক শারদ নারদ বলিহারী
মহিমা বর্ণত হারে।
মেরে আখন কে দৌতারে।

গানের ভাষা ও সুর ক্রমশঃ স্পষ্টতর ও নিকটতর হচ্ছে ---

মেরে আখন কে দৌতারে,
রেবা শিবম্‌, শিবম্‌ রেবা
ইয়ে দৌ, রূপ উজারে।

একটা লতার  ঝোপ অতিক্রম করতেই পরপর তিনটি শিমূল গাছ, বেল ও আমলকী গাছের আড়ালে ভূতনাথের মন্দির চোখে পড়ল। দরজার চৌকাঠে বসে আছেন গায়ক। কিন্তু ইনি ত ভারভূতি বা ভারোচের সেই 'ভক্ষণাসুর' সাধু নন। ইনি যে আমার পরম প্রিয় যোগিরাজাধিরাজ প্রলয়দাসজী! আমার হাত থেকে গাঁঠরী, ঝোলা, লাঠি ইত্যাদি খসে পড়ল। মাথা ঘুরে গেল, আমি ধপ্‌ করে মাটিতে বসে পড়লাম। মিনিটখানিক তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমার বিস্ময়ের ঘোর কিছুতেই কাটছে না, ভাবছি ইনিই কি তিনি অর্থাৎ যাঁর একসঙ্গে প্রায় ৮০টা কলা এবং ৮টা নারকেল খাওয়া দেখে রতনভারতীজী যাঁকে 'ভক্ষণাসুর সাধু' বলে অভিহিত করেছিলেন। তাকাবার সময় উভয়েরই চোখ দুটির অদ্ভুত ধরণের মিজিমিজি ভঙ্গিমা ছাড়া আর কিছু দৈহিক সাদৃশ্য ত চোখে পড়ছে না! 

'আমার কাছে উঠে এসে ভূতনাথকে প্রণাম কর। ভৃগুকচ্ছ ত পরিক্রমা করে এলে তাতে আমি খুব খুশী হয়েছি, তবে কিছু অসন্তোষের কারণ ঘটেছে। মূল শ্রীপতি তীর্থে এবং ভূতেশ্বরের শাম্ভবী পীঠে বিশেষতঃ ফেরার সময় ভারভূতেশ্বরের মহাদেবকে মহর্ষি তণ্ডিকৃত মহাস্তবরাজ শুনিয়ে আসা উচিত ছিল। যাই হোক, এখন মধ্যাহ্ন আসন্ন। মধ্যাহ্নক্ষণ ধরে তোমাকে ভূতনাথের পূজা করতে হবে। মন্দিরের মধ্যে ফুল, বেলপাতা, চন্দন সবই আছে। তুমি পূজা করতে বসে যাও। আমি মহাদেবের জন্য কিছু ভোগ সংগ্রহ করে আনছি।' 


এই বলে তিনি লাঠি হাতে নিয়ে কোথাও যাবার উপক্রম করতেই আমি তাঁর পায়ে লুটিয়ে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলাম। 'শিবং ভূয়াৎ' বলে তিনি লাঠি ঠুকে ঠুকে মন্দিরের পিছন দিকে চলে গেলেন। আমি দু'তিন মিনিট হতভম্ব হয়ে বসে থাকলাম।




To be continued...................







Wednesday, August 6, 2014

বেদ কি ------


বেদ হল সাক্ষাৎ ব্রহ্মবাণী। বেদ অনন্ত ঞ্জানের আকর, ভারতীয় সংস্কৃতির মণি-মঞ্জুষা।



শ্রমেণ তপসা সৃষ্টা ব্রহ্মণা বিত্তর্ত্তে শ্রিতা।। ১
সত্যেনাবৃতা শ্রিয়া প্রাবৃতা যশসা পরিবৃতা।। ২
স্বধয়া পরিহিতা শ্রদ্ধয়া পর্যূঢ়া দীক্ষয়া গুপ্তা যঞ্জে প্রতিষ্ঠিতা লোকো নিধনম্‌।। ৩


---- শ্রম ও তপস্যায় ব্রহ্মবাণী সৃষ্ট হয়। ভক্তি ও ঞ্জানে তাকে প্রাপ্ত হওয়া যায়। সেই সুগভীর সত্য ঋতে আশ্রিত। সত্যই তার আবরণ, সত্য তার বিজয়শ্রী, কল্যাণে তা পরাবৃত এবং যশে তা পরিবৃত।

বেদের অপর নাম শ্রুতি। বেদই মানুষকে শুনিয়েছেন যে, সে ক্ষুদ্র নয়। তার মধ্যেই রয়েছে পরিপূর্ণতার স্বধা। শ্রদ্ধা, শুচিতা, তপস্যা এ ব্রত পালনের দ্বারাই তা বিকাশ প্রাপ্ত হয়। বেদের দীক্ষা-বীর্যই জীবকে অমৃত তত্ত্বে প্রতিষ্ঠিত করে, অন্তরস্থ যঞ্জশিখা দ্বারা তার এই অমৃত সত্ত্বার বোধন ঘটে। সে তখন বুঝতে পারে যে, সে সীমার মধ্যে আবদ্ধ নয়, সমগ্র ত্রিলোকই তার নিবাসস্থল --- সে মহতো মহীয়ান সর্বব্যাপ্ত সত্তা। যে অমৃতবিদ্যা মানুষের জীবনকে প্রদীপ্ত করে, পরিতৃপ্ত করে, প্রসন্ন করে এই বিদ্যার রহস্য অবগত হতে হলে চাই অবিচল শ্রদ্ধা, শুদ্ধা, বোধি, অবিশ্রান্ত যত্ন ও অবিরাম তপস্যা।



https://www.facebook.com/pages/tapobhuminarmada/454528151310191

Monday, July 28, 2014


"................ বেদ-বেদান্ত  অধ্যায়নকালে তিনি প্রায়ই বলতেন অদ্বৈতবেদান্তের নিগূঢ় রহস্য বুঝতে হলে বিদ্যারণ্য মুণীশ্বর প্রণীত পঞ্চদশী অপরিহার্য। বিদ্যারণ্য মুণীশ্বর সনাতন ব্রহ্ম সংবিদের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছেন --- এই সংবিদের উদয় নেই, অস্তও নেই, এটি স্বপ্রকাশ এবং স্বতঃপ্রমাণ।

পঞ্চদশী ধৃত ঐ সংবিদ যেমন নিয়ত পরিবর্তনশীল জগতে নিত্য  এবং শ্বাশত, তেমনি মদীয় পিতৃদেব প্রদত্ত পঞ্চদশ  উপদেশও শুধু আমার (লেখকের) জীবনে কেন, যে কোন মানুষের জীবনে শাশ্বত আলোক বর্তিকার মত; জীবনে যত পরিবর্তনই আসুক, তাঁর উপদেশের অন্তর্নিহিত সংবিদই যে কোন মানুষের জীবনের ধ্রুব পথটিকে উদ্ভাসিত করে তুলবে। উপদেশগুলি হল ---


1. সব সময় লেখাপড়া করবে। বই এর পর বই, লাইব্রেরীর পর লাইব্রেরী উজাড় করে পড়বে। হাতের কাছে পঞ্জিকা জুটলে তাই পড়বে। তাতেও অনেক শিক্ষণীয় বিষয় থাকে। প্রত্যেকের কিছু না কিছু নেশা থাকে। বই পড়া-ই তোমার নেশা হোক।


2. যা কিছু পড়বে, শুনবে এবং দেখবে তা বিচার পূর্বক গ্রহণ করো।


3. প্রীতির ঘাটে অপরাধ করো না। যে তোমাকে ভালবাসে, তার ত্রুটি বিচ্যুতি উপেক্ষা করতে শিক্ষা কর।


4.
যে তোমাকে দেয় জল, প্রতিদানে অন্ন দিও তারে,
মিষ্ট কথা বলে যদি কেহ, নমস্কার করো বারে বারে।
কড়ি যদি পাও কভু মোহরেতে দিও প্রতিদান,
প্রাণ যে বাঁচাল তব তার তরে দিও তব প্রাণ।
একগুণ পাও যদি তুমি দশগুণ দিও তারে ফিরে,
অপকার পাও যদি কভু, উপকারে রেখো তারে ঘিরে।।

5. সংস্কৃত শাস্ত্রের সেবায় জীবনপাত করবে। সংস্কৃত একাধারে ঞ্জান এবং আনন্দের খনি। "ধন্যা সংস্কৃতবাক্‌ সুধাপরতরা গীর্ব্বাণসংসেবিতা।"

'ধন্য সংস্কৃতভাষা! কি রস তোমার,
সুধাও তাহার কাছে অতি তুচ্ছ ছার।'

6.  বৈদিক  ঋষিদের কেউ অমর্যাদা করলে তা পিতৃ-অপমানের সমতুল্য মনে করবে এবং তার প্রতিবিধানে তৎক্ষণাৎ তৎপর হবে। স্বদেশী, বিদেশী যিনি যত বড় পণ্ডিতই হোক না কেন, তাঁরা যদি কেউ ঋষি বাক্যের বিকৃত অর্থ করেন, তা নির্ভয়ে খণ্ডন করা কর্তব্য। তোপের মুখে উড়িয়ে দিলেও সত্য প্রকাশে কখনও কুণ্ঠিত হবে না।


7.  প্রিয় বা অপ্রিয় কিছু উপস্থিত হলে তাকে আদরে গ্রহণ করতে হয়। তা চলে যাবার উপক্রম করলে নিবারণ করতে নেই। সুখ, দুঃখ অভাব অনটনকে শান্ত চিত্তে গ্রহণ করতে অভ্যাস কর। দারিদ্র্যের কষাঘাতে জীবনের ভিত্‌ পাকাপোক্ত হয়। মহাত্মা যীশুখ্রীষ্টের জন্ম আস্তাবলে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্ম কংসের বন্দীশালায়। মা জানকী, কুন্তীদেবী এবং পঞ্চ পাণ্ডবকে অনেক লাঞ্ছনা ভোগ এবং অনেক কান্না কাঁদতে হয়েছে। এইসবের তাৎপর্য কখনও ভেবে দেখেছ কি? কেবল তোতা পাখীর মত শাস্ত্র মুখস্থ করলেই চলবে না। প্রত্যেকটি ঘটনাও চরিত্র অঙ্কনের মূলে ঋষিদের উদ্দেশ্য কি, তা হৃদয়ঙ্গম করতে চেষ্টা কর। এটাই সর্বোত্তম তপস্যা কেননা জীবন্মুক্তি লক্ষণ-স্থিতি রূপী তপস্যা।


8.  ঈশ্বর আছেন --- এটাই ধ্রুব সত্য।


9.  ভয়, ভাবনা, ভূত, ভোগ ও ভগ --- এই পাঁচটি 'ভ'- কারান্ত শব্দের উপদ্রব থাকলে ভগবানকে লাভ করা যায় না। যেমন --- অন্ধকার থাকলে  আলোর অভাব  এবং  আলো থাকলে অন্ধকারের অভাব সূচিত করে, তেমনি উক্ত পাঁচটি 'ভ'- কারান্ত শব্দের সঙ্গে  ষষ্ঠ 'ভ'- কারান্ত শব্দ ভগবৎ -তত্ত্বের নিত্য বিরোধ বর্তমান।


10.  মন  চঞ্চল কারণ সে অখণ্ড আনন্দের প্রত্যাশী। সে অখণ্ড আনন্দের স্বাদ জানে, অথচ পাচ্ছে না। ফলে, বিষয় হতে বিষয়ান্তরে ছোটাছুটি করে। চঞ্চলতা মনের স্বভাব নয়, স্থৈর্যই তার স্বভাব। চাঞ্চল্যটা তার সাময়িক ব্যারাম মাত্র।


11.  একটা  দেশলাই কাঠি যদি সারা বৎসর ধরে অহরহ উল্টো দিকে ঘর্ষণ করা  হয়, তাতে যেমন আলো জ্বলে না, ঠিক তেমনি প্রক্রিয়ামত ধ্যান না করলে কিছুতে ফল পাবে না। প্রক্রিয়ামত এবং অনুরাগ সহকারে ধ্যান করে যাও, আনন্দের সন্ধান অবশ্যই মিলবে।


12.  ভগবানের নিকট কখনও কোন মানৎ --- মানসিক করবে না। ভগবান কারো বাজার- সরকার নন যে, প্রাতঃকালে শয্যা ত্যাগের পর হতে রাত্রিতে পুনরায় শয্যা গ্রহণ পর্যন্ত কেবলই 'এটা দাও ওটা আন' বলে ফর্দের পর ফর্দ পেশ করব আর তিনি তটস্থ হয়ে তদ্দণ্ডে তা করে দেবেন।


13.  অসন্তুষ্টাঃ দ্বিজাঃ নষ্টাঃ। অতএব সর্বাবস্থায় চিত্তের সন্তোষ বজায় রেখে চলবে --- সন্তোষং পরমং ধনম্‌।


14.  জীবনের আদর্শ কি তা জানতে হলে নিজের গোত্রকে ভাল করে জানতে হবে। প্রত্যেকের গোত্রের মধ্যেই নির্দেশ আছে। আমাদের বাৎস্য গোত্র। বাৎস্য গোত্রের প্রবর অর্থাৎ প্রকৃষ্টরূপে বরণীয় ঋষি যথাক্রমে --- ঔর্ব্ব, চ্যবন, ভার্গব, জামদগ্ন্য এবং আপ্লুবান্‌।


a) ঋষি ঔর্ব্ব  ছিলেন  সসাগরা পৃথিবীর অধীশ্বর, সগরের গুরু। তিনিই পৃথিবীতে অগ্নি তত্ত্বের প্রথম উদ্ভাবক; তিনিই বলেছিলেন, 'জীবন তো কেবল জৈব কর্ম নহে --- ইহা বিশ্বদেবের পূজা। সমগ্র মানব জীবনকে বৈশ্বানরের  অগ্নিচয়ন-যঞ্জ বলে মনে করবে।' তাঁর জীবন এই শিক্ষা দিচ্ছে যে --- তত্ত্বঞ্জানের সঙ্গে বিঞ্জান চেতনাও প্রয়োজন।

b)  চ্যবন মুনি অতিরিক্ত ভোগের ফলে অকালে জরাগ্রস্ত হন, পরে সংযম ও সাধনা দ্বারা জরা ব্যাধি জয় করেন। মাত্রাতিরিক্ত ভোগের কুফল এবং তা জয়ের কৌশল এই মুনির জীবন হতে শিক্ষনীয়।

c)  ভার্গব অর্থাৎ শুক্রাচার্য  ছিলেন মৃত-সঞ্জিবনী বিদ্যার কুশলী  আচার্য --- মৃত্যুর উপর জীবনের জয়গানের উদ্‌গাতা।

d)  জামদগ্ন্য (পরশুরাম) ছিলেন তেজ, বীর্য, তপস্যার জ্বলন্ত বিগ্রহ।

e)  আপ্লুবান্‌  ছিলেন দেশ প্রেমিক ঋষি, তিনি মাতৃভূমিকে জড় মাটি, কাঠ পাথরের ভূখণ্ড বলে ভাবতেন না --- তাঁহার ভাবদৃষ্টিতে মাতৃভূমি ছিল মৃন্ময়ী মা।

আমাদের গোত্র-পুরুষ এই সমস্ত ঋষির জীবনাদর্শ মনন করলেই পথের সন্ধান পাবে।

15.  যা কিছু দুর্গম, দুস্তর, দুর্লভ এবং দুঃসাধ্য --- "তৎ সর্বং তপসা সাধ্যং তপো হি দুরতিক্রমম্‌।" তপস্যা দ্বারাই সব কিছু লাভ করা যায়। পরশুরাম  রামচন্দ্রকে বলেছিলেন, তুমি শরনিক্ষেপ করে আমার স্বর্গপথ রুদ্ধ করতে পার, তুমি কেবল আমার তপস্যার পথ নষ্ট কোরো না। কারণ, তপস্যার পথ  খোলা থাকলে আমি তপস্যা দ্বারা সব কিছুই পুনরায় জয় করে নেব। সারকথা --- তপস্যা।  

তপস্যাই ব্রাহ্মণের একমাত্র ধন। মনে রাখবে --- ব্রহ্মবিদ্যা অনায়াস লভ্য নয়, তার জন্য চাই অবিশ্রান্ত যত্ন, চাই অবিরাম তপস্যা।।" 

https://www.facebook.com/pages/tapobhuminarmada/454528151310191



Friday, June 27, 2014


"তুমি আছ অনলে অনিলে চির নভোনীলে
ভূধরে সলিলে গগণে
আছ বিটপী লতায় জলদের গায়
শশী তারকায় তপনে।"

Tuesday, June 24, 2014


"অসীম আকাশ তোমারে মা জানায় নমস্কার।
বিপুলা ধরণী তোমার চরণে রাখিল প্রণতি তার।
দেবতা মানব সবার অর্ঘ্য সকলেরই বলিদান
মা, তোমার চরণে সঁপি যে একমন একপ্রাণ।।"




"পিতৃজ্যোতি সূর্য সম অপার অনন্ত
মাতৃস্নেহ সমুদ্রসে নাহি তার অন্ত।
পৃথিবীর চেয়ে বড় পিতা জ্যোতিষ্মান্‌
জননীর মাত্রা কেহ জানে না ধীমান্‌!

Tuesday, May 27, 2014


পিতঃ! অনন্ত আকাশ জুড়ি তোমার বিশাল আঁখি,
জগতের প্রতি দৃশ্যে ও দুটি নয়ন দেখি;
নয়নে নয়ন পড়ে যখন যেদিকে চাই
স্নেহময় আঁখি দুটি সতত দেখিতে পাই।
এ দৃশ্য জগৎ ছেড়ে অন্তরে খুঁজিলে দেখি
প্রেমভরে চেয়ে আছে স্নেহমাখা দুটি আঁখি।
গোপনেই চেয়ে থাক গোপনে বাসগো ভালো
মন্ত্রমূর্তি প্রকাশিয়া করিলে হৃদয় আলো।।
নিজেকে দেবতারূপে যে ঞ্জান মুকুরে
স্বাধ্যায় মনন বলে কিংবা মন্ত্রবলে
মরে বেঁচে উঠি,
আকাশ-কুসুমে গাঁথি জয়মাল্য, অবারিত দূরে
মাধুর্যের রসমূর্তি তুমি পিতঃ। তোমা পানে

Monday, May 12, 2014

মহর্ষি গালব:------


Cont(last)......


ঋষি বিশ্বামিত্র বললেন --- আমার প্রথম দাবী --- পরম বেদবিৎ আচার্য শাকলের সাহচর্য্যে থেকে তুমি বেদমন্ত্রের ক্রমবিভাগ কর। বেদের স্বর ও ছন্দের অনুসরণে মন্ত্র সংহিতা এবং ব্রাহ্মণের একটি ক্রমানুসারিণী রচনা কর ভবিষ্যৎ উত্তরপুরুষদের জন্য। আর রচনা কর এমন একটি ব্যাকরণ যা পূর্ণাঙ্গ দর্শনের মর্যাদা পায়। কেননা পদ ও পদার্থের বোধ ব্যতীত তন্মূলক বৈদিক বাক্যার্থের সম্যক ঞ্জনোপলব্ধি সম্ভবপর হয় না। 


বেদমন্ত্রের আলোক দীপিকা স্বয়ং মহেশ্বরের রচিত। প্রাচীনতম মাহেশ ব্যাকরণ, ইন্দ্র রচিত ঐন্দ্র ব্যাকরণ, ভাণ্ডারীমুনি রচিত ভাণ্ডরীয় ব্যাকরণ, মহর্ষি কাশকৃৎস্ন রচিত কাশকৃৎস্ন ব্যাকরণ প্রভৃতি ব্যাকরণগুলি কালের স্থূল হস্তাবলেপে জীর্ণ এবং বিস্মৃত হতে বসেছে। তুমি সেইগুলিতে সমকালীন শব্দ ও পদ সংযোজিত করে তাকে আরও উজ্জ্বল ও পরিমার্জিত করে তোল।


শিক্ষা ঘ্রাণং তু বেদস্য মুখং ব্যাকরণং স্মৃতম্‌। শিক্ষাশাস্ত্র যদি বেদের প্রাণ হয়, ব্যাকরণ হল তার মুখ। ব্যাকরণের মধ্যে সমুচ্চ দার্শনিক ভাব এমনভাব উপ্ত করে দাও যাতে তা পাঠ ও মনন করলেই লক্ষ্যবস্তু ব্রহ্ম যেন প্রকটিত হয়ে পড়ে। শাস্ত্র এমন হোক যা মানুষের সকল জিঞ্জাসার ইতি ঘটিয়ে তাকে পূর্ণত্বে প্রতিষ্ঠিত করে।


গালব গুরুর দুটি ইচ্ছাই পূর্ণ করলেন। একদিকে তিনি যেমন বেদের ক্রমবিভাগ করে তার স্বর ও ছন্দ বিন্যাস করেছিলেন তেমনি অন্যদিকে ব্যাকরণ রচনা করে তাকে উন্নত করেছিলেন দর্শনের পর্যায়ে। তাঁর রচিত ব্যাকরণ গালব ব্যাকরণ নামে বিখ্যাত। দুঃখের বিষয় বর্তমানে গালব ব্যাকরণ দেখতে পাওয়া যায় না।


একসময় সমগ্র ভারতবর্ষ জুড়ে এই ব্যাকরণের পঠন পাঠন হত এবং পরবর্তীকালে পাণিনি রচিত ব্যাকরণের পূর্ববর্তী সময়ে রচিত সেনশীয় ব্যাকরণ, কাশ্যপি ব্যাকরণ, স্ফোটায়ণ ব্যাকরণ, আপিশন ব্যাকরণ, ব্যাড়িয় ব্যাকরণ, শাকল্য ও শাকটায়ণ ব্যাকরণ প্রভৃতির উপর প্রভাব বিস্তার করেছিল সে বিষয় কোন সন্দেহ নেই।



স্বদেশে ঐতিহ্যের মহান্‌ মহিমালয়ে
করি প্রতিষ্ঠিত, ধন্য করি দিলে জন্মভূমি
শাশ্বত স্বাক্ষরে। সারস্বত সাধনার সিদ্ধমন্ত্রে তব
মূক যাহা হল তা বাঙ্‌ময়।



Sunday, May 11, 2014

মহর্ষি গালব:------


Cont(2).........

দীর্ঘকাল পরে প্রাণাধিক প্রিয় শিষ্যকে প্রত্যাগত দেখেও স্নেহময় ঋষি কোন স্বস্তিবচন উচ্চারণ করলেন না। বরং তিনি বেদনাহত কণ্ঠে বললেন --- গালব তোমার পাতিত্য দোষ ঘটেছে। 
বিভূতির প্রকাশ দেখিয়ে তুমি সাধনার ব্যাভিচার ঘটিয়েছ। বৈদিক ভারতবর্ষের এটি চিরাচরিত বৃত্ত নয়। অত্যন্ত নিম্ন কোটীর যোগীরাই অস্মিতা ও অবস্পন্দনের দোষে আচ্ছন্ন বলেই তাদেরকে ঘিরে অলৌকিক শক্তির প্রকাশ ঘটে যায়। বিভূতি আত্মজ্যোতির অবস্পন্দন বা কুফল মাত্র। 

বৎস, ঞ্জানসিদ্ধিই ঋষিদের আরাধনার বস্তু। যে অমৃতবিদ্যা মানুষের জীবনকে প্রদীপ্ত করে, পরিতৃপ্ত করে এবং প্রসন্ন করে --- সেই বিদ্যাই ঞ্জানসিদ্ধির পথ। তা কোন অলৌকিক শক্তির যাদুক্রীড়া নয়, লোমচমৎকারী ইন্দ্রজাল প্রদর্শন করাও নয়। এই অমৃতবিদ্যা কখনও অনায়াস লভ্য নয়, তারজন্য চাই অবিশ্রান্ত যত্ন, চাই অবিরাম তপস্যা। শ্রম ও তপস্যায় সেই ব্রহ্মবাণী সৃষ্ট হয়। ভক্তি ও ঞ্জানে তাকে প্রাপ্ত হওয়া যায়। সেই সুগভীর সত্য ঋতে আশ্রিত, সত্য তার আবরণ, সত্য তার বিজয়শ্রী, কল্যাণে তা প্রাকৃত, যশে তা পরিবৃত। দিব্যশক্তিকে সংগোপনে অবলীলাক্রমে ধারণ করে আত্মসাৎ করার মধ্যেই কৃতকৃত্যা। যাও অযথা লোক সংগ্রহ বা বৃথা পরিব্রাজন ত্যাগ করে নির্জনে গভীর তপস্যায় নিমগ্ন হও। বেদঞ্জান আহরণ করার তপস্যাতেই জীবনে আসে অভ্যুদয়। আসে উদয়ণ।

নতমস্তকে গুরুর আদেশ শিরোধার্য করে গালব চলে গেলেন তপস্যার জন্য। এক নির্জন গিরিগুহায় ধ্যানাসনে বসলেন তিনি। দিন যায়, বর্ষ যায়, অবিচলিত নিষ্ঠায় ধ্যানমগ্ন রইলেন গালব। বৎসরের পর বৎসর উৎক্রান্ত হয়ে গেল। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষার উপদ্রব, তুষারের প্রবল বিড়ম্বনাও তিনি হাসি মুখে সইতে লাগলেন। 


অবশেষে সেই পরম বাঞ্ছিত দিনটি তাঁর জীবনে দেখা গেল। তিনি দেখলেন --- সমগ্র হিরন্ময় আকাশ, ভর্গজ্যোতির চকিত চমকে ভাস্বর হয়ে উঠলো, তাঁর অন্তরসত্তা ও বহির্সত্তা দ্যুলোক ভূলোক ব্যপ্ত করে প্রকট হয়ে উঠল বেদবাণী ---


"জ্যোতির পুত্র আমরা --- উদ্বোধন আমাদের, অভ্যুদয় আমাদের --- আমাদের জন্যই পরমাস্থিতি আনন্দচকিত ভূমি, বিদ্বেষ এবং দ্রোহ যেন পরাজয় লাভ করে। এই কথা বলেছেন অগ্নি --- যার দিব্যজ্যোতি জীবনকে ভাস্বর করে তোলে। এই কথা বলেছেন সোম --- যার আনন্দপ্রবাহ বিচিত্র এবং মুক্তছন্দ। আমরা পেয়েছি অমৃতলোকের স্বরূপজ্যোতিঃ --- পেয়েছি পরাসংবিদের পরমাদ্যুতি। যাঁর তেজের দিব্যরাগিনীতে দ্যুলোক অনুপ্রাণিত এবং উজ্জীবিত --- সেই আদিত্যের পরম জ্যোতিস্বরূপকে আমরা জেনেছি --- আমরা পেয়েছি আলোর অমৃতভাণ্ডার।

আহারে! এত আলো এত জ্যোতি এত অমৃতের মধুচ্ছন্দরূপ, সে যে প্রতি জীবের চিদ্‌গুহাতেই সংগুপ্ত আছে। জীব! ওঠ, ওঠ, জাগো জাগো, এই পরাকণ্ঠীর জন্য এই দিব্য প্রৈতির জন্যই যে তোমার মনুষ্যদেহে অবতরণ। জীবনটা তো তোমার যঞ্জ ছাড়া কিছু নয়। এই যঞ্জ বসুমান, জীবনের হবি দিয়ে এই যঞ্জকে পূর্ণ কর।

তোমার উর্ধরতি রসান্বিত হোক। যে জীবন উৎসৃজিত, যে জীবন ঊর্ধের অভিসারে আকুল, সেই জীবনেই জেগে উঠে সচ্চিদানন্দের চিদ্‌বিলাস। সংসার অভিযানে ক্লান্ত আমরা। আমাদের চাই এই পরমানন্দের পরিস্ফূরণ। দুঃখের অরণি মন্থন করে আমরা জ্বালাতে চাই ক্রতুময় বহ্নিশিখা। আমাদের জীবনের তপস্যায় জেগে উঠুক আনন্দ সমুদ্রের কল -কল্লোল। জীবনের পরমা হ্রী ও শ্রী এই পথে ওঁ বসুমান ভূয়ামং বসুময়ি ধৈহি।"

ব্যুত্থানের পর গালব দেখলেন ঋষি বিশ্বামিত্র তাঁর সম্মুখে দণ্ডায়মান রয়েছেন। গুরু আনন্দে আত্মহারা। বুকে জড়িয়ে ধরে বারবার আলিঙ্গন করে গালবকে পরিয়ে দিলেন অক্ষমালা। 


গদগদ কণ্ঠে তিনি বললেন --- গালব, আজ থেকে তুমি মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষিকুলে স্থান পেলে। তোমার নিকট প্রকটিত বেদমন্ত্র জ্যোতির অক্ষরে লেখা থাকবে মানুষের পরম ঊর্ধায়ণের কথা। আলোর পিপাসা আর তার পরিতৃপ্তি এবং অমৃতের পথে তার উত্তরণের পরমা আশ্বাস বিধৃত হয়ে উঠল এই বাণীতে। দেখ পরমেষ্ঠী গুরুকুল ঋষিকুল বদ্ধ করে তোমাকে প্রণাম জানাচ্ছে। দক্ষিণা দাও বৎস, দক্ষিণা দাও।


মুগ্ধ, আবিষ্ট, পরম পরিতৃপ্ত, আপ্তকাম গালব নিবেদন করলেন --- আদেশয়! যত্তে মনসি বর্ততে। আপনি যা আদেশ করবেন তাই আমি পালন করব। ......



To be continued..........








Friday, May 9, 2014

মহর্ষি গালব:------


মাত্র ৯ বছর বয়সে গালব এসেছিলেন সমিৎপানি হয়ে ঋষি বিশ্বামিত্রের আশ্রমে। বালক সমাবর্তনের শেষে গৃহে প্রত্যাবর্তন করেন নি। কারণ গুরুগৃহে থাকাকালে তাঁর পিতামাতা গত হন। সংসারের সকল বন্ধন ছিন্ন হওয়ায় গুরুগৃহে কাল কেটেছে গালবের। ঋষিও প্রাণ দিয়ে ভালবাসতেন এই শিষ্যকে। সর্ববিদ্যায় পারংগম, সেবা-তৎপর গালবের বিশেষ গুণ। বেদের সমগ্র শাখায় তাঁর অনায়াসে বিচরণ ক্ষমতা। অন্তেবাসী মাত্রেই জানেন গালব অসাধারণ বিচারমল্ল।

কিন্তু তাঁর পাণ্ডিত্য এবং অতুলনীয় বিচার ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে ঋষি বিশ্বামিত্রের কাছে  অভিযোগ আসে --- বিচারকালে গালব বয়োবৃদ্ধ এবং ঞ্জানবৃদ্ধদের সম্মান রাখেন না।


প্রিয় শিষ্যের নামে অভিযোগ শুনে জ্বলন্ত পাবকের মত মৃগচর্মে সমাসীন গায়েত্রীর মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি গুরু বিশ্বামিত্রের  মুখাবয়বে দেখা দিল ভ্রূকুটিরেখা। সমগ্র ব্রহ্মবর্তে তাঁর আসন বিশেষ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত। অসংখ্য  তাপস, ঋষি বালক, ঋত্বিক, অধ্বর্যু তাঁকে ঘিরে রয়েছেন। পবিত্র হোম ধূমে চারিদিক সুরভিত। এহেন শান্ত ও স্নিগ্ধ পরিবেশে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে গুরু বলছেন ------  গালব কবে তুমি তর্ক ও জল্প ছেড়ে মৌন অবলম্বন করবে? কবে তুমি মুনি হবে? বৃত্তেন হি ভবত্যার্থো ন ঞ্জানম ন বিদ্যয়া। গালব মনে রেখো পরিশীলিত আর শ্রদ্ধান্বিত জীবনচর্চা দ্বারাই লোকে আর্য হয়। গালবের সতীর্থদের কাছে এ দৃশ্য কল্পনাতীত। বিনীত কণ্ঠে অথচ সপ্রতিভ ভাবে গালব নিবেদন করলেন --- অধুনৈব, অধুনৈব প্রভো! আপনি আশীর্বাদ করলে এখনই পারি।

সেই থেকে গালব হলেন মৌনব্রতী। কখন কুরু, কখন পাঞ্চাল, কখনও বা পুষ্করের গহন অরণ্যে অবধূতের ন্যায় বিচরণ করতে লাগলেন গালব। এইভাবে প্রব্রজ্যা করতে করতে একদিন গালব রাজা অশ্বপাণির অন্তঃপুরে দৈবাৎ প্রবেশ করেন। কোন দিকে দৃক্‌পাত নেই, আত্মানন্দে তিনি বিভোর। প্রতিহারীরা সঙ্গে সঙ্গে এই নির্লজ্জ অবধূতকে বন্দী করে রাজার সম্মুখে উপস্থিত করল।


ক্রুদ্ধ রাজার আদেশে তখনই তাঁর একখানি হাত কেটে ফেলা হল। এতে গালব কোন ভ্রূক্ষেপ করলেন না। মাটিতে ছিন্ন হস্ত পতিত হল। রক্তের ধারা ঝরে পড়ছে। অথচ আহত ব্যক্তি উদাসীন। মুখে কোন ব্যথা বেদনার বিকার নেই। কোন আর্তনাদ নেই। এই অভাবনীয় দৃশ্য দেখে সপারিষদ রাজা স্তম্ভিত। তিনি বুঝলেন যে এই ব্যক্তি নিশ্চয়ই কোন সিদ্ধ তাপস। তাঁরা সবাই পদতলে পড়ে বারংবার ক্ষমা ভিক্ষা করতে লাগলেন। প্রসন্ন হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল অবধূতের মুখ। তিনি অস্ফুট কণ্ঠে বললেন --- অপিধভৎস্ব। ভীত সন্ত্রস্ত রাজা শশব্যস্তে হাতখানি তুলে নিয়ে যথাস্থানে সংলগ্ন করলেন --- ক্ষত চিহ্ন নিমেষে গেল মিলিয়ে --- হাতটি যথাপূর্বং তথাস্থিতং। গালব তাঁদেরকে আশীর্বাদ করে নিষ্ক্রান্ত হলেন সেখান থেকে।


এইভাবে ঘুরতে ঘুরতে গালব একদিন গভীর রাত্রিতে এক তপোবনের ব্রীহি যবাদির গোলার কাছে গিয়ে সমাধিস্থ হয়ে পড়েন। আশ্রমের ব্রহ্মচারীরা ভাবলেন এই ব্যক্তি নিশ্চয়ই তস্কর। তারা লগুড় হস্তে গালবকে প্রহার করতে উদ্যত হতেই তিনিও তাদেরকে নিবারণ করার জন্য হাত তুললেন। আশ্চর্যের বিষয় ধ্যানস্থ যোগী এবং আশ্রম রক্ষকদেরকে সারারাত্রি ঐ অবস্থাতে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। প্রত্যুষে গালব চলে যাবার পর ঐ নিশ্চল অবস্থা থেকে আশ্রম রক্ষকরা মুক্তি পায়।


জনপদে জনপদে ছড়িয়ে পড়ছে গালবের অত্যাশ্চর্য কাহিনীর কথা। আপামর জনসাধারণ গালবকে দেখলেই শ্রদ্ধায় বিগলিত হয়ে পড়ছে। গালবের কিন্তু কোন দিকে লক্ষ্য নেই। অর্ন্তলক্ষ্য বহিঃদৃষ্টি, সর্বত্র সমদর্শন সদানন্দময় গালব এগিয়ে চলেছেন গুরু দর্শনের তীব্র আকাঙ্খা বুকে নিয়ে। পথে আবার এক বিভ্রাট দেখা দিল।


জঙ্গল থেকে কাঠ কেটে বয়ে নিয়ে চলেছে কাঠুরিয়াদের দল। তারা গালবকে চেনে না। দলের সর্দার শক্ত সামর্থ গালবকে জোর করে কাষ্ঠভার বহন করতে বাধ্য করল। মহাপুরুষের কিছুতেই আপত্তি নেই --- কোন ক্লেশেই তিনি কাতর নন। কাঠের বিপুল বোঝা মাথায় নিয়ে তিনি হাঁটতে লাগলেন কাঠুরিয়াদের সঙ্গে। দলনেতা মহাখুশী। দুর্বিপাক দেখা দিল একটু পরেই। গন্তব্যস্থলে পৌঁছে কাঠুরিয়াদের স্তূপীকৃত কাঠের রাশির উপর তিনি বোঝাটি ফেলে দেবার পরেই দেখা গেল আশ্চর্য অগ্নিকাণ্ড। সমস্ত কাঠই ভস্মীভূত হয়ে গেল।


ঘটনাটি ঘটল গুরুর আশ্রম থেকে নাতিদূরস্থ অরণ্যের এক উপান্তে। কাজেই সেসব কথা ঋষি বিশ্বামিত্রের কর্ণগোচর হতে বিলম্ব হল না। গালব আশ্রমে পৌঁছে গুরুর চরণে ভূলুণ্ঠিত হলেন। কিন্তু গুরু প্রণাম গ্রহণ করলেন না। ......



To be continued ...........

Tuesday, April 15, 2014


তনু  মন  প্রাণ  ঞ্জান  তন্ময়  হে,
চিন্ময়  তুমি  পিতঃ  চিন্ময়  হে।
আনন্দ  রস  ঘন  নন্দিত  হে,
অন্ধ  জীবনে  চির-বন্দিত  হে।

ভ্রান্তি  বিলুণ্ঠিত  সুপ্তি  মাঝে
শান্ত  সমুজ্জ্বল  দীপ্তি  রাজে।
বরেণ্য  শরেণ্য  হিরণ্য  হে
দৈন্য-এ  ক্রন্দন  ধন্য  যাহে।

তুমি  অনন্য  অনন্য  অনন্য  হে
চিন্ময়  তুমি  পিতঃ  চিন্ময়  হে।।



স্নেহরূপ  রত্ন  যাহা
তার  যিনি  পূর্ণরত্নাকর
বাল্যেতে  পালেন  যত্নে
যাঁর  দুটি  কর;
মূর্ত্তিমতী  ব্রহ্মকৃপা  যিনি
এই  ধরাতলে---
মাতা  নামে  পরিচিতা  দেবী
নমস্কার!  নমস্কার!
তাঁর  পদতলে।



শুভ নববর্ষ  ১৪২১

Friday, April 11, 2014


প্রভু! তোমার  নেই  ত  কোন  নাম
তবুও  করি  প্রণাম।
নামী  অনামী  সবই  তুমি
অসীম  তোমার  দাম।
তোমার  নেই  ত  কোন  রূপ
(তবু) জ্বালাই  প্রাণে  পূজার  ধূপ ---
রূপে  অরূপে  বিরূপে  তুমি
মিলনে  বিরহে  অপরূপ  পরিণাম।
তোমার  নেই  ত  কোন  শেষ
নেই  ত  কোন সুরু
আমার  জনম  মরণ  তোমার  হাতে
তাই  তো  তুমি  গুরু
তোমার  নেই  তো  কোন  কিছু
তবুও  ছুটছি  তোমার  পিছু
তুমি শূণ্য, তুমি পূর্ণ
তোমার  ত  হায়! নেই  ত  কোন  বিরাম।







Monday, February 24, 2014

"শিবভূমি কেদারতীর্থ" ------


Cont (last)..........


সন্ধ্যার প্রাকক্ষণে মন্দাকিনীর পবিত্র ধারায় আচমন করে কেদার দর্শনের জন্য মন্দিরাভিমুখে যাত্রা করলাম। কনকনে ঠাণ্ডা বাতাসে হাড়ে কাঁপুনি ধরে যাচ্ছে। কালো গ্রানাইট প্রস্তর নির্মিত সুশোভন মন্দিরের বাম দিকে হনুমানজী, দক্ষিণে পরশুরাম ও মধ্যস্থলে সম্মুখে বিঘ্ন-বিনাশন গনেশজী। ভিতর ভাগে নাতি-প্রশস্ত অঙ্গন, যা দেখতে অনেকটা নাট মন্দিরের মত। পদ্মখোদিত গর্ভগৃহের ছাদ নাটমন্দিরের বামভাগে লক্ষ্মীনারায়ণ, দক্ষিণে পার্বতী, মধ্যস্থলে নন্দীগণ ও বৃষমূর্তি। এইসব দর্শন করতে করতে তুষারনাথ কেদারেশ্বরের সুবৃহৎ জ্যোতির্লিঙ্গের সম্মুখে উপবিষ্ট হলাম।


পাণ্ডার "ওঁ ত্র্যম্বকং যজমহে" মন্ত্রপাঠের মধ্যে আমি (লেখক) দর্শন করতে লাগলাম সেই হিম-গিরিশীর্ষ-শোভী তুষার প্রচ্ছন্ন কেদার-তীর্থকে, যা সুর-নর-মুনি বন্দিত জটাজূটধারী ত্র্যম্বকের অবিচল ধ্যান মূর্তি! ধ্যান নিমীলিত নেত্রে মহাদেবে পূজার পর বাইরের আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রণাম জানালাম আমার ঋষি-পিতাকে। যাঁর নির্দেশে আজ আমি এস্থানে উপস্থিত হয়েছি। এই তীর্থ যাত্রায় যেন আমার সকল সাধনা সফল ও সম্পূর্ণ।


পাণ্ডা ঠাকুরের সঙ্গে ধর্মশালায় ফিরে এলাম। আমি তাকে দক্ষিণা দিয়ে বিদায় করতে চাইলাম। কিন্তু পাণ্ডা ঠাকুর আমার ঘরে বসে পড়ে বলতে লাগলেন --- আপনাকে আমার ভালো লেগেছে। তাই যাবার আগে আপনাকে কেদারের এক গুপ্ত রহস্য বলে যাচ্ছি---


উত্তরাখণ্ডে বর্ণিত সুবিশাল কেদার-তীর্থের মাহাত্ম্য সকলেরই দৃষ্টিতে অতুলনীয় হলেও জানবেন বাইরের প্রকৃতিতে যেভাবে মন্দাকিনী, সরস্বতী, মধু-গঙ্গা, দুধ-গঙ্গা বয়ে এসেছে, ভৈরব মূর্তি পাহাড়ে যেভাবে যেস্থানে অবস্থান করছে তারই ক্ষুদ্র প্রতিরূপ হল এই মন্দিরস্থ প্রাণনাথ। বাইরে কেদারের যেমন বিশাল অচঞ্চল রূপ তেমনি ভিতরে তার ক্ষুদ্র সংস্করণ।


তারপর আমাকে বাইরে যাবার ইঙ্গিত করে বললেন --- আসুন, আপনাকে একটা মজার দৃশ্য দেখাই। ঘোর অমাবস্যার রাত্রিতে এই জমে যাওয়া ঠাণ্ডায় বাইরের দিকে ভাল করে লক্ষ্য করলে দেখতে পাবেন  সমগ্র কেদার-খণ্ড যেন কাক-জ্যোৎস্নায় উদ্ভাসিত। মনে হবে পাহাড়ের মাথায় যেন লক্ষ ওয়াটের আলো জ্বালা হয়েছে আর তাতেই যেন সারা অঞ্চল আলোকিত হয়ে আছে। এখন মন্দির বন্ধ। কিন্তু মন্দিরাভ্যন্তরস্থিত প্রাণনাথও এরকম উজ্জ্বল ও জ্যোতির্ময় যা দিনের বেলায় আলোর মধ্যে দেখা যায় না।


লিঙ্গ গাত্রে কান পাতলে শুনবেন শঙ্খ-নিনাদ যা বাইরের নদীগুলির রবের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। 'জয় কেদারনাথের জয়' বলতে বলতে তিনি আর এক মুহুর্তও থামলেন না। তাঁর চলে যাবার পর ঘরে এসে দেখি আমার প্রদত্ত দক্ষিণা পড়ে আছে আমার বিছানার পাশে। দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে আর পাণ্ডা ঠাকুরের হদিশ পেলাম না।


এই অলৌকিক দৃশ্য দর্শনের পর সারারাত্রি দু'চোখের পাতা এক করতে পারলাম না। সকালে উঠে হিম শীতল ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে মন্দিরে উপস্থিত হলাম। মন্দিরের দরজা সবে খুলেছে। এক বৃদ্ধ পূজারী পূজার আয়োজন করছেন। আমাকে দেখেই বললেন --- আ গিয়া। আমি তাঁর কথার কোন উত্তর না দিয়ে পাণ্ডা ঠাকুরের কথা অনুযায়ী কেদারনাথজীকে নিরীক্ষণ করতে লাগলাম। লিঙ্গগাত্রে কান পাততেই শুনতে পেলাম শত শত মৃদঙ্গের তালে তালে অপূর্ব মধুর বোল। বুঝলাম তাঁর কথা বর্ণে বর্ণে সত্যি!


ঐ পাণ্ডাঠাকুরের অনেক খোঁজ করলেও তাঁর দর্শন মেলে নি। অদ্ভুত অভিঞ্জতাকে সঙ্গে করে, কেদারনাথকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম নিবেদন করে কেদার খণ্ড ত্যাগ করে ফিরে চললাম বাড়ীর পথে।


https://www.facebook.com/pages/tapobhuminarmada/454528151310191


Friday, February 21, 2014

"শিবভূমি কেদারতীর্থ" ------


............ বদ্রীনাথ যাত্রার অসীম কষ্ট অগ্রাহ্য করে কেদারের পথে যাত্রা করলাম। জোশীমঠ থেকে বাসে রুদ্রপ্রয়াগে এসে সেখান থেকে চড়াই উৎরাই করতে করতে গুপ্তকাশী, রামপুর হয়ে গৌরীকুণ্ডের পথে যাত্রা করলাম। আমরা নীচের উৎরাই পথে ক্রমশই নেমে চললাম। কিছুদূর অগ্রসর হতে বাম দিক থেকে আসা বাসুকি-গঙ্গার কলকল ধ্বনি শুনতে পেলাম। বাসুকি গঙ্গার ওপারে বিশালকায় ধূম্র পাহাড়। তার পাশ হতে দুধ-গঙ্গা মিশ্রিত মন্দাকিনী শ্বেতধারা প্রচণ্ড নিনাদে বাসুকি-গঙ্গার সঙ্গে মিলিত হয়েছে।

পুল পার হয়ে মন্দাকিনীর ধারে ধারে ক্রমাগত চড়াই পথে উঠে গৌরীকুণ্ডে পৌঁছলাম। এখানে তিনটি কুণ্ড এবং প্রত্যেক কুণ্ডে গোমুখ দিয়ে জলধারা বাইরে বেরিয়ে আসছে। কুণ্ড ছাড়াও তপ্তকুণ্ড আছে, পাশেই গোরক্ষনাথ মহাদেব ও পার্বতীদেবীর মন্দির। তৃতীয় কুণ্ডের নাম বিষ্ণুকুণ্ড। গৌরীকুণ্ডে স্নান করে মহাদেবের পূজা করে এক বৃদ্ধ দোকানদারের অনুরোধে তাঁরই দোকানের উপরের ঘরে আশ্রয় নিলাম।


কোন প্রকারে রাত্রি যাপন করে পরদিন সকালে সাড়ে সাত মাইল দূরস্থ কেদারের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। ডানদিকে মন্দাকিনীর নিরন্তর কল-কল শব্দ কানে বেজে চলেছে। প্রথমে জঙ্গল চটী তারপর রামবাড়া চটী অতিক্রম করতেই চোখের সামনে রজত-গিরির শ্বেত সৌন্দর্য ফুটে উঠল।


হিমগিরির এই শুভ্র তুষারাচ্ছাদিত স্থানে যোগিজন-বাঞ্ছিত দেবাদিদেব স্বয়ম্ভূ কেদারনাথ দর্শনের জন্য এক নিমেষে ছুটে যেতে ইচ্ছে হল। কিন্তু এই দুর্গম পথের শেষ কোথায়? লোকালয়হীন দুরধিগম্য পর্বতের চড়াই উৎরাই পথে কোথাও জঙ্গল, কোথাও নদী, কোথাও বা তুষারের চির পিচ্ছিল পথ। বিরাট বিশাল নব নব প্রকৃতি বৈচিত্র্যের মাঝখানে বিচিত্ররূপী লীলাময় মহাদেবের অবস্থান।

দু'তিনটি ঝর্ণা পার হবার পর দেখলাম আমাদের যাত্রাপথের উপর অবিশ্রান্ত বৃষ্টি ধারার মত একটি ঝর্ণা ঝরে পড়ছে। লাঠিতে ভর করে ভিজতে ভিজতে অতি সন্তর্পনে তা পার হলাম। মাঝে মাঝেই চলার পথের ধারে জমে রয়েছে স্তুপীকৃত তুষার-রাশি।

পথ ক্রমশ এঁকে বেঁকে চড়াই পথে উত্তরাভিমুখে অগ্রসর  হয়েছে। যতই অগ্রসর হচ্ছি ততই তুষার-ক্ষেত্রের ব্যপ্তি বেড়ে চলেছে। সমস্ত পাহাড় জুড়ে শুভ্র সুন্দর উজ্জ্বলতা। এখানের নতূনত্ব হল যে এখানকার দক্ষিণভাগের লম্বা পাহাড়টি তুষার-মণ্ডিত তবে তাতে উঁচু-নীচু অগণিত শৃঙ্গদেশ নেই।

কিছুটা হাঁটার পরই দূর হতে যখন সেই আকাশ-চুম্বী, ঝলমল সৌন্দর্য্য- মণ্ডিত সুবিশাল রজতগিরি চিত্র-বিচিত্র রূপে চোখের সম্মুখে হঠাৎ ঝলসিয়ে উঠল, সঙ্গে সঙ্গে সেই অমল-ধবল সৌন্দর্য্যের মাঝখানে হিমগিরির চির পবিত্র পীঠে গঠন শৈলী, স্বাতন্ত্র্য ও মাধুর্য্যে অনবদ্য কেদারনাথের সুশোভন মন্দির দৃষ্টিগোচর হল।

তখন আনন্দ অধীর চিত্তে সেদিকেই দ্রুত হাঁটতে লাগলাম, মন আনন্দে ভরে উঠল। মনে হল, পৃথিবীর ধূলি-ধূসরিত বাসনা-পঙ্কিল স্থান যেন অতিক্রম করে সেই মুনি-দেব-গন্ধর্ব বাঞ্ছিত স্বর্গের সৌন্দর্য্য-নিকেতনে উপস্থিত হয়েছি। চারদিকে যেন বিরাজ করছে স্বর্গীয় পবিত্রতা ও চিরমধুর শুচিতা।

বেলা দেড়টা নাগাদ দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের অন্যতম কেদার-তীর্থে উপস্থিত হলাম। মন্দিরের চত্বর বেশ উঁচু। মহিষের পৃষ্ঠদেশরূপী পিরামিডধর্মী কেদারনাথ। গোটা গায়ে ঘি-এর প্রলেপ। প্রশান্ত ভাব-গম্ভীর পরিবেশ সারা মন্দিরময়।

মন্দিরকে ঘিরে বহু ধর্মশালা ও যাত্রী-নিবাস দৃষ্টিগোচর হল। এমন সময় একজন আমারই সমবয়সী পাণ্ডা দৌড়ে এসে আমাকে নিয়ে বিকানীর মহারাজার ধর্মশালায় উপস্থিত হল। থাকার ব্যবস্থা ভালই। কিছুক্ষণ পরে সে গরম গরম পুরী, সব্জী ও দুধ নিয়ে হাজির। তার আথিতেয়তায় আমি মুগ্ধ হলাম। খাওয়ার পর আমি পাণ্ডার সঙ্গে কেদার-তীর্থ দর্শনে বের হলাম।

উত্তরদিক হতে মন্দিরের পশ্চিমদিকে মন্দাকিনী কুলুকুলু রবে নীচের দিকে বয়ে চলেছেন। দু'ধারের শুভ্র উজ্জ্বল স্তূপীকৃত বরফ রাশি মন্দাকিনীকে অধিকতর মহিমামণ্ডিত করে তুলেছে। এই অমল-ধবল তুষার-বেষ্টিত মন্দাকিনীকে স্বর্গের ধারা বলেই মনে হচ্ছে। পূর্বদিক হতে আগত সরস্বতী নদী দক্ষিণাভিমুখী হয়ে মন্দাকিনীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। পশ্চিমদিকের পাহাড় হতে দুধ-গঙ্গা নেমে এসেছে। পাহাড়ের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে পাহাড়ের শৃঙ্গদেশে এক ভৈরব-মূর্তি বিরাজ করছেন। দুধ-গঙ্গা, মধু-গঙ্গা, স্বর্গদুয়ারী ও সরস্বতীর মিলন ঘটেছে মন্দাকিনীর সলিলে। দেখে মনে হয় কেদার পাহাড় যেন উপবীত ধারণ করেছে।


To be continued......