Thursday, January 19, 2012

খাড়েশ্বরী মহারাজঃ---


......বেলা অনেকখানি বেড়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে, কেননা প্রায় পাঁচটা বাজতে চলল, এখনও সূর্য সম্পূর্ণতঃ অন্ত যায় নি। এখনও পথঘাট, পাহাড়, পাহাড়ের গাছপালা সব স্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছি। অবশেষে গুলজা গ্রামে এসে পৌঁছে গেলাম।

ছোট ছোট ছেলেরা একটা খেলার মাঠে খেলা করছিল ছোট একটা বল নিয়ে।একজন লোক তাদেরকে খেলা ছেড়ে ঘরে ফিরতে তাড়া দিচ্ছে---'অব বস্‌ করো জী। খেল্‌ ছোড়কে ঘর মে চলো।' খেলা ছেড়ে ঘরে ফেরাই ত আসল কথা, লাখ কথার এক কথা। একবার একটি ধোপা মেয়ে তার বাবাকে বলছিল---'বেলা গেল, বাস্‌নায় আগুন দাও'--- সেই কথা শুনেই লালাবাবুর মনে তীব্র বৈরাগ্যের উদয় হল, তিনি সঙ্গে সঙ্গে অগাধ ঐশ্বর্য ত্যাগ করে বৃন্দাবনে গিয়ে ভজনে ডুবে গেলেন। আমি ত আর লালাবাবু নহ, কাজেই ছেলেদের প্রতি লোকটির উক্তি যতই গভীর অর্থবহ হোক না কেন, আমার মনে ভাবান্তর ঘটল না। আমার এখন রাত্রির জন্য আশ্রয় প্রয়োজন, বিশ্রাম প্রয়োজন।

লোকটির কাছে তারই সন্ধান চাইলাম। তিনি বললেন--- আধা ঘণ্টা চলনেসে আপ্‌ গোদারিয়া সংগম গুলজারীঘাটমেঁ পঁহুজ যায়েগা।উধর মন্দির ভি হ্যায়,পরিক্রমাবাসীয়োঁ কে লিয়ে আচ্ছা ইন্তেজান ভি হ্যায়।

---'ইধর কোঈ মন্দির নেহি হ্যায়? হম্‌ বহোৎ থক্‌ গিয়া।'

---হমারা ছোটিসি মহল্লামেঁ মন্দির নেহি হ্যায়, কেঁওকি গুলজারীঘাট বহোৎ নজদিগ্‌ হ্যায়, উধর শিউজীকা আচ্ছা মন্দির হ্যায়, হম্‌লোগ্‌ উধরই পূজা করতা হুঁ। তব্‌ চলিয়ে ঠাড়েশ্বরী মহারাজকা পাশ, উনকা কোঠিমেঁ জাগাহ্‌ মিলেগা।মিনিট তিনেক হেঁটে নর্মদার ধারে ঠাড়েশ্বরী মহারাজের কাছে পৌঁছে গেলাম।

দেখলাম, একটি আমলকী গাছের কাছে এক ছয় ফুট দীর্ঘদেহী সন্ন্যাসী দাঁড়িয়ে আছেন।ছোট ছোট চারাগাছকে গরু ছাগলের গ্রাস হতে রক্ষা করার জন্য কাঠ বা বাঁশের যেমন কুণ্ডল দিয়ে ঘিরে রাখা হয় সেইরকম এক কাঠের কুণ্ডলের মাঝখানে ঠারেশ্বরী মহারাজ দাঁড়িয়ে আছেন।

নগ্ন গাত্র, কোমরে জড়ানো আছে এক টুকরো গৈরিক বস্ত্র।অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন নর্মদার দিকে।মৃদু কণ্ঠে জপ করে চলছেন সেই একই নাম, মহানাম-রেবা, রেবা, রেবা। আমলকী গাছের ডালে আকাশ প্রদীপের মত আট দশটা প্রজ্জ্বলিত প্রদীপ ঝুলছে।সেই আলোতে দেখলাম-পাশাপাশি দুটি কুটির আছে।

আমার সঙ্গী লোকটি 'গোড় লাগি মহারাজ' বলে সশব্দে যুক্তকরে প্রণাম করতেই সেই শব্দ শুনে কুটির থেকে একজন গেরুয়াধারী বেরিয়ে এলেন। তিনি লোকটির কাছে আমি আশ্রয়প্রার্থী জেনে আমাকে দ্বিতীয় কুটিরটিতে থাকবার ব্যবস্থা করে দিলেন।কথায় কথায় জেনে নিলাম এই সাধুর নাম বিন্ধ্যেশ্বরী, তিনি ঠারেশ্বরী মহারাজের শিষ্য এবং সেবক।

ঠাড়েশ্বরী মহারাজকে কেউ কেউ খাড়েশ্বরী মহারাজ বলেও সম্বোধন করে থাকেন।

এই গুলজা গ্রামে নর্মদাতীরে তিনি এইরকম দাঁড়ানো অবস্থাতেই কুড়ি বছর ধরে তপস্যা করছেন।কেউ কখনও তাঁকে এইরকম দণ্ডায়মান অবস্থা ছাড়া বসা বা শোয়া অবস্থায় দেখে নি, দিবারাত্র সঙ্গে থেকে তিনিও দেখেন নি।ঐ রকম অবস্থাতেই তিনি শৌচাদি এবং ভোজন কর্মাদি সেবকের সাহায্যে করে থাকেন।

বিন্ধ্যেশ্বরীজীর সঙ্গে নিতান্ত প্রয়োজনে দু'একটা কথা ছাড়া আর কারও সঙ্গে কোন কথাবার্তা বলেন না।শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা, সর্ব ঋতুতে তিনি নগ্নগাত্রে দাঁড়িয়ে থেকে নিরন্তর রেবা মন্ত্র জপ করে চলেছেন।
বিন্ধ্যেশ্বরীজী অত্যন্ত শ্রদ্ধাপ্লুত কণ্ঠে সাগ্রহে আমাকে জানালেন---মেরে গুরুজীকে পাশ সবকিছু ঋদ্ধি-সিদ্ধি হ্যায়। দেহাত সে বহোৎ আদমী ইধর আতা হৈ মাথা টেকতা হৈ ঔর চলা যাতা হৈ।ব্যাস্‌, ইসীসে উনলোগোঁকা দিল্‌কা বাসনাকি পূর্তি হো জাতা হৈ। অপ্‌ ইধর আজ আয়েঙ্গে, এবাত্‌ পহেলেসে উনোনে বাতা দিয়া হৈ। ইসি ওয়াস্তে এ কামরা ভি আপ্‌কো লিয়ে খালি করকে রাখ্যা হৈ।

এই কথা শুনে আমি খুবই অবাক হলাম। বিন্ধ্যেশ্বরীজীকে জিঞ্জাসা করে আরও জেনে নিলাম যে এই দুটি কুটির গুণ মুগ্ধ গ্রামবাসীরাই তৈরী করে দিয়েছেন। একটিতে তিনি থাকেন, কুটিরের বারান্দাতে রান্নার কাজ হয়, অপর কুটিরটিতে ক্কচিৎ দু'চারজন আগন্তুক অতিথি এলে তাঁরা থাকেন।

বিন্ধ্যেশ্বরীজী এক হাঁড়ী গরম জল দিলেন। ভাল করে মুখ-হাত ধুয়ে বিছানা পেতে শুয়ে পড়লাম।ক্ষুধায় পেট চুঁই চুঁই করছে, ক্ষুধার চোটে বিছানায় উঠে বসলাম, পেট ভরে জল খেয়ে আবার শুলাম।সারাদিন পথ চলার পরিশ্রমে ঘুম আসতে দেরী হল না। কিন্তু শেষ রাত্রে ঘুম ভঙে গেল।কুটিরের দরজা খুলে পা টিপে টিপে বাইরে এসে আমলকী তলায় গিয়ে ঠারেশ্বরী মহারাজ কি করছেন,তা দেখবার আগ্রহ বা দুষ্ট বুদ্ধি মাথায় এল।গিয়ে দেখি তিনি দাঁড়িয়ে আছেন, গাছের ডালে প্রদীপগুলো নিভে গেছে।কম্বল মুড়ি দিয়েও কনকনে ঠাণ্ডায় ঠক ঠক করে কাঁপছি, আর মহাত্মা নগ্নগাত্রেই তাঁর তপস্যা করে চলেছেন। একেই বলে উগ্র তপস্যা।নর্মদামাতার কৃপা এঁরা পাবেন না, ত কারা পাবেন? চিন্তা করতে করতে কুটীরে এসে ঘুমিয়ে পড়লাম।

ঘুম যখন ভাঙল, তখন অনেক বেলা হয়ে গেছে।দেখলাম, ঠারেশ্বরী মহারাজ সেই একইভাবে দণ্ডায়মান।বিন্ধ্যেশ্বরীজীর কাছে জিঞ্জাসা করে জানতে পারলাম যে আজ ২রা ফাল্গুন অর্থাৎ গতকাল ১লা ফাল্গুন হোসেঙ্গেবাদ জেলায় এসে পৌঁছেছি।পরিক্রমা শুরু করা থেকে চারমাস কেটে গেছে।শৌচাদি সেরে স্নান করতে গেলাম।স্নান তর্পণাদি সেরে আসার সময় দেখি প্রায় দশজন ভক্ত ভেট নিয়ে ঠারেশ্বরীজীকে প্রণাম করে নিজেদের আপন আপন সমস্যার কথা নিবেদন করছেন। মহাত্মা কোন উত্তর দিচ্ছেন না, নির্নিমেষনেত্রে নর্মদার দিকে তাকিয়ে আছেন। কিন্তু নিজেদের কথা নিবেদন করেই ভক্তদেরকে সন্তুষ্ট দেখছি, দরবারে যখন পেশ করা হয়েছে তখন তাঁদের অভীষ্ট সিদ্ধি হবেই এই অবিচলিত নিষ্ঠা ও বিশ্বাস তাঁদের চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। 

বিন্ধ্যেশ্বরীজী ভক্তদের আনা ফলমূল, বাজরা, জোয়ার, দুধ ইত্যাদি তিন জনের উপযোগী রেখে দিয়ে বাকী সব প্রসাদ হিসাবে বিলিয়ে দিলেন।নর্মদাশ্রয়ী সাধুর কোন বস্তু সঞ্চয় করে রাখতে নাহ, সেই বিধি কঠোরভাবে এখানে মানা হচ্ছে। আমি গোদারিয়া নদীর সংগম গুলজারী ঘাট দেখতে যাবো, বিন্ধ্যেশ্বরীজী আমার সঙ্গে যেতে পারবেন কিনা জিঞ্জাসা করায় তিনি বললেন,----দুপহরমেঁ ভোজনকে বাদ আপ্‌কা সাথ চলুঙ্গা।

মধ্যাহ্নের পূর্বেই ভোগ প্রস্তুত হয়ে গেল। বিন্ধ্যেশ্বরীজী অত্যন্ত যত্নসহকারে তাঁর গুরুদেবকে রুটি, ফল, দুধ একটু করে মুখে তুলে দিলেন, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তিনি তা ভোজন করলেন, কুটিরের দ্বারে বসেই আমি সব লক্ষ্য করলাম। ভোজন পর্বের সময়েও দেখলাম, দৃষ্টি তাঁর নর্মদার দিকেই ন্যস্ত।একইভাবে ক্রমাগত দাঁড়িয়ে থাকলে যে কোন লোকেরই দু'পা আসাড় হয়ে যাবার কথা, ফুলে যাবার কথা, কিন্তু সত্তর বৎসর বয়স্ক ঠাড়েশ্বরী মহারাজের শরীর বয়সের তুলনায় অনেক সতেজ, অনেক সুস্থ এবং অনেক বলিষ্ঠ বলে মনে হল।খাওয়াদাওয়ার পর দুজনেই বেরিয়ে পড়লাম গুলজারীঘাটের উদ্দেশ্যে। 

To be Continued..........

Sunday, January 1, 2012


প্রলয় জলে মগ্ন ছিল বিশ্বজগৎ যবে, আদিম যুগে সৃষ্টি হবার আগে,
সেদিনের সেই অতল তলে দেখনা ভেবে, কারা ছিল গো জড়িয়ে অনুরাগে?
সেদিনের সেই সাগরপুরে সুপ্তিগড়ে যবে, সুপ্ত ছিলাম মুক্তা মুকুট পরি,
কেই বা সেদিন রাখল বুকে চেপে, চতুর্বাহুর আলিঙ্গনে ধরি।
জন্মে জন্মে যুগে যুগে লক্ষ জনম ধরে ঘুরেছি তো স্বর্গ-মর্ত্ত্য-সপ্তলোকের দেশে
সে সব জন্মে কেই বা বল আনলো মোদের মাটির মায়ের কোলে, যত্নে ভালবেসে?
কে আমাদের চলতে শিখায় আলোর পথে তুচ্ছ করে মরণ শতবার,
এর পরও কি বলতে হবে মাতা পিতাই সুধার সাগর, তাঁদের চরণ সকল পূজার সার?

https://www.facebook.com/pages/tapobhuminarmada/454528151310191