Wednesday, February 4, 2015

শ্রীরঙ্গনাথের সাধক যামুনাচার্য ---


ভক্তিবাদের স্তম্ভস্বরূপ বিশিষ্টাদ্বৈতবাদের শ্রেষ্ঠ আচার্য যামুনাচার্যের জীবন কাহিনী বড়ই চিত্তাকর্ষক। তিনি দক্ষিণ ভারতের মাদুরাই -এর এক বিখ্যাত বিষ্ণুভক্ত ব্রাহ্মণ পরিবারে ৯৫৩ খৃঃ আষাঢ় মাসে উত্তরাষাঢ়া নক্ষত্রে জন্মগ্রহণ করেন। শ্রীসম্প্রদায়ের মতে ইনি শ্রীনারায়ণের সিংহাসনের অংশাবতার। আচার্য নাথমুনি ছিলেন তাঁর পিতামহ। দাক্ষিণাত্যের শ্রীরঙ্গনাথের কৃপাধন্য যামুনাচার্যের পিতার নাম ঈশ্বরমুনি। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন অসাধারণ মেধা ও প্রতিভার অধিকারী। তাঁর গুরু ছিলেন ভাষ্যাচার্য। ঈশ্বরদত্ত প্রতিভায় মাত্র বারো বছর বয়সে তিনি শাস্ত্রবিদ্যায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন।


সেই সময় দাক্ষিণাত্যের পাণ্ড্য রাজ্যের সভা আলো করেছিলেন পণ্ডিত শিরোমণি বিদ্বজ্জন কোলাহল। সারা দেশে শ্রেষ্ঠ শাস্ত্রবিদ্‌রা প্রায় সকলেই তাঁর কাছে তর্কযুদ্ধে পরাজিত হয়েছেন। একদিন ভাষ্যাচার্যের অনুপস্থিতকালে পণ্ডিত শিরোমণির এক শিষ্য যামুনাচার্যের সামনে তাঁর গুরুর সম্বন্ধে অপমান সূচক মন্তব্য করলে বালক যামুনাচার্য পণ্ডিত শিরোমণিকে তর্কযুদ্ধে আহ্বান করেন। গুরু ফিরে এসে সব শুনে হাহাকার করে ওঠেন কারণ তিনিও কোলাহলকে গুরুর মতন শ্রদ্ধা করেন। তিনি যামুনাচার্যকে নানাভাবে বুঝিয়ে কোলাহলের কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করতে বলেন। কিন্তু যামুনাচার্য অনড়। তিনি কিছুতেই তাঁর গুরুর অপমান সহ্য করতে পারবেন না। তিনি গুরুর কাছে আশীর্বাদ প্রার্থনা করলেন। গুরু ভাষ্যাচার্য যামুনাচার্যকে আশীর্বাদ করলেন বটে কিন্তু মনে মনে ভাবলেন একমাত্র দৈবী কৃপাই যামুনাচার্যকে রক্ষা করবে। 


পণ্ডিত শিরোমণি বিদ্বজ্জন কোলাহলকে তর্কযুদ্ধে আহ্বান করেছে এক বারো বছরের বালক --- এই সংবাদ দাবানলের মত সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। সকলেই ধরে নিয়েছিলেন যামুনাচার্যের পরাজয় শুধু সময়ের অপেক্ষামাত্র। কারণ বালক যামুনাচার্য কোলাহলের সামনেই মূর্চ্ছা যাবেন। যথাসময়ে পাণ্ড্য রাজের সভাপতিত্বে তর্ক সভা শুরু হল। রাজসভায় তিল ধারণের স্থান নেই। সকলেই অধীর প্রতীক্ষায় অপেক্ষমান। 


যামুনাচার্যকে দেখে দিগ্বিজয়ী পণ্ডিতের চোখে মুখে ঝরে পড়ে তাচ্ছিল্য। কোলাহল জিঞ্জাসা করেন --- আল্‌ওয়ান্দারা? এই বালক আমাকে জয় করতে চায়। একে অপরকে প্রশ্ন বাণে জর্জরিত করতে চান। কিন্তু কেউই কম যান না। সারা সভা স্তম্ভিত, হতচকিত। এমন সময় যামুনাচার্য উঠে দাঁড়িয়ে বললেন --- আমি আচার্য কোলাহলকে তিনটি প্রশ্ন করতে চাই ---


1. আপনার মাতা বন্ধ্যা নন, খণ্ডন করুন।

2. পাণ্ড্যরাজ মহাধর্মশীল নন, খণ্ডন করুন।
3. মহারাণী সাবিত্রীর ন্যায় সাধ্বী --- এ মত খণ্ডন করুন।

আচার্য কোলাহল এই উদ্ভট প্রশ্নে বিভ্রান্ত। তিনি এই প্রশ্নের উত্তর দিতে অস্বীকার করেন। রাজসভায় শুরু হয় গুঞ্জন। যামুনাচার্য বলতে শুরু করেন ---


মনু বলেছেন, এক পুত্র অপুত্রের মধ্যে গণ্য এজন্য দ্বিতীয় পুত্র উৎপাদন করা প্রয়োজন। মেধাতিথিও তাঁর ভাষ্যে বলেছেন --- অপুত্রঃ এক পুত্র ইতি শিষ্ঠ প্রবাদাৎ। অর্থাৎ আচার্য কোলাহলের মা একমাত্র পুত্রের জননী তাই তিনি বন্ধ্যা। যেমন কূট প্রশ্ন, তেমনি কৌশল পূর্ণ খণ্ডন।


যামুনাচার্যের দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে বলেন কলিতে ধর্ম একপাদ, অধর্ম ত্রিপাদ।


রাজা কর্তৃক রক্ষিত প্রজারা যে সকল ধর্ম কর্ম করে, রাজা তার ষষ্ঠাংশ প্রাপ্ত হন এবং রাজা যাদের রক্ষা করেন না তারা যে অধর্ম করে তার ষড়ভাগ রাজা প্রাপ্ত হন। কাজেই রাজা যতই সুশাসক হোন না কেন, প্রজাদের পাপের প্রাবল্য হেতু অধিক পাপ বহন করতে হয়, এই দৃষ্টিতে পাণ্ড্য রাজ মহাধর্মশীল নন।


অতঃপর যামুনাচার্য তাঁর তৃতীয় প্রশ্নের উত্তরে বলেন --- রাজা যখন অগ্নিও বটেন, সূর্যও বটেন, চন্দ্র, কুবের, ইন্দ্রও বটেন, তাহলে মহারাণী কেবল যে রাজারই পাণিগৃহীতা তা বলি কেমন করে?


বালক যামুনাচার্যের পাণ্ডিত্য ও শাণিত বুদ্ধির ঔজ্জ্বল্যে সবাই চমৎকৃত। সকলেই হৃদয়ঙ্গম করলেন শাস্ত্র ব্যাখ্যা, কূটবুদ্ধি ও চাতুর্যে তিনি অপরাজেয়। চারিদিক ধ্বনিত হতে থাকে বালক পণ্ডিত যামুনের জয়ধ্বনি।



বৌদ্ধ ও শঙ্কর যুগের পর শ্রেষ্ঠ ভক্তিবাদী আচার্য রূপে যামুনাচার্যের আবির্ভাব ঘটে।

পাণ্ড্যরাজ বালক যামুনকে দান করলেন রাজ্যের অর্ধাংশ। এই রাজ্য লাভ করে এর শাসনকার্যেও যামুন অসাধারণ যোগ্যতার পরিচয় প্রদান করেন। রাজকার্যে ব্যাপৃত নবীন পণ্ডিত উপনীত হন যৌবনে, ভুলে যান তাঁর তপোনিষ্ঠ, সাত্ত্বিকী আচারের কথা। ইতিমধ্যে পিতা ঈশ্বরমুনি গত হয়েছেন। ক্রমে পিতামহ নাথমুনিরও মহাপ্রয়াণ আসন্ন কিন্তু মৃত্যুর পূর্বে নাথমুনি তাঁর প্রিয় শিষ্য রামমিশ্র বা মানাক্কাল নম্বিকে আদেশ দেন--- যে করেই হোক ঈশ্বর প্রেরিত মহাসাধক রাজা যামুনকে রাজ্যপাঠের গণ্ডী থেকে বের করে তাকে চিনিয়ে দিতে হবে তার স্বরূপ। তার সুপ্ত শক্তিকে জাগ্রত করতে, একমাত্র তুমিই পারবে। তাকে নিয়ে আসতে হবে শ্রীরঙ্গনাথের চরণতলে।


নম্বি গুরুর আদেশ শিরোধার্য করে এসে উপস্থিত হয় যামুনের রাজধানীতে। রাজা যামুন সাদরে আপ্যায়ন করেন শ্রীরঙ্গমের সাধককে। কিন্তু নম্বির সঙ্গে কথা বলার সময় নেই রাজার। এভাবে কিছুকাল কাটলে, নম্বি জানতে পারেন রাজার সৈন্যদল পুনর্গঠনের জন্য বিপুল অর্থের প্রয়োজন। নম্বি এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইলেন না। তিনি নিভৃতে রাজাকে জানান --- তাঁর পিতামহ আচার্য নাথমুনি সন্ন্যাস গ্রহণের পর দৈবী কৃপায় বিপুল সম্পত্তির অধিকারী হন। তিনি মৃত্যুর পূর্বে সেই বিশাল সম্পত্তির দায়িত্বভার আপনাকে দিয়ে যেতে চান। তাই তিনি আপনার হাতে সম্পত্তি অর্পণের জন্য আমাকে পাঠিয়েছেন আপনাকে সঙ্গে করে শ্রীরঙ্গমে নিয়ে যাবার জন্য। কিন্তু শর্ত একটাই, আপনাকে গোপনে ও ছদ্মবেশে আমার সঙ্গে একা যেতে হবে। 



একদিন গভীর রাত্রে রাজা নম্বির সঙ্গে গোপনে ত্যাগ করলেন রাজপ্রাসাদ, পদব্রজে যাত্রা করলেন পূণ্যভূমি শ্রীরঙ্গমের দিকে। সপ্তম দিনে উভয়েই পৌঁছে গেলেন শ্রীরঙ্গমে। কাবেরীতে স্নান তর্পণ সেরে নম্বি যামুনকে উপস্থিত করলেন শ্রীরঙ্গনাথজীর বিগ্রহ সম্মুখে। বললেন --- ইনি হলেন আপনার দাদু নাথমুনির গুপ্ত ভাণ্ডার। আমি আপনার কাছে এবং গুরুর কাছে যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম তা আজ রক্ষিত হল।

কিন্তু বিগ্রহ দর্শনের সঙ্গে সঙ্গে এক অনাস্বাদিত পূর্বে আনন্দের শিহরণ বয়ে গেল রাজা যামুনের শিরা ধমনীতে, তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে। স্বতঃস্ফূর্ত আবেগে নতজানু হয়ে রঙ্গনাথজীর জ্যোতির্ময় মূর্তি দর্শন করতে করতে তিনি হলেন মূর্ছিত। যখন তাঁর মূর্ছা ভাঙল তখন তিনি অন্য মানুষ। প্রভু রঙ্গনাথের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি স্তব করতে লাগলেন ---



নিমজ্জিতোহনন্ত ভবার্ণবান্তঃ চিরায় মে কুলমিবাসি লব্ধঃ
ত্বয়াপি লব্ধং ভগবন্নিদানীং অনুত্তমং পাত্রামিদং দয়ায়াঃ।।

অনন্ত সংসার সাগরে বহুকাল ধরে ডুবতে ডুবতে অবশেষে কুলস্বরূপ তোমাকে পেয়েছি। তুমিও এক্ষণে অত্যুৎকৃষ্ট দয়ার পাত্র পেয়েছ?



অপরাধ সহস্রভাজনং পতিতং ভীমভবার্ণবোদরে
অগতিং শরণাগতং হরে, কৃপয়া কেবলমাত্মসাৎ কুরু।


আমি সহস্র অপরাধের অনুষ্ঠাতা, ভীষণ ভবসমুদ্রে পতিত। নিরুপায় হয়ে আমি তোমারই চরণাশ্রিত হতে চাই।

সমস্ত রাজ ঐশ্বর্য ত্যাগ করে তিনি নিলেন সন্ন্যাস। তাঁর যাত্রা শুরু হল প্রেম, ভক্তি ও ইষ্টপ্রাপ্তির পথে। শ্রীরঙ্গনাথের সেবা পূজায় মন, প্রাণ সমর্পণ করলেন সাধক যামুন। যামুন ভক্তিপথে আগমনের অতি অল্পকালের মধ্যে শ্রীসম্প্রদায়ের আচার্য পদে অধিষ্ঠিত হয়ে শ্রীসম্প্রদায়ে নতুন জীবনের সঞ্চার করেন। কয়েক বছরের মধ্যে এই ভক্তিস্নিগ্ধ মহাপুরুষের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল সারা দাক্ষিণাত্যে। পিতামহ নাথমুনি বিশিষ্টাদ্বৈতবাদের যে দার্শনিকতার প্রবর্তন করেন, সাধক যামুনাচার্য তার ভিত্তিকে করলেন সুদৃঢ়।


যামুনাচার্যের গ্রন্থ সমূহের মধ্যে প্রধান হল --- সিদ্ধিত্রয়ম। গৌড়বাদের মাণ্ডুক্যকারিকা স্বাধ্যায় করলে যেমন আচার্য শঙ্করের অভিপ্রায় বুঝতে অসুবিধা হয় না তেমনি যামুনাচার্যের এই গ্রন্থ স্বাধ্যায় করলে আচার্য রামানুজের গ্রন্থাবলীর মর্মকথা সহজে উপলব্ধি করা যায়। এছাড়া অন্যান্য গ্রন্থগুলি হল স্তোত্ররত্নম, আগম প্রমাণ্যম ও গীতার্থ সংগ্রহ।


https://www.facebook.com/pages/tapobhuminarmada/454528151310191