Wednesday, April 13, 2011

গুরুভক্তিঃ--


4.  ধাবড়ীকুণ্ডে অবস্থানকালে সম্বিদানন্দজী বলেছিলেন----- 

'অভয়ানন্দজীর মত গুরুগত প্রাণ শিষ্য আর একজনকেও দেখি নি। আমি চারধাম পরিক্রমা করছি, কত যে মঠ ও সন্ন্যাসী দেখেছি তার ইয়াত্তা নাই। সকলেরই হাজার হাজার ভক্ত আছে। কেউ চায় তার গুরুর কাছে ঐহিক কামনা বাসনার পূর্তি, কেউ চায় পরমার্থিক কল্যাণ। গুরুর কাছে সাধনপ্রাপ্ত হয়ে কতজনকে দেখেছি পাহাড়ে গুহায় তীব্র শীত গ্রীষ্ম উপেক্ষা করে উগ্র তপস্যায় রত আছেন। কেউ ঊর্ধ্বপদে নত মুণ্ডে, কেউ বা অগ্নি-প্রাকারের মধ্যে বসে তপস্যা করছেন। তুমিও হয়ত পরিক্রমা করতে করতে অনেক উৎকট তপস্বীকে দেখে থাকবে। আমিও তাঁদেরকে দেখেছি এবং ভগবান আমাকে যেটুকু যোগদৃষ্টি দিয়েছেন তারই সাহায্যে আমি বলতে পারি, অভয়ানন্দজী তাঁদের অনেক উপরের অবস্থা লাভ করেছেন অথচ তারজন্য তাঁকে কোন উগ্র তপস্যা করতে হয় নি। শুধুমাত্র গুরুসেবা এবং গুরুগত প্রাণতার জোরে তিনি উচ্চকোটি হতে উচ্চতার কোটিতে এগিয়ে যাচ্ছেন। ত্যাগ বৈরাগ্য ত তাঁর আছেই, গুরুর প্রতি ভালবাসার টানে তিনি রাজৈশ্বর্য ত্যাগ করে এসেছেন, সে কথা তোমাকে আগেই বলেছি।এক লিঙ্গস্বামীই তাঁর ধ্যান-ঞ্জান।গুরুর স্থূল দেহের সেবা ত তিনি করছেনই, তাঁর সমস্ত খুঁটিনাটি প্রয়োজনেও অভয়ানন্দজী সব সময়েই হাজির থাকে।আমার যখন সময় ধরে নিয়ম করে অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে ধ্যান ধারণায় মগ্ন থাকি,গুরু উপরের গুহায় কখন কিভাবে কি অবস্থায় আছেন,প্রতিকূল জলহাওয়া তাঁর স্থূলদেহের কোন অসুবিধা ঘটাচ্ছে কিনা,তার কোন খোঁজ নিই না,তখন ও অভয়ানন্দজী গুরুসেবায় রত থাকেন।


একবার মাঘ মাসের প্রচণ্ড শীতে এখানে বরফ পড়ছিল, আমরা যে যার গুহার মধ্যে ধূনি জ্বেলে নিজেদের অন্তরঙ্গ সাধনে মত্ত ছিলাম; সকালে উঠে দেখলাম, এখানকার পাহাড় ও গাছপালাগুলো বরফে ঢেকে গেছে। গুহার বাইরে হঠাৎ-সমাধিস্থ  গুরুজীর উপর একটা ত্রিপল টাঙ্গিয়ে ত্রিপলের তিন দিক গাছের ডালে বেঁধে গুহার গায়ে যেদিক টায় কোন গাছ নাই, সেদিকের খুঁটটা নিজের হাতে ধরে গোটা রাত দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। বেলা আটটা নাগাদ ঐ দৃশ্য আমার চোখে পড়ে। আমি সবকে ডেকে নিয়ে গিয়ে গুরু-শিষ্য উভয়ের চারদিকে আগুন জ্বালি।'বটুকনাথ ' গুহার মধ্যে ঢুকে গিয়ে বরফের হাত থেকে আত্মরক্ষা করেছিল।প্রায় দু'ঘণ্টা বাদে গুরুজীর ধ্যান ভাঙে, তিনি অভয়ানন্দজীর দুর্দশা  দেখে অধীর হয়ে পড়েন। সারারাত্রি বরফ পড়ে অভয়ানন্দজীর দেহ বরফের কুচিতে ঢেকে গেছল।


'হম ত নর্মদামায়ীকা গোদমেঁ থা লেকিন হমারা অভয়ানন্দকা হালৎ ক্যায়সে বুরা হো গয়া'---এই বলে মহাযোগী কেঁদে ফেলেন। নিজে দুহাতে জড়িয়ে ধরে অভয়ানন্দের দেহ আগলে তিনি বসেছিলেন। অভয়ানন্দের সারা গায়ে বড় বড় ঘা হয়ে গিয়েছিল তুষারপাতের ফলে। গুরুজী নিজ হাতে তার পরিচর্যা করেছিলেন। সেবা বলতে বুঝায় স ইব=সেব্‌ ধাতুর উত্তর আপ্‌। স ইব মানে তাঁর অর্থাৎ ঈশ্বরের মত। গুরুকে জীবন্ত ঈশ্বরবোধে সেবা; তার জ্বলন্ত উদাহরণ হলেন এই অভয়ানন্দজী।


নানাবিধ যোগযাগ, ধ্যানধারণায় যা লাভ করা যায় না, কেবল মাত্র গুরুসেবা দ্বারা তা প্রাপ্তব্য। উপনিষদে পড়েছেন ত উদ্দালক ও আরুণির কথা। তাঁরা কেবল গুরুসেবা করেই পরম পদ লাভ করেছিলেন। শ্রুতিবাক্য মিথ্যা নয়। যে কোন তপস্যার চেয়ে গুরুসেবা পরম পদ-প্রাপ্তির অব্যর্থ ফলপ্রদ পন্থা।


আমরা একই গুরুর শিষ্য হয়েও যতই সাধনা করিনা কেন, নিজেদের পূর্বজন্মার্জিত সাধনা ও সুকৃতি, তার সঙ্গে এ জন্মের তপস্যার বল যুক্ত হয়ে যত উচ্চপদই পাই না কেন, আমরা কিছুতেই শিবকল্প মহাযোগী এক লিঙ্গস্বামীর সমান হতে পারব না, কিন্তু অভয়ানন্দজী তাঁর গুরুসেবার জোরেই দ্বিতীয় এক লিঙ্গস্বামী হয়ে যাবেন।এক লিঙ্গস্বামীর সমূহ সাধন--- সম্পদ এবং সাধন- শক্তি অবলীলাক্রমে তাঁর মধ্যে সঞ্চারিত হয়ে যাবে। নর্মদাতটে দাঁড়িয়ে আমি মিথ্যা বলছি না, এ কথাকে ধ্রুবসত্য বলে জানবেন।



https://www.facebook.com/pages/tapobhuminarmada/454528151310191

Monday, April 4, 2011

গুরুভক্তিঃ----


3. শঙ্করাচার্যের শিষ্য পদ্মপাদাচার্য ছিলেন গুরুভক্তি ও গুরুগত প্রাণতার এক মূর্ত প্রতীক। তাঁর গুরুভক্তির স্বীকৃতি স্বরূপ আচার্য শংকর তাঁর প্রধান চারটি মঠের অন্যতম পুরুষোত্তম ক্ষেত্রস্থিত গোবর্ধন পীঠের আচার্য পদে অভিষিক্ত করেছিলেন। তিনি কিরকম গুরুগতপ্রাণ ছিলেন, তাঁর গল্প  হল---

পদ্মপাদাচার্যের অন্য নাম সনন্দন। আচার্যের সব শিষ্যরা অসাধারণ গুরুভক্ত ছিলেন এবং সকলেই প্রাণপণে তাঁর সেবা করতেন। তবুও আচার্য কেবল সনন্দনের গুরুগতপ্রাণতার পুনঃপুনঃ প্রশংসা করতেন। 


এজন্য অন্যান্য শিষ্যদের মনে সনন্দনের প্রতি একটা অসূয়ার ভাব ছিল। তাই সর্বসমক্ষে সনন্দনের একক বৈশিষ্ট প্রকট করার জন্য একদিন সনন্দন যখন অলকানন্দার অপর পারে গিয়েছিলেন, তখন সকলের সামনেই আচার্য অন্য পার থেকে ডাক দিলেন---'সনন্দন! সনন্দন ! শীঘ্র এস।' 


গুরুদেবের ত্রস্ত আহ্বানে সনন্দন অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়লেন। তিনি ভাবলেন দুর্গম হিমালয়ের বিপদ সঙ্কুল অরণ্যের মধ্যে হয়ত কোন বিপদ উপস্থিত হয়েছে । সেতুর উপর দিয়ে ধীরে ধীরে পা ফেলে গেলে দেরী হয়ে যাবে, এই চিন্তা করে তিনি কোন দিকে ভ্রূক্ষেপ না করে সোজা অলকানন্দায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।


বরফাচ্ছন্ন খরস্রোতা নদী। স্রোতের বেগ এমনই প্রচণ্ড এবং উদ্দাম যে, তাতে মত্ত মাতাঙ্গ ও পড়ে গেলে ভেসে যাবে মুহূর্তের মধ্যে।এই দৃশ্য দেখে আচার্যের অন্যান্য শিষ্যরা সনন্দনের মৃত্যু সুনিশ্চিত জেনে হাহাকার করে উঠলেন। 


কিন্তু গুরুগতপ্রাণ শিষ্যের দেহকে সর্বদাই গুরু রক্ষা করেন ।


গুরুশক্তিতে বলীয়াণ সনন্দনের প্রতি পদক্ষেপেই এক একটি করে পদ্ম প্রস্ফুটিত হয়ে উঠতে লাগল।সেই সকল পদ্মের উপরেই এক একটি পা রেখে উর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে ছুটতে গুরুর চরণে এসে বন্দনা করলেন।


এই অলৌকিক ঘটনা দেখে তাঁর গুরুভ্রাতাদের আর বাক্যস্ফুর্তি হয় না।সনন্দনকে আলিঙ্গন করে অপরাপর শিষ্যদের দিকে তাকিয়ে বললেন, 'আজ হতে সনন্দনের নাম হল পদ্মপাদ। তোমরা মনে রাখবে----ন গুরোরধিকং তত্ত্বং গুরু সেবার মত আর কোন শ্রেষ্ঠ তপস্যা নেই।' অদ্বৈতবাদের প্রধান আচার্য, মায়াবাদের প্রবক্তা, ঞ্জান-বিচারের নব ভগীরথ সেদিনই ঘোষণা করেছিলেন---



শরীরং সুরূপং সদা রোগ মুক্তং
যশশ্চারু চিত্রং ধনং মেরুতুল্যং
গুরোঘন্র--পদ্মে মনশ্চেয় লগ্নং
ততঃ কিং ততঃ কিং ততঃ কিং ততঃ কিং।।


অর্থাত, কারও শরীর কন্দর্পকান্তিই হোক, কিংবা সে নীরোগ শরীরের অধিকারীই হোক, সে যত বড় যশস্বী হোক, কিংবা তার মেরুপর্বত তুল্য ধনরত্নের পাহাড়ই থাক, গুরুপাদপদ্মে যদি চিত্ত লগ্ন না থাকে, তবে তার কি লাভ হল? অর্থাৎ গুরুভক্তি বিনা সবই নিরর্থক।


পঞ্চপাদিকা, বিঞ্জানদীপিকা, প্রপঞ্চসার এবং পঞ্চাক্ষরী ভাষ্য প্রভৃতি গ্রন্থ লিখে পদ্মপাদ গুরুর মতবাদের পুষ্টিসাধন করেছিলেন।