Tuesday, January 21, 2014

"দেবভূমি বদ্রী" ------


Cont (Last) ......


সকাল ৫ টায় ঘুম ভাঙল। তিনজনে  ঠিক ৬ টার সময় পাণ্ডুকেশ্বর ছেড়ে এগিয়ে চললাম। পৌনে ২ ঘণ্টার মাথায় পড়ল লামব্‌গড়। লামব্‌গড় ছেড়ে যতই যেতে লাগলাম ততই শৈত্যপ্রবাহ বাড়তে লাগল। গ্রীষ্মকাল এসে পড়লেও পাহাড়গুলি বরফের মুকুট পরে আছে। বোধ হয় মার্তণ্ডদেব পৃথিবীর আরো কাছে এলে তারা সসম্মানে তখন তাদের মুকুট খুলবে। লামব্‌গড় থেকে হনুমান চটি চার মাইল। এতটা পথের মধ্যে শুধু এক জায়গায় পাঁচ সাত খানা চালা ঘর ছাড়া কিছুই চোখে পড়ল না। মানুষ, পশু, পক্ষী, কাক পর্যন্ত এখানে বিরল। প্রকৃতি এখানে অপূর্ব সুন্দরী! পথ ক্রমশই ঊর্দ্ধগামী। দৈহিক কষ্ট যতই বাড়তে থাকে, জাগতিক বস্তু চিন্তা যেন ততই উবে যেতে থাকে।


চারদিকেই নয় দশ হাজার ফুট পাহাড়ে বেড়া, চির, কেলু ও ফার্ণ-এর ভিড়। পথের বাঁ দিকে নীচু দিয়ে অতি বেগে বয়ে যাচ্ছে অলকানন্দ। নদীটি প্রাণময়ী, জীবন্ত। আমরা চলেছি উপরে, নদী নীচে। পর্বত যেন ধ্যানমগ্ন ঋষির মত শান্ত, সমাহিত হয়ে আমাদের নিরীক্ষণ করছে। অলকানন্দা কোলাহলময়ী। সে কোথাও পাহাড়ের বুক থেকে লাফিয়ে পড়ছে, কখনও শিলাখণ্ডের তলায় লুকাচ্ছে, আবার কোথাও বা আবর্তের সৃষ্টি করছে। নেচে গেয়ে কলহাস্যে অপ্সরা যেন ধ্যানমগ্ন ঋষির ধ্যান ভাঙাবার চেষ্টা করছে।


গরমের হাওয়া লেগে বেশীর ভাগ বরাঁশ ফুল ঝরে গেলেও, স্থানে স্থানে তাদের সে কি উজ্জ্বল সমারোহ! পাহাড়ের বুকের সবকিছু যখন বরফের চাদরের নীচে ঘুমায় তখন গাঢ় রক্তবর্ণের বরাঁশই শুধু জেগে থাকে। লিচু পাতার মত ছোট এর পাতা। কলকে ফুলের মত উঁচু গাছের বুক ভর্তি টকটকে লালফুল --- বরাঁশ। এই ফুল সর্বরোগহর। বরাঁশ কেবল ফুল নয়, এ হল বদ্রীনারায়ণের বর, প্রসাদ। 


একটা চির গাছের কুঞ্জ পার হলাম। নদী এখন অনেক নীচ দিয়ে যাচ্ছে। তার গর্জন প্রায় শোনা যাচ্ছে না। বন এখানে বেশ ঘন। কোথা থেকে কোনো লুকানো ফুলের একটা মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসছে। সেই গন্ধে শরীরের সমস্ত ক্লান্তি ধুয়ে মুছে শরীরকে সতেজ করে তুলছে। সেই ফুলের সৌরভ মহাআনন্দের আর সেই আনন্দলোকের অনুভূতি অবিস্মরণীয়।


জানার মাঝে অজানার প্রভাব, ঞ্জানের সঙ্গে অঞ্জতার মিশ্রণে, অঞ্জতা ও আনন্দের অবকাশ ও স্পর্শেই সৃষ্টি হচ্ছে, সৃষ্টি চলেছে। সেই ঞ্জানাতীত, বোধাতীতকে অপেক্ষা করেই সব ঘুরছে। এই ঘূর্ণনের চক্রটিকে যিনি ধারণ করে আছেন, তিনিই বিষ্ণু, তিনিই বদ্রীনাথ, তিনিই ওই হঠাৎ আসা আনন্দের আসল কারণ, ফুলের গন্ধটা নয়।


মাইল খানিক যাবার পর যতই বদ্রীক্ষেত্রের কাছাকাছি হচ্ছি ততই দৈহিক কষ্ট তীব্রতর হতে লাগল। মনের গতি প্রকৃতিও যেন সুক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম হয়ে উঠল।আমরা নৃত্য-চঞ্চলা অলকানন্দার গা ঘেঁসে যেতে লাগলাম। এবার মনে হল না অলকানন্দা বিঘ্নোৎপাদিকা বরং জলকণাগুলি যেন মাথা তুলে বলছে --- দাঁড়িও না। আমিও দাঁড়াচ্ছি না তুমিও দাঁড়িয়ো না, এগিয়ে চলো  গন্তব্যের দিকে।


বেলা ১১টা নাগাদ হনুমান চটিতে পৌঁছালাম। এটাই এ পথের শেষ চটি। দোকান ও ধর্মশালাগুলিতে লোক নেই বললেই চলে। সঙ্গী ছেলেটি আমার ও সাধুজীর জন্য এক লোটা গরম চা নিয়ে এল। চা খেয়ে প্রাণ জুড়াল। হনুমান চটিতে আধঘণ্টা কাটিয়ে এগোতে লাগলাম।


এখান থেকে রাস্তা আরো ঊর্ধমুখী এবং চড়াই বেশ কষ্টকর। দশ মিনিট হাঁটি আর বিশ্রাম নেই। প্রতি মুহুর্তে মনে হবে আর এগিয়ে কাজ নেই। সমতলের মানুষদের পক্ষে এই চড়াইতে শ্বাসকষ্ট হওয়া স্বাভাবিক। একটা বাঁক ঘুরতেই এক অভুতপূর্ব দৃশ্য চোখে পড়ল। সমস্ত পথটাই তুষারবৃত তাতে সুর্যের আলো পড়ে এক জায়গায় ইন্দ্রধনুর সৃষ্টি করেছে। এই বরফ ঢাকা পথ কিভাবে পার হব বলে ভয় হলেও কিন্তু তা আমার পথ রোধ করতে পারল না। দিব্যি বরফ মাড়িয়ে এগিয়ে চললাম। দূর থেকে বরফ পিচ্ছিল বলে মন হলেও তার বেশীর ভাগই আলগা বালির মত। মনে এক বিচিত্র অনুভূতির সৃষ্টি হল। পথের ধারে একটা ঝোরায় জল খেয়ে পাথরে বসলাম। দেখলাম পথ আরোও উঁচুর দিকে চলেছে।


সঙ্গী  দু'জনকে জিঞ্জাসা করলাম --- মন্দির আর কিতনা দূর? দুজনেই সমস্বরে বললেন --- নজদিক্‌। মনে মনে উদীপ্ত হয়ে উঠলাম। শরীরের সমস্ত শক্তি একত্রিত করে হাঁটতে শুরু করলাম। আরো ২ঘণ্টা হেঁটে অর্ধ মূর্ছিত অবস্থায় এক উপলখণ্ডের ধারে পৌঁছাতেই নজদিকের নাগাল পেলাম! বদ্রীনারায়ণজীর মন্দির ও বসতি দৃষ্টিগোচর হল। বাবার আদেশ পূর্ণ করতে পারার আনন্দে আমার শরীর- মন উদ্বেল হয়ে উঠল। এই যাত্রার যে কষ্ট তা মুহুর্তে দূরীভূত হল।


মন্দিরের নীচেই তপ্তকুণ্ড। জল প্রায় ফুটন্ত গরম। অবগাহন স্নানে পথের সকল ক্লান্তি যেন মুহূর্তে জুড়িয়ে গেল। তপ্তকুণ্ডের ধার থেকেই মন্দিরের সিঁড়ি উঠেছে। মন্দিরে প্রবেশ করে মূর্তির পাদদেশে মাথা ছোঁয়ালাম। সাধুজী আমাকে উদ্দেশ্য করে অনর্গল বলে চলেছেন --- ৩১৫৫ মি উচ্চে বিষ্ণুক্ষেত্র বদ্রীনারায়ণ।


এস্থানে দেবী লক্ষ্মী বদরী অর্থাৎ কুল বৃক্ষরূপে ছত্রাকারে ছায়া দেন ধ্যানমগ্ন নারায়ণকে। মন্দিরের সামনে শ্বেত-শুভ্র গাড়োয়াল-রাণী নীলকণ্ঠ পাহাড় (৬৫৯৫ মি)। দু'পাশে নর ও নারায়ণ পর্বত। ৮ম শতকে আচার্য্য শঙ্কর তপ্তকুণ্ডের কাছে গরুড় গুম্ফায় প্রতিষ্ঠা করেন ভগবান বিষ্ণুকে। পরে গাড়োয়াল রাজ বর্তমান মন্দির নির্মাণ করে দেবতাকে প্রতিষ্ঠিত করেন। ১৩ শতকে মন্দিরের চূড়াটি সোনায় মুড়ে দেন রাণী অহল্যাবাঈ। ১৮০৩ এর ভুমিকম্পে বিধ্বস্থ মন্দিরের সংস্কার করেন জয়পুরের মহারাজা। জনশ্রুতি হল মূল মন্দিরটি নির্মাণ করেন রাজা পুরুর বা আর ভাস্কর্য স্বয়ং বিশ্বকর্মার।


মন্দিরটি তিনভাগে বিভক্ত --- গর্ভগৃহ, দর্শনমণ্ডপ, ও সভামণ্ডপ। উঁচু বেদীতে মণিমুক্তো ও অলঙ্কারে ভূষিত পদ্মাসনে কষ্টিপাথরের চতুর্ভুজ বিষ্ণু। তাঁর এক হাতে সুদর্শন চক্র, দ্বিতীয় হাতে পাঞ্চজন্য শঙ্খ, তৃতীয় হাতে কৌমদকী গদা, চতুর্থ হাতে পদ্ম, মস্তকে রত্নখচিত মুকুট, শিরোপরি স্বর্ণছাতা। কেয়ুরে কুণ্ডলে কঙ্কণে অপরূপ শোভা। বিষ্ণুর বামে নর ও নারায়ণ, ডানে কুবের। সামনে রূপোর গরুড় করজোড়ে সম্ভাষণরত। পূজারী হলেন রওয়াল নাম্বুদ্রি সম্প্রদায়।


পুজো সেরে মন্দির থেকে বেরোতেই ঝুরঝুর করে জমাট কুয়াশার মত অজস্র বরফের টুকরো আমাদের উপর পড়তে লাগল। মিনিট তিন-চার পরে বরফ পড়া বন্ধ হয়ে গেল।


আমি  সঙ্গী ছেলেটিকে জিঞ্জাসা করলাম --- অলকানন্দার জল কমে। সে জানাল --- গরম এলে অলকানন্দায় যেই জল কমে, অমনি বরফ গলে নদীকে পুরো করে দেয়। এখানের এমনই মজা যে, সব চূড়ায় সব বরফ গলবার আগেই নতুন বরফ আসার সময় হয়ে যায়।


সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে ওঠার আগেই সাধুজীর কুঠিয়াতে আস্তানা গাড়লাম। ঐ তুষারমণ্ডিত সন্ধ্যারাগ রঞ্জিত অলকানন্দার শোভায় কত শান্তি, কত পবিত্রতা। সকাল হতে কুঠিয়া থেকে বেরিয়ে তপ্তকুণ্ডে স্নান করতে গিয়ে দেখি আর একজন সাধু কুণ্ডের জলে হাত-মুখ ধুচ্ছেন।


মিটিমিটি  হেঁসে আমাকে প্রশ্ন করলেন --- দর্শন হুয়া।

উত্তর দিলাম --- হুয়া।
--- ক্যায়া মাঙ্গা।
--- কুছ নেহী।
--- তব কেঁও আয়া?
--- পিতাজীকে আদেশ পালন করনে কে লিয়ে ঔর ভগবানকে বাসস্থান দেখনে কে লিয়ে।
আমার কথায় সাধুর ভাবান্তর হল। চোখ দুটি চকচক করে উঠল।তিনি উঠে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন --- তেরা দর্শন সার্থক হুয়া। সাধুকে প্রণাম করে পুনরায় বদ্রীনাথজীকে দর্শন করে, হিমালয়ের দেবতাকে প্রণাম করে ফিরে চললাম জোশীমঠে।

https://www.facebook.com/pages/tapobhuminarmada/454528151310191

No comments:

Post a Comment