Tuesday, January 21, 2014

"দেবভূমি বদ্রী" ------


Cont (Last) ......


সকাল ৫ টায় ঘুম ভাঙল। তিনজনে  ঠিক ৬ টার সময় পাণ্ডুকেশ্বর ছেড়ে এগিয়ে চললাম। পৌনে ২ ঘণ্টার মাথায় পড়ল লামব্‌গড়। লামব্‌গড় ছেড়ে যতই যেতে লাগলাম ততই শৈত্যপ্রবাহ বাড়তে লাগল। গ্রীষ্মকাল এসে পড়লেও পাহাড়গুলি বরফের মুকুট পরে আছে। বোধ হয় মার্তণ্ডদেব পৃথিবীর আরো কাছে এলে তারা সসম্মানে তখন তাদের মুকুট খুলবে। লামব্‌গড় থেকে হনুমান চটি চার মাইল। এতটা পথের মধ্যে শুধু এক জায়গায় পাঁচ সাত খানা চালা ঘর ছাড়া কিছুই চোখে পড়ল না। মানুষ, পশু, পক্ষী, কাক পর্যন্ত এখানে বিরল। প্রকৃতি এখানে অপূর্ব সুন্দরী! পথ ক্রমশই ঊর্দ্ধগামী। দৈহিক কষ্ট যতই বাড়তে থাকে, জাগতিক বস্তু চিন্তা যেন ততই উবে যেতে থাকে।


চারদিকেই নয় দশ হাজার ফুট পাহাড়ে বেড়া, চির, কেলু ও ফার্ণ-এর ভিড়। পথের বাঁ দিকে নীচু দিয়ে অতি বেগে বয়ে যাচ্ছে অলকানন্দ। নদীটি প্রাণময়ী, জীবন্ত। আমরা চলেছি উপরে, নদী নীচে। পর্বত যেন ধ্যানমগ্ন ঋষির মত শান্ত, সমাহিত হয়ে আমাদের নিরীক্ষণ করছে। অলকানন্দা কোলাহলময়ী। সে কোথাও পাহাড়ের বুক থেকে লাফিয়ে পড়ছে, কখনও শিলাখণ্ডের তলায় লুকাচ্ছে, আবার কোথাও বা আবর্তের সৃষ্টি করছে। নেচে গেয়ে কলহাস্যে অপ্সরা যেন ধ্যানমগ্ন ঋষির ধ্যান ভাঙাবার চেষ্টা করছে।


গরমের হাওয়া লেগে বেশীর ভাগ বরাঁশ ফুল ঝরে গেলেও, স্থানে স্থানে তাদের সে কি উজ্জ্বল সমারোহ! পাহাড়ের বুকের সবকিছু যখন বরফের চাদরের নীচে ঘুমায় তখন গাঢ় রক্তবর্ণের বরাঁশই শুধু জেগে থাকে। লিচু পাতার মত ছোট এর পাতা। কলকে ফুলের মত উঁচু গাছের বুক ভর্তি টকটকে লালফুল --- বরাঁশ। এই ফুল সর্বরোগহর। বরাঁশ কেবল ফুল নয়, এ হল বদ্রীনারায়ণের বর, প্রসাদ। 


একটা চির গাছের কুঞ্জ পার হলাম। নদী এখন অনেক নীচ দিয়ে যাচ্ছে। তার গর্জন প্রায় শোনা যাচ্ছে না। বন এখানে বেশ ঘন। কোথা থেকে কোনো লুকানো ফুলের একটা মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসছে। সেই গন্ধে শরীরের সমস্ত ক্লান্তি ধুয়ে মুছে শরীরকে সতেজ করে তুলছে। সেই ফুলের সৌরভ মহাআনন্দের আর সেই আনন্দলোকের অনুভূতি অবিস্মরণীয়।


জানার মাঝে অজানার প্রভাব, ঞ্জানের সঙ্গে অঞ্জতার মিশ্রণে, অঞ্জতা ও আনন্দের অবকাশ ও স্পর্শেই সৃষ্টি হচ্ছে, সৃষ্টি চলেছে। সেই ঞ্জানাতীত, বোধাতীতকে অপেক্ষা করেই সব ঘুরছে। এই ঘূর্ণনের চক্রটিকে যিনি ধারণ করে আছেন, তিনিই বিষ্ণু, তিনিই বদ্রীনাথ, তিনিই ওই হঠাৎ আসা আনন্দের আসল কারণ, ফুলের গন্ধটা নয়।


মাইল খানিক যাবার পর যতই বদ্রীক্ষেত্রের কাছাকাছি হচ্ছি ততই দৈহিক কষ্ট তীব্রতর হতে লাগল। মনের গতি প্রকৃতিও যেন সুক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম হয়ে উঠল।আমরা নৃত্য-চঞ্চলা অলকানন্দার গা ঘেঁসে যেতে লাগলাম। এবার মনে হল না অলকানন্দা বিঘ্নোৎপাদিকা বরং জলকণাগুলি যেন মাথা তুলে বলছে --- দাঁড়িও না। আমিও দাঁড়াচ্ছি না তুমিও দাঁড়িয়ো না, এগিয়ে চলো  গন্তব্যের দিকে।


বেলা ১১টা নাগাদ হনুমান চটিতে পৌঁছালাম। এটাই এ পথের শেষ চটি। দোকান ও ধর্মশালাগুলিতে লোক নেই বললেই চলে। সঙ্গী ছেলেটি আমার ও সাধুজীর জন্য এক লোটা গরম চা নিয়ে এল। চা খেয়ে প্রাণ জুড়াল। হনুমান চটিতে আধঘণ্টা কাটিয়ে এগোতে লাগলাম।


এখান থেকে রাস্তা আরো ঊর্ধমুখী এবং চড়াই বেশ কষ্টকর। দশ মিনিট হাঁটি আর বিশ্রাম নেই। প্রতি মুহুর্তে মনে হবে আর এগিয়ে কাজ নেই। সমতলের মানুষদের পক্ষে এই চড়াইতে শ্বাসকষ্ট হওয়া স্বাভাবিক। একটা বাঁক ঘুরতেই এক অভুতপূর্ব দৃশ্য চোখে পড়ল। সমস্ত পথটাই তুষারবৃত তাতে সুর্যের আলো পড়ে এক জায়গায় ইন্দ্রধনুর সৃষ্টি করেছে। এই বরফ ঢাকা পথ কিভাবে পার হব বলে ভয় হলেও কিন্তু তা আমার পথ রোধ করতে পারল না। দিব্যি বরফ মাড়িয়ে এগিয়ে চললাম। দূর থেকে বরফ পিচ্ছিল বলে মন হলেও তার বেশীর ভাগই আলগা বালির মত। মনে এক বিচিত্র অনুভূতির সৃষ্টি হল। পথের ধারে একটা ঝোরায় জল খেয়ে পাথরে বসলাম। দেখলাম পথ আরোও উঁচুর দিকে চলেছে।


সঙ্গী  দু'জনকে জিঞ্জাসা করলাম --- মন্দির আর কিতনা দূর? দুজনেই সমস্বরে বললেন --- নজদিক্‌। মনে মনে উদীপ্ত হয়ে উঠলাম। শরীরের সমস্ত শক্তি একত্রিত করে হাঁটতে শুরু করলাম। আরো ২ঘণ্টা হেঁটে অর্ধ মূর্ছিত অবস্থায় এক উপলখণ্ডের ধারে পৌঁছাতেই নজদিকের নাগাল পেলাম! বদ্রীনারায়ণজীর মন্দির ও বসতি দৃষ্টিগোচর হল। বাবার আদেশ পূর্ণ করতে পারার আনন্দে আমার শরীর- মন উদ্বেল হয়ে উঠল। এই যাত্রার যে কষ্ট তা মুহুর্তে দূরীভূত হল।


মন্দিরের নীচেই তপ্তকুণ্ড। জল প্রায় ফুটন্ত গরম। অবগাহন স্নানে পথের সকল ক্লান্তি যেন মুহূর্তে জুড়িয়ে গেল। তপ্তকুণ্ডের ধার থেকেই মন্দিরের সিঁড়ি উঠেছে। মন্দিরে প্রবেশ করে মূর্তির পাদদেশে মাথা ছোঁয়ালাম। সাধুজী আমাকে উদ্দেশ্য করে অনর্গল বলে চলেছেন --- ৩১৫৫ মি উচ্চে বিষ্ণুক্ষেত্র বদ্রীনারায়ণ।


এস্থানে দেবী লক্ষ্মী বদরী অর্থাৎ কুল বৃক্ষরূপে ছত্রাকারে ছায়া দেন ধ্যানমগ্ন নারায়ণকে। মন্দিরের সামনে শ্বেত-শুভ্র গাড়োয়াল-রাণী নীলকণ্ঠ পাহাড় (৬৫৯৫ মি)। দু'পাশে নর ও নারায়ণ পর্বত। ৮ম শতকে আচার্য্য শঙ্কর তপ্তকুণ্ডের কাছে গরুড় গুম্ফায় প্রতিষ্ঠা করেন ভগবান বিষ্ণুকে। পরে গাড়োয়াল রাজ বর্তমান মন্দির নির্মাণ করে দেবতাকে প্রতিষ্ঠিত করেন। ১৩ শতকে মন্দিরের চূড়াটি সোনায় মুড়ে দেন রাণী অহল্যাবাঈ। ১৮০৩ এর ভুমিকম্পে বিধ্বস্থ মন্দিরের সংস্কার করেন জয়পুরের মহারাজা। জনশ্রুতি হল মূল মন্দিরটি নির্মাণ করেন রাজা পুরুর বা আর ভাস্কর্য স্বয়ং বিশ্বকর্মার।


মন্দিরটি তিনভাগে বিভক্ত --- গর্ভগৃহ, দর্শনমণ্ডপ, ও সভামণ্ডপ। উঁচু বেদীতে মণিমুক্তো ও অলঙ্কারে ভূষিত পদ্মাসনে কষ্টিপাথরের চতুর্ভুজ বিষ্ণু। তাঁর এক হাতে সুদর্শন চক্র, দ্বিতীয় হাতে পাঞ্চজন্য শঙ্খ, তৃতীয় হাতে কৌমদকী গদা, চতুর্থ হাতে পদ্ম, মস্তকে রত্নখচিত মুকুট, শিরোপরি স্বর্ণছাতা। কেয়ুরে কুণ্ডলে কঙ্কণে অপরূপ শোভা। বিষ্ণুর বামে নর ও নারায়ণ, ডানে কুবের। সামনে রূপোর গরুড় করজোড়ে সম্ভাষণরত। পূজারী হলেন রওয়াল নাম্বুদ্রি সম্প্রদায়।


পুজো সেরে মন্দির থেকে বেরোতেই ঝুরঝুর করে জমাট কুয়াশার মত অজস্র বরফের টুকরো আমাদের উপর পড়তে লাগল। মিনিট তিন-চার পরে বরফ পড়া বন্ধ হয়ে গেল।


আমি  সঙ্গী ছেলেটিকে জিঞ্জাসা করলাম --- অলকানন্দার জল কমে। সে জানাল --- গরম এলে অলকানন্দায় যেই জল কমে, অমনি বরফ গলে নদীকে পুরো করে দেয়। এখানের এমনই মজা যে, সব চূড়ায় সব বরফ গলবার আগেই নতুন বরফ আসার সময় হয়ে যায়।


সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে ওঠার আগেই সাধুজীর কুঠিয়াতে আস্তানা গাড়লাম। ঐ তুষারমণ্ডিত সন্ধ্যারাগ রঞ্জিত অলকানন্দার শোভায় কত শান্তি, কত পবিত্রতা। সকাল হতে কুঠিয়া থেকে বেরিয়ে তপ্তকুণ্ডে স্নান করতে গিয়ে দেখি আর একজন সাধু কুণ্ডের জলে হাত-মুখ ধুচ্ছেন।


মিটিমিটি  হেঁসে আমাকে প্রশ্ন করলেন --- দর্শন হুয়া।

উত্তর দিলাম --- হুয়া।
--- ক্যায়া মাঙ্গা।
--- কুছ নেহী।
--- তব কেঁও আয়া?
--- পিতাজীকে আদেশ পালন করনে কে লিয়ে ঔর ভগবানকে বাসস্থান দেখনে কে লিয়ে।
আমার কথায় সাধুর ভাবান্তর হল। চোখ দুটি চকচক করে উঠল।তিনি উঠে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন --- তেরা দর্শন সার্থক হুয়া। সাধুকে প্রণাম করে পুনরায় বদ্রীনাথজীকে দর্শন করে, হিমালয়ের দেবতাকে প্রণাম করে ফিরে চললাম জোশীমঠে।

https://www.facebook.com/pages/tapobhuminarmada/454528151310191

Monday, January 20, 2014

"দেবভূমি বদ্রী" ------


............ ১৯৪৭ সালের গ্রীষ্মের ছুটিতে প্রথম বাবা আমায় (লেখকে) হিমালয়ের পাদদেশে হরিদ্বার-হৃষিকেশ-কেদারনাথ-বদ্রীনাথ দর্শনে পাঠিয়েছিলেন। বাবা বলতেন --- এতদ্‌ঞ্চল হল মর্ত্যভূমের স্বর্গ, দেবতার বাস। ফুলে ফুলে ভরা সবুজে ছাওয়া এ যেন স্বর্গের নন্দনকানন! সাধু-সন্তের লীলাভূমি হিমালয়ের হিম সৌন্দর্য, নিবিড় অরণ্যানী, ঝরণার সুমধুর তান তোকে মোহিত করে দেবে।


যথাসময়ে ডুন এক্সপ্রেসে চড়ে শিবালিক পাহাড়ের পাদদেশ হতে ৩০০মি উচুঁতে হরির দ্বার হরিদ্বারে পৌঁছালাম। দেবভূমি হিমালয়ের প্রবেশদ্বার পুরাণের মায়াপুরী হরিদ্বারে (অতীত নাম কপিলাস্থান) অজস্র মন্দির, আশ্রম, পুণ্যতোয়া গঙ্গা এবং জয় জয় গঙ্গা মাতা ধ্বনি ও ভজনের তালে তালে গঙ্গার স্রোতে প্রদীপের ভাসান আমি প্রাণ ভরে উপভোগ করে চতুর্থ দিনে ব্রহ্মকুণ্ডে স্নান করে সমবেত পাণ্ডাদের ঐকতান ও মন্ত্রের স্পষ্ট উচ্চারণে মধুস্রাবী গঙ্গা বন্দনা শুনতে শুনতে উত্তরাখণ্ডের শ্রেষ্ঠ তীর্থ হরিদ্বার ত্যাগ করে যাত্রা করলাম হৃষীকেশের পথে।


হৃষীকেশ হৃষীকেশের প্রিয়-নিকেতন। হরিদ্বার যদি হয় তীর্থস্থান তবে হৃষীকেশ হল তার সাধনস্থান। হরিদ্বার তীর্থ হলেও শহর।হৃষীকেশ হল তপোবন। দিন নেই, রাত্রি নেই অবিশ্রান্ত ভাবে পতিতপাবনীর কলনাদিনীর আহ্বান ধ্বনির মাঝে হিমালয় ধ্যানমগ্ন তাপসের ন্যায় অটল অচঞ্চল। একমাত্র এখানেই গঙ্গা ও হিমালয়ের পূর্ণ মূর্তি দেখতে পাওয়া যায়। আত্মোপলব্ধির শ্রেষ্ঠস্থান এই হিমালয়। হৃষীকেশে একদিন কাটিয়ে লছমনঝোলা হয়ে যাত্রা করলাম বদ্রী নারায়ণের পথে।


পথের বৈচিত্র্য ও সৌন্দর্য অতুলনীয়। বিশাল সুউচ্চ পর্বতের প্রাচীর ঘেরা, নির্জনতার রাজ্য, হিমালয়য়ের অন্ত:পুরে প্রবেশকারীর মন আপনা থেকেই কেন্দ্রীভূত হয়ে আসে এক নির্দিষ্ট চিন্তায়। চিত্তের ভাবনা ও বিক্ষেপ কমে আসে। সংসারের ক্ষুধিত- তৃষিত কোলাহল কঠিন পর্বতাবরণ ভেদ করে এই শান্তিধামে প্রবেশ করতে পারে না। নীচতার ধূলি, হিংসা দ্বেষের জ্বালাময় বায়ুপ্রবাহ এই পবিত্র তীর্থকে কলুষিত করতে পারে নি। বিলাস প্রিয়তা এবং পার্থিব লালসার এখানে সম্পূর্ণ অভাব। এখানে উপস্থিত হলেই বহু প্রাচীন নিষ্কলঙ্ক, মঙ্গল কিরণানুরঞ্জিত শান্ত জীবনের এক সুকোমল পবিত্র স্মৃতি হৃদয়ে পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। হিমালয়ের স্পর্শ মানুষের মনে প্রশ্ন ছড়িয়ে দেয়, উত্তরও দেয় জানিয়ে।


খুব ভোরে উঠে বাসে চড়ে রওনা হলাম ব্রহ্মার তপস্যাক্ষেত্র দেবপ্রয়াগের দিকে। মন্দাকিনী ও অলকানন্দার মিলিত সলিলে গোমুখ থেকে আসা ভাগীরথীর মিলন ঘটেছে দেবপ্রয়াগে। গঙ্গা নামের উৎপত্তিও ত্রিধারার মিলনে দেবপ্রয়াগ।


চড়াই পথের দৃশ্য একেবারে নতূন! যতই উপরে উঠছি, ততই দেখছি পুঞ্জীভূত তুষার রাশি যেন জমে জমে সমগ্র পাহাড়কে ঢেকে ফেলেছে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তুষার- সৌন্দর্য্যের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি পেতে লাগল। চতুর্দিকেই শ্বেতশুভ্র তুষার-কিরীট। মাঝে মাঝে কিছু কিছু দেবদারু, পাইন, চীর। 


প্রকৃতির রাজ্যে একি কেবল বিরাট তুষারের সৃষ্টি! এক রাত্রির বৃষ্টিতে কালো পাহাড় ক্রমশই যেন ছায়াবাজীর মত হঠাৎ একদিনে সাদা হয়ে গেছে। উপত্যকার আশপাশ নিম্নদিকে যতদূর চোখ যায়, পাহাড়ের সর্বত্র যেন শুভ্র বস্ত্রে একেবারে ঢাকা। একদিকে তুষারের এই উঁচু নীচু চমৎকার দৃশ্য, অন্যদিকে পুর্বভাগ থেকে উত্তরভাগ পর্যন্ত অভ্রভেদী তুষার শৃঙ্গের দিকে চোখ ফেরালে স্বর্গের সম্পদ-সুষমাই প্রত্যেককে মুগ্ধ করে দিচ্ছে। 


তুষার-সমুদ্র মন্থন করতে করতে বেলা দশটা নাগাদ পৌঁছলাম শ্রীনগরে। বিকালের দিকে পৌঁছলাম অলকানন্দ ও মন্দাকিনীর সঙ্গমস্থল রুদ্রপ্রয়াগে। অপার্থিব অনুভূতিতে মুগ্ধ হল মন! এখান থেকেই একদিকে গেছে বদ্রীনাথের পথ, অন্যদিকে কেদার ক্ষেত্র। 


বেলা যতই শেষ হয়ে আসছে ততই ভীষণ শীত অনুভূত হতে থাকল। সন্ধ্যার মুখেই ঘন মেঘের সঞ্চার করে বর্ষণ শুরু হল। এই অঞ্চলের মজা হল সূর্য যতই পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়ে ততই যেন প্রকৃতি-রাণীর মুখ গম্ভীর ও ভার হয়ে ওঠে।


বিরাটকায় পাহাড়গুলি একবারেই তুষারমণ্ডিত থাকায়, রৌদ্রকিরণে সর্বদাই যেন চোখের সামনে হীরকের মত ঝলমল করছে। এরূপ অপরূপ বিচিত্র দৃশ্যের মধ্য দিয়ে উৎরাই-এর পথে বাস চলল। বেলা এগারটা নাগাদ পৌঁছলাম কর্ণপ্রয়াগে। অলকানন্দা ও পিণ্ডারী গঙ্গার মিলনস্থান। 


অলকানন্দার প্রচণ্ড গর্জন ও ঝিঁ ঝিঁর একটানা কলতান শুনতে শুনতে কর্ণপ্রয়াগ অতিক্রম করে পৌঁছালাম নন্দ রাজার যঞ্জস্থল নন্দপ্রয়াগে। বদ্রীক্ষেত্রের শুরু এখান থেকে। এরপর এল চামোলী। তারপর পিপলকোঠী, তারপর একে একে গরুড়-গঙ্গা, পাতাল-গঙ্গা অতিক্রম করে বিকাল তিনটা নাগাদ পৌঁছলাম জোশীমঠে।


বাস থেকে নেমেই জোশীমঠের নৃসিংহ মন্দির দেখতে গেলাম। শীতের ৬ মাস যখন বদ্রীনাথের মন্দিরে বরফে ঢাকা থাকে তখন তাঁর পূজা হয় এই নৃসিংহমূর্তিতে। অক্ষয় তৃতীয়ার সময় বদ্রীনাথের মন্দির খোলে। জোশীমঠ থেকে বদ্রীর রাস্তা অত সহজ নয়। বদ্রীনাথ ১১০০০ ফুট। শেষের সাত মাইল চড়াই ঠেলে উঠতে সমতলের মানুষদের দু'দিন লাগে।


হিমালয়ের বিপুল বিশাল বৈচিত্র্যের আকর্ষণে আমার একা একা পথ চলা শুরু। রাস্তাঘাট চিনি না বলে চিন্তা হল। পথে এক পাহাড়ীর সঙ্গে পরিচয় হল। সে বলল, চিন্তার কোন কারণ নেই। এধারে চোর ডাকাত বলতে কিছু নেই। হাঁটা পথ একটাই। সে কিছুদূর পর্যন্ত আমার সঙ্গে এসে পথ দেখিয়ে দিল। 


জোশীমঠের অনেক নীচুতে, খাদের মত একটা জায়গায় দেখা যাচ্ছে নদী। সেই নদীর গা থেকে একটা সরু পথ উঠে পাশের পাহাড়টার মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেছে। পাহাড়ে আড়ালে কি আছে তা দেখার বা জানার উপায় নেই। নিঝুম, নিস্তব্ধ, জনমানবহীন সেই খাদের মধ্যে যে পথের শুরু হল ওই হল বদ্রীধামের পথ। আসল হিমালয়ের স্পর্শ এখান থেকেই শুরু। পাহাড়ী লোকটি ফিরে গেল। 


আমি নামতে লাগলাম, প্রায় একঘণ্টা উতরাই ভাঙ্গার পর নদীর সেই পাড় এল। কিন্তু পাড় বলতে যা বুঝায় তা নেই, আর নদীও একটা নয়। দুই নদীর সঙ্গম হয়েছে। অলকানন্দা ও বিষ্ণুগঙ্গা বা ধবল-গঙ্গার পূত মিলনস্থল বিষ্ণুপ্রয়াগ নাম গ্রহণ করেছে।


বিষ্ণুপ্রয়াগের উপর পুল পার হয়ে পাণ্ডুকেশ্বরের পথ নির্দেশ জানতে চাইলে একজন বলল --- আমার বাড়ী পাণ্ডুকেশ্বর, আমিও পাণ্ডুকেশ্বর যাব। পথে একজন সঙ্গী জুটে গেল। বুঝলাম --- জীবের অসুবিধা হলেই শিব ছুটে আসেন। জোশীমঠ থেকে পাণ্ডুকেশ্বরের দূরত্ব সওয়া আট মাইল। উচ্চতা প্রায় ৩৫০০ ফুট।


ছেলেটি বলল--- সরকারী লোকেরা পাথর ফাটাচ্ছে। মাথায় পাথর পড়ার ভয় আছে। আমাদের সাবধানে দেখেশুনে যেতে হবে। কারণ পায়ে চলার পথটির থেকে দু'তিনশো ফুট উচুঁ দিয়ে মোটর যাবার রাস্তা তৈরী হচ্ছে। রাস্তাটি বদ্রীনাথ পর্যন্ত্য যাবে। দু'বছরের মধ্যে কাজ শেষ হবে। যাত্রীরা হৃষিকেশ হতে বদ্রীনাথ পর্যন্ত সমস্ত পথটা মোটরে যেতে পারেন তার জন্য ও সৈন্য চলাচলের জন্য। শুনলাম বদ্রীনাথ থেকে মাইল পঞ্চাশ দূরেই বসে আছে চীনা সেনা।


ছেলেটি বলল --- মহাভারতে পাবেন, পঞ্চপাণ্ডবগণ অস্ত্র সংবরণ করার অনতিবিলম্বে পীত দস্যুগণ (চীনারা) হানা দেয় ও গোধন হরণ করে। এই চীনা হানাদারদের উৎপাতেই বহু শত বৎসর আগে বদ্রীনাথের পূজারী বদ্রীনাথজীর বিগ্রহ নারদ কুণ্ডের জলে ফেলে দেন। আচার্য্য শঙ্কর যোগবলে মূর্তির অধিষ্ঠান স্থলটি জানতে পারেন এবং মূর্তিটি উদ্ধার করেন।


সন্ধ্যার অন্ধকার নামার আগেই ছেলেটি একটি কাঠের দোতলা বাড়ীতে আমাকে নিয়ে এল। চারদিকে আরও অনেক বাড়ী ও ধর্মশালাগুলি হানাবাড়ীর মত পড়ে আছে। ছেলেটি আমাকে অপেক্ষা করতে বলে উধাও হয়ে গেল। এমন সময় চোখে পড়ল বাড়ীটির রোয়াকের উপর কম্বল গায়ে একজন বসে। কাছে যেতেই লোকটি আমাকে প্রশ্ন করল --- আপ কঁহা যাইয়েগা? 


বললাম --- বদ্রীনাথজী। আপ? সাধুজী কিছুক্ষণ নির্বাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন --- বাঙালী! বেশ। বদ্রীনারায়ণের দরজা যতদিন খোলা থাকে ততদিন ঐখানেই থাকি। বাকী দিন গুলি নিচে ঘুরে বেড়াই। কিছুক্ষণ পর ছেলেটি চাল, ডাল, আলু, তেল, নুন নিয়ে এসে নৈশভোজনের ব্যবস্থা করল। তিনজনের নৈশ ভোজন সমাধা হল। নানা আলোচনার পর শুয়ে পড়লাম।



To be continued......

Monday, January 6, 2014

"পিতরৌ" হী পরমং তপঃ ---


Cont (Last) ......

তৈত্তিরীয়  আরণ্যকের  "মাতৃদেবো  ভব,  পিতৃদেবো  ভব"  মন্ত্রে ঋষিরা  স্পষ্ট  বলেছেন --- পিতা  মাতাকে  দেবতা  বলে  মানবে, প্রতিদিন  তাঁদের  সেবা  যত্ন  করবে। পিতৃপূজা  বা  মাতৃপূজা সর্বতোভদ্র, সর্বকল্যাণকর। পিতা  বা  মাতা  তুষ্ট  হলে  দেবতা প্রীত হন, ধনে  জনে  সৌভাগ্যে  গোত্র  বর্ধিত  হয়। বংশে  কেউ  দীন  হয় না। কেউ  অসুখী  থাকে  না। পিতৃপূজায়  শান্তি  হয়, মানুষ  যা কামনা  করে  তাই  পায়। আরোগ্য, অশোক, অভয়, সৌভাগ্য --- পিতৃপুরুষের  দুর্লভ  দান।

মহর্ষি পতঞ্জলি বলেছেন ---

"সংস্কার-সাক্ষাৎকরণাৎ পূর্বজাতিঞ্জানম্‌" --- সংস্কার  সাক্ষাৎকার করলে পূর্বজাতিঞ্জানরূপা  বিভূতির  আবির্ভাব  হয়। চিত্ত  ক্ষেত্রে অহরহ যে সকল  বাসনা  ফুটে  উঠেছে  সেগুলির  নাম  সংস্কার। সংস্কার শব্দের  সাধারণ  অর্থ  দাগ  বা  চিহ্ন। এই  সংস্কারগুলির ফলেই মানুষের স্বরূপ  বিস্মৃতি। কোন  সাধকের  চিদাকাশে  গতি  হলে পূর্ব পূর্ব  জন্ম ও  জাতির  সমূহ  সংস্কার  তিনি  দেখতে  পান, সাক্ষাৎ মাত্রই সেই সব সংস্কারের  বন্ধন  হতে  মুক্ত  হন। কিন্তু  এই অবস্থা লাভের জন্য  চাই  দৃঢ়  সংযম  এবং  সুদৃঢ়  ধ্যান-নিষ্ঠা। যা সর্ব সাধারণের পক্ষে সহজসাধ্য  নয়।

বৈদিক  ঋষিরা  বলেছেন --- পিতৃপূজায়  স্মৃতির  জাগরণ  ঘটে। মানুষের  স্মৃতি  চৈতন্যের  একটা  সঞ্চয়-ঘর। সেখানে  ঘুমিয়ে আছে অনেক  কালের  স্মৃতি, অদূর  কালের, দূরবর্তী  কালের, জন্ম-জন্মান্তরের। মানুষের  আত্মঞ্জানলাভের  পথ  সুগম  হয়  জন্ম-জন্মান্তরের  স্মৃতির  জাগরণে। পিতৃগণের  পূজায়  এই  জাগৃতি ঘটে, সহসা  ঘটে  চিদাকাশে  উত্তরণ।

এত  সহজে  এত অব্যর্থ  ফল  প্রাপ্তি  ঘটে  বলে  পিতৃমহিমায়  মুগ্ধ মন্ত্রদ্রষ্টা  ঋষিরা  পিতৃপূজাকে  অগ্রাধিকার  দিয়েছেন। তাঁরা যেকোন দেবপূজা, যাগযঞ্জ, এমন  কি  ব্রহ্মধ্যানে  সমাহিত হওয়ার পূর্বক্ষণেও সর্বাগ্রে  পিতৃপুরুষের  ধ্যানপূজা  করতেন। পিতৃপূজা ছাড়া  বৈদিক ব্রহ্মমার্গের  পথ  উন্মুক্ত  হয়  না, জাগ্রত  হয়  না উত্তর সুষুম্নার পথ।সত্যদর্শনের  জন্য  যে  হিরণ্ময়  পাত্রের  আবরণ উন্মোচনের  কথা ঈশোপনিষদে  বলা  হয়েছে --- সেই  দ্বার অপাবৃত  হয়  পিতৃপূজায়।

স্বয়ং  বেদমূর্তি  ভগবান  বেদব্যাস  মহাভারতে  ভীষ্মের  মুখ  দিয়ে যুধিষ্ঠিরকে  উপদেশ  ছলে  দ্ব্যর্থহীন  ভাষায়  ঘোষণা  করেছেন ---


পিতৃন্‌  পূজ্যাদিতঃ  পশ্চাৎদ্দেবতাস্তর্পয়ন্তি  বৈ।
তস্মাত্তান্‌  সর্বযঞ্জেন  পুরুষঃ  পূজয়েৎ  সদা।।

ঋষিরা  প্রথমে  পিতৃগণের  পূজা  করে  দেবগণের  পূজা  করেন অতএব  মানুষ  সর্বদা  সর্বপ্রযত্নে  সর্বাগ্রে  পিতৃগণের  পূজা  করবে।

পিতরৌ  যঃ  ধ্যায়েৎ  স  চ  পুণ্যদেহী
যতির্ভূপতিব্রহ্মচারী  চ  গেহী।
লভেদ্‌  বাঞ্ছিতার্থং  পদং  ব্রহ্মসংঞ্জং
পিতৃপাদপদ্মে  মনো  যস্য  লগ্নম্‌।।

মাতাপিতা  বা  পিতৃপুরুষদের  যিনি  ধ্যান  পূজা  করেন, তিনি পূণ্যবান। দীনদরিদ্র  সাধারণ  গৃহী  হোন, রাজাই  হোন  কিংবা মুনি ঋষি  ব্রহ্মচারী  যেই  হোন  না   কেন,  পিতৃপাদপদ্মে  তাঁর মন লগ্ন থাকলে  তাঁর  সর্বাভীষ্ট  সিদ্ধ  হয়, এমন কি ব্রহ্মপদও লাভ হয়।


https://www.facebook.com/pages/tapobhuminarmada/454528151310191

"পিতরৌ" হী পরমং তপঃ ---


পিতা  জীবন্ত  ঈশ্বর, মাতা  জীবন্ত  ঈশ্বরী, তাঁদের  সেবা  পরিচর্যাই জীবনের  মুখ্য  কর্তব্য, মাতা  বা  পিতার  ধ্যান  জপেই  জীবনের পরম  শ্রেয়োলাভ  হতে  পারে। মাতা  পিতাকে  উপেক্ষা  করে  অন্য কোন  অদৃশ্য  দেবতার  কৃপালাভ  করার  জন্য  যতই  তীব্র  সাধন- ভজন  করা  হোক্‌  না  কেন, তা  ভস্মে  ঘৃতাহুতি  মাত্র।

এ জগতে  কেউ  একটু  বেশী  Father-centric , কেউ  বা  একটু বেশী Mother-centric  অর্থাৎ  কারও  মায়ের  প্রতি  যথোচিত  শ্রদ্ধাভক্তি থাকলেও  বাবার  উপর  টান  বেশী, কারও  বা  পিতার  উপর শ্রদ্ধাভক্তি  থাকলেও  মায়ের  উপর  টান  বেশী  থাকে। এটি স্বাভাবিক এবং  সচরাচর  বহুক্ষেত্রেই  দেখা  যায়। পিতার  চরণে প্রণাম  করলে তা  মাতার  চরণে  পৌঁছায়
, মাতার  চরণে ধূল্যবলুণ্ঠিত হলে  তাও পিতা  গ্রহণ  করেন, পিতা  তৃপ্ত  হন। কারণ, উভয়ে  একই তত্ত্বের  দুই ভিন্ন  ভিন্ন  প্রকাশ  মাত্র। উভয়ে একত্রে শিব-শিবানী --- অর্ধনারীশ্বর।

বেদের  বিধান --- সর্বপ্রথম  পিতৃপূজা। মাতা  বা  পিতৃতত্ত্ব  এমনই মধুরতম  শ্রেষ্ঠ  তত্ত্ব  যে, ক্রান্তদর্শী  বৈদিক  ঋষিরাও  ভক্তি  ও ভাবাবেশে  উচ্ছল  হয়ে, তাঁরা  বিভিন্ন  বেদ  মন্ত্রে  একই  কথা বারবার  বলছেন ----


ওঁ  অগ্নয়ে  কব্য  বাহনায়  স্বাহা।
সোমায়  পিতৃমতে  স্বাহা।।

হে  অগ্নে!  তুমি  কব্য  বহন  করে থাক, অতএব  আমাদের প্রাণপুরুষের  পিতৃগণের  উদ্দেশ্যে  এই  কব্য  তোমার  নিকট সমর্পণ করছি, এই  আহুতি  স্বাহুতি  হোক। হে  সোম, তুমি  পিতৃগণের অধিষ্ঠান, অতএব  তোমার  উদ্দেশ্যে  এই  কব্য  অগ্নিতে  হবন করছি, এই  আহুতি  স্বাহুতি  হোক।

দেবতার  উদ্দেশ্যে  যা  দেওয়া  হয়, তা  হব্য। পিতৃগণের  উদ্দেশ্যে হৃদ্য  ও  উপাদেয়  যা  কিছু  অগ্নিতে  দেওয়া হয়, তার  নাম  কব্য।

দেবতা  ও  পিতৃপুরুষ  অগ্নিমুখেই  গ্রহণ  করেন। মাটির  উপর  কুশ পেতে  পিণ্ডার্পন  প্রভৃতি  পরবর্তী  যুগের  ব্যাপার, পৌরহিত্য- তন্ত্রের অবদান।

ওঁ  আয়ন্তু  নঃ  পিতরঃ  সোম্যাসোহগ্নিষ্বাত্তা
পথিভির্দেবযানৈঃ।।

পিতৃগণ, দেবযানে  আগমন  করুন। অগ্নি  আপনাদের  দেহ  গ্রহণ করেছে  কিন্তু  আত্মা  অবিকৃতই  আছে, অগ্নিমুখে  আমাদের  এই অন্ন গ্রহণ  করুন।

ওঁ  যে  নঃ পিতুঃ পিতরো  যে  পিতামহা  য  আবিবিশুরুর্বন্তরিক্ষম্‌।
য  আক্ষিয়ন্তি  পৃথিবীমুতদ্যাং  তেভ্যঃ  পিতৃভ্যো  নমসা  বিধেম।।

আমাদের  পিতৃগণ  যারা  বৃহদাকাশে  "উরু  অন্তরীক্ষং"  প্রবেশ করেছেন, সহজ  কথায়  দিব্যলোকে  আছেন  অথবা  আকাশ  ও পৃথিবী  আচ্ছাদন (আক্ষিয়ন্তি)  করে  বিরাজিত, সকলের  মঙ্গল  ও তৃপ্তিবিধানের  জন্য  অগ্নিতে  প্রাণের  অর্ঘ্য  নিবেদন  করছি।

ওঁ  যে  নিখাতা  যে  পরীপ্তা  যে  দগ্ধা  যে  চোদ্ধিতাঃ।
সর্বাংস্তানগ্ন  আবহ  পিতৃন  হবিষে  অত্তবে।।

পিতৃগণের  দেহ  প্রোথিত  হোক  বা  যেরূপই  তার  পরিণাম  ঘটুক না কেন, হে  অগ্নে!  তাঁদের  ভোজনের  জন্য (অত্তবে)  অর্থাৎ তৃপ্তির অভিপ্রায়  এই  হবিঃ  হোমের  পদার্থ  বহন  করে  নিয়ে  যাও।

মন্ত্রদ্রষ্টা  বৈদিক  ঋষিগণ  উপলব্ধি  করেছিলেন  যে --- মাতা পিতা ও পিতৃগণের  আশীর্বাদ  মর্ত্যের  অমৃত। মাতা  পিতার  প্রত্যক্ষ সেবা পরিচর্যাকে  পূজা  ও  যঞ্জের   মর্যাদা  দেওয়া  হয়েছে। মাতা পিতা জীবিত  থাকলে  তাঁদের  সেবা  যত্নকে  উপেক্ষা  করে  কেবল অহরহ মাতা  পিতার  সিদ্ধ  বীজ  জপ, ধ্যান  বা  কব্যাহুতিতে কোন কাম্যফল  লাভ  হবে  না।  দুই-ই  করতে  হবে।  তবেই  অমূর্ত্ত পিতৃপুরুষ  তুষ্ট  হবেন।  অবশ্য  যাঁদের  মাতাপিতা  লোকান্তরিত হয়েছেন  তাঁদের  পক্ষে  মাতাপিতার  জপ  ধ্যান  এবং  তাঁদের উদ্দেশ্যে  অগ্নিমুখে  কব্য  দানই  মুক্তির  সরণী।

মহাপ্রভু  বলেছেন ---  কৃষ্ণনামে  চেতোদর্পণমার্জনম্‌  অর্থাৎ চিত্তরূপ দর্পণ  পরিমার্জিত  হয়। বৈদিক  ঋষিরা  সহজতর  পথের সন্ধান দিয়ে বলেছেন --- মাতা  পিতার  সশ্রদ্ধ  সেবা  পরিচর্যায় জীবের  চিত্ত  মল নিত্য  পরিমার্জিত  হয়,  চিত্ত  শুদ্ধি  ঘটে। এইভাবে চিত্তরূপ দর্পণ যার পরিমার্জিত  হয়েছে --- তারই  পিতৃযঞ্জে অধিকার।


To  be  continued......









Wednesday, January 1, 2014