Wednesday, September 24, 2014

দিব্যগুরুর মন্ত্রমালা ---


ওঁ যদ্‌ ব্রহ্ম শুদ্ধং নিরহং নিরীহং স্বান্তর্বিলীনাত্মসমস্তশক্তি।

সচ্চিৎসুখং চৈকম্‌ অনন্তপারং তং তু আদিনাথং গুরুমানতা স্মঃ।।১

যিনি  শুদ্ধ, নিরহঙ্কার, আপ্তকাম এবং যাঁর অভ্যন্তরে সমস্ত শক্তি বিলীন হয়ে আছে, সেই অনন্ত অপার সচ্চিদানন্দ আদিনাথ নামক পরমাত্মা আমাদের প্রথম দিব্যগুরু। আমরা তাঁকে প্রণাম করি।


ওঁ যাস্তদ্বিলীনামিতশক্তয়ঃ স্যুস্তৎরূপিণী ব্রহ্মণ আদ্যভিন্না।

নিদ্রান্ত আদ্যেব নরস্য বৃত্তির্নতাঃ স্ম স্তাং শক্তিগুরুং দ্বিতীয়ম্‌।।২

পরব্রহ্ম হতে অভিন্না আদ্যাশক্তি --- যিনি বিলীন হয়ে আদিনাথ নামক পরব্রহ্মে  সুপ্তোত্থিত  পুরুষের  বৃত্তিবৎ  অবস্থান  করেন, তিনি আমাদের দ্বিতীয় দিব্যগুরু। আমরা তাঁকে প্রণাম করি।


ওঁ ত্বয়া বিশিষ্টস্তু স আদিনাথো নিরাকৃতির্নির্গুণ উচ্যতেহসৌ।

বৃত্ত্যন্যগোহনুগ্রবাং স্তৃতীয়ং সদাশিবং তং গুরুমানতাঃ স্মঃ।।৩

সেই শক্তিবিশিষ্ট আদিনাথ নির্গুণ ও নীরূপ হলেও নিবৃত্তিক যোগীর প্রঞ্জায় অনুগ্রহবশতঃ আরূঢ় হন বলে তাঁর নাম সদাশিব। সেই সদাশিব আমাদের তৃতীয় দিব্যগুরু। আমরা তাঁকে প্রণাম করি।


ওঁ তদুত্থিতা যা স্বত এব বৃত্তিঃ শ্রুত্যা স নৈকো রমতে ত্বিতীড্যা।

তাং শুদ্ধাবিদ্যাং চ সদাশিবীয়াং শক্তিং চতুর্থং গুরুমাতাঃ স্মঃ।।৪

সদাশিব দ্বিতীয় ব্যতীত একক প্রকাশিত হতে পারেন না বলে যে শক্তিরূপ বৃত্তির আশ্রয় গ্রহণ করেন, সেই শক্তিই আমাদের চতুর্থ দিব্যগুরু। আমরা তাঁকে প্রণাম করি।


ওঁ তদ্বানরূপঃ সগুণঃ স জাতস্তু অপাদপাণিঃ শ্রুতিবাক্‌প্রসিদ্ধঃ।

তিরোহিতং তিষ্ঠতি বিশ্বমস্মি্‌ন তমীশ্বরং পঞ্চমমানতাঃ স্মঃ।।৫

সেই শক্তিযুক্ত আকার বিরহিত কিন্তু ঞ্জানাদি বহুগুণবিশিষ্ট সদাশিব যখন অনুগ্রহ নিগ্রহ-সমর্থ ঈশ্বররূপ ধারণ করেন এবং তাঁর যে ঈশ্বররূপ শ্রুতি চরণহীন হলেও বেগগামী, নয়নহীন হলেও দৃষ্টিমান ও কর্ণহীন হলেও শ্রবণশীল বলে বর্ণনা করেছেন, সেই ঈশ্বর আমাদের পঞ্চম দিব্যগুরু। আমার তাঁকে প্রণাম করি।


ওঁ দ্বিতীয়ম্‌ ঐচ্ছৎ শ্রুতিবর্ণিতা যা তদ্ধৃত্তিরস্মান্‌ মহদাদিগর্ভম্‌।

ধত্তেহন্তরে তাং বয়মীশ্বরস্য শক্তিং তু ষষ্ঠং গুরুমানতাঃ স্মঃ।।৬

লীলার জন্য দ্বৈতভাব গ্রহণ করেছেন বলে শ্রুতি যাঁকে ইচ্ছাময় বলেন এবং তাঁর যে ইচ্ছাশক্তিরূপ বৃত্তি মহাদাদির নিধান বলে অভিহিত। তাঁর সেই বহুভবন শক্তি আমাদের ষষ্ঠ দিব্যগুরু। আমরা তাঁকে প্রণাম করি।


ওঁ তদ্যুগগুণাঢ্যাকৃতিমান্‌ স যা ত রুদ্রেতি বেদোক্তবচঃপ্রসিদ্ধঃ।

লয়ীকৃতং তিষ্ঠতি বিশ্বমস্মিংস্তং সপ্তমং রুদ্রগুরুং নতাঃ স্মঃ।।৭

মহাদাদিনিধানশক্তিযুক্ত যে ঈশ্বর গুণবহুল হয়ে আপনাতে সমস্ত বিশ্ববেগ ধারণ করে থাকেন এবং যজুর্বেদ রুদ্রাধ্যায়ে যাঁকে রুদ্র বলে বর্ণনা করা হয়েছে, তিনি আমাদের সপ্তম দিব্যগুরু। আমরা তাঁকে প্রণাম করি।


ওঁ অহং বহু স্যামিতি যা তদুত্থা বৃত্তির্জনিত্রী মহাদাদিকানাম্‌।

পৃথক পৃথক কৃত্য চ রুদ্রশক্তিং তমষ্টমং স্বীয়গুরুং নতাঃ স্মঃ।।৮

এক থেকে বহু হবার অভিপ্রায়ে ধৃতবেগ রুদ্র হতে বৃত্তিরূপা যে শক্তি অন্তর্নিহিত তত্ত্বসমূহকে পৃথক করার জন্য মহাদাদির জনিত্রী হন, তিনি আমাদের অষ্টম দিব্যগুরু। আমরা তাঁকে প্রণাম করি।


ওঁ ব্যাপ্নোতি তদ্যুক স  মহন্‌মুখেষু  তত্ত্বেষু  তেজস্তু অখিলম্‌ স্বকীয়ম্‌।

নিধায় তৎস্থং পরিপাতি বিশ্বং বিষ্ণুগুরুং তং নবমং নতাঃ নতাঃ স্ম।।৯

সংসৃষ্ট ও বিবিক্ত হওয়ায় বৃত্তি অবলম্বন করে মহাদাদি তত্ত্বে যাঁর স্বকীয় সমগ্র তেজ পালনের জন্য নিহিত থাকে, তিনি আমাদের নবম দিব্যগুরু --- বিষ্ণু। আমরা তাঁকে প্রণাম করি।


ওঁ পুষ্ণাম্যহং বিশ্বমিদং স্বকীয়ং মদীয়শক্ত্যেতি মদীয়বৃত্তিঃ।

পুষ্ণাতি তত্ত্বান্তরগং তু বিশ্বং তাং বিষ্ণুশক্তিং দশমং নতাঃ স্মঃ।।১০

আমি স্বতঃই বিশ্বপোষণকৃৎ --- এইরূপ বৃত্তিগত যে বৈষ্ণবী শক্তি তত্ত্বান্তরে পরিণত বিশ্বের পোষণ করেন, তিনি  আমাদের দশম দিব্যগুরু --- বিষ্ণুশক্তি। আমরা তাঁকে প্রণাম করি।


ওঁ তত্ত্বান্তরস্থং জগদিত্থমন্তঃ পশ্যন্‌ স্ববৃত্ত্যা স বিরাড্‌ বভূব।

সমষ্টিজীবোহখিলসৃড বিধাতা গুরুং তমেকাদশমানতাঃ স্মঃ।।১১

তত্ত্বান্তরে জগৎ পরিণত হবে বলে আপন বৃত্তি দ্বারা যিনি হিরণ্যগর্ভাখ্য বিরাট হয়েছিলেন এবং যাঁর সেই মূর্তি হতে অখিল চরাচর বিবিক্ত হয়েছে, তিনি আমাদের একাদশ দিব্যগুরু। তাঁকে আমরা প্রণাম করি।


ওঁ যঞ্জাদিকং চাত্মভবাঃ সুখাপ্ত্যৈ কুর্বন্ত জীবা ইতি যাস্যবৃত্তিঃ।

বেদত্রয়ী কর্মময়ী কিলাজশক্তিং গুরুং দ্বাদশমানতাঃ স্মঃ।।১২

আপন শরীরবস্তুভূত জীব চিরসুখের জন্য যঞ্জাদি সাধিত উপাসনা করবে, এইরকম তাঁর যে বৃত্তি বেদত্রয়ী কর্মময়ী সাবিত্রী নামে প্রসিদ্ধ, তিনি আমাদের দ্বাদশ দিব্যগুরু। তাঁকে আমরা প্রমাণ করি।



https://www.facebook.com/pages/tapobhuminarmada/454528151310191

Monday, September 1, 2014


Cont (Last) ............


তারপর মন্দিরে ঢুকে পাশাপাশি অবস্থিত ভূতনাথ নামে অভিহিত তিনটি শিবলিঙ্গকে আমি আমার মত করে পূজা করতে আরম্ভ করলাম। শিব তিনটিতে জল ঢেলে মার্জনা করছি, এমন সময় দেখলাম ১২ টি বার রকমের পাখী নানারকম শব্দ যথা --- কেউ কিচিরমিচির, কেউ টুংটুং, কেউ টিয়ার মত বুলি, কেউ ট্যাঁ-অ্যাঁ-অ্যাঁ করতে করতে মন্দিরের চারপাশে ঘুরপাক খেতে লাগল। আমি সেই পক্ষীকুলের কলতানের মধ্যে পূজা করতে লাগলাম ভূতনাথের। পূজা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, এমন সময় মুখ তুলে দেখি, 'ঠুক্‌ ঠুক্‌' লাঠির শব্দ করতে করতে মহাত্মা ফিরে এসেছেন। একটি শাল পাতায় মোড়া এক ডেলা ছানা ও তিনটি কলা ভূতনাথের সম্মুখে রেখে ভোগ নিবেদনের ইঙ্গিত করলেন। আর একটি শাল পাতায় মোড়া পৃথক এক ডেলা ছানা নিয়ে তা ভেঙ্গে ভেঙ্গে পাখীদের মধ্যে বিলোতে লাগলেন।


পাখীরা তাঁর হাতের উপর কাঁধের উপর বসে ঠুকরে ঠুকরে খুঁটে খুঁটে খেতে লাগল। আমার ভোগ নিবেদনও শেষ হল, পাখীরাও তাঁর হাতে ছানা খেয়ে উড়ে গেল বনে। একটা জিনিষ লক্ষ্য করলাম, তিনি ভোগ নিয়ে আসার পূর্বে মন্দিরের মধ্যে ঢুকেও কয়েকটা পাখী যত্রতত্র নেচে বেড়াচ্ছিল, কিন্তু তিনি এসে পৌঁছানো মাত্রই সকলে তাঁকেই ঘিরে ছিল। তাঁর হাতের ছানা শেষ হয়ে গেলেও শিবলিঙ্গের সামনে ছানা শাল পাতাতে থাকলেও কোন পাখী স্বাভাবিক প্রবৃত্তি বশে সেদিকে দৃকপাতও করল না।


পূজা ও প্রণাম করে দরজার বাইরে এসে তাঁর পায়ে ফুল চাপিয়ে সাষ্টাঙ্গে ভক্তি নিবেদন করলাম। তখন থেকে মনের মধ্যে একটা প্রশ্ন উঁকি মারছে, ভারোচে ইনি দেখা দিয়েছিলেন কিনা জিঞ্জাসা করি, কিন্তু খুবই অশোভন হবে বলে জিঞ্জাসা করতে সাহস করলাম না। ভাবলাম, একই গান উভয়ের মুখে শুনেছি বলে যে উভয়েই একই ব্যক্তি হবেন, এমন কোন কথা নেই। একই গানের ভাষা দুজন কেন দুশ জনেরও জানা থাকতে পারে!


---- লেও শৈলেন্দ্রনারায়ণজী! ভুতনাথজীকে কা পরসাদী পা লিজিয়ে।


আমার চিন্তাসূত্র ছিন্ন হল। তিনি কিছু গ্রহণ করবেন কিনা বলতে যাবো, এমন সময় তিনি নিজেই বলে উঠলেন --- লেওজী, ইধর বৈঠকে পা লিজিয়ে, করীব এক বাজ গিয়া হোঙ্গে। আপ তো জানতে হো, হম্‌ কুছ্‌ লেতে নেহি।


সশব্দে একটা উদ্‌গার তুলে বললেন --- কয় রোজ পহেলে ভারভূতি মেঁ ভারভূতেশ্বর জী মুঝে জবর দস্তিসে বহোৎ কেলা ঔর নড়াইল খিলায়ে থা। আভি শ' সাল ইসীমেঁ বীত জায়েঙ্গে।


আমার সংশয় মোচন হল, আমি ভূতনাথের প্রসাদ খেয়ে নিলাম।"




ভূতনাথের মন্দির ---

স্মরণাতীতকাল পূর্বে ঐ ভূতনাথের স্থানে একজন শৈব মহাযোগীর তপস্যায় তুষ্ট হয়ে মহাদেব স্বয়ম্ভূলিঙ্গ রূপে প্রকট হন। শিবলিঙ্গ আবির্ভাবের কালে আকাশ মণ্ডল ভেদ করে তাঁর কাছে একটি একাক্ষরী দিব্যমন্ত্র প্রকট হয়। আনন্দে অভিভূত হয়ে সেই মহাযোগী প্রচণ্ড উল্লাসে নৃত্য করতে করতে প্রাণপণে চিৎকার করে ঐ বীজ দুবার উচ্চারণ করেন এবং অপার বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করেন যে, পূর্বোক্ত শিবলিঙ্গের পাশে আরো দুটি স্বয়ম্ভু লিঙ্গ সঙ্গে সঙ্গে প্রকট হয়েছে। জাপ্য মূলবীজকে প্রকাশ্যে উচ্চারণ করায় সেখানে তৎক্ষণাৎ নন্দী, ভৃঙ্গী, বীরভদ্র, ঘণ্টাকর্ণ বহুতর রুদ্রপিশাচের আবির্ভাব ঘটে।


নিয়মবিরুদ্ধ কাজের জন্য চিরতরে তাঁর জিহ্বা স্তব্ধ হয়। তিনি অতঃপর যতকাল জীবিত ছিলেন ততদিন সংকেতে বা লিখে লিখে সমাগত ভক্তদের কাছে মনের ভাব প্রকাশ করতেন। তাঁর তপস্যার প্রভাবে ভূতনাথ মহাদেবের আবির্ভাব ঘটেছিল বলে, তাঁকে লোকে ভূতনাথ বাবা বলে ডাকতেন।


এই মহাযোগীর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল, তাঁর সামনে কেউ এসে পৌঁছালেই সেই ভক্তের মনে এবং জিহ্বায় আপনা হতেই মহাদেবের একাক্ষরী মহাবীজ স্ফুরিত হত।


কালক্রমে তাঁকে কেন্দ্র করেই একটি বিরাট আখড়া গড়ে ওঠে। আখড়ার নাম হয় ভূতনাথ আখড়া। রুখড়, সুখড় এবং অগন নামক আখড়া এই ভূতনাথ আখড়ারই অন্তর্গত। তাঁর সন্ন্যাসী শিষ্যরা কারিগরী কৌশলে ভূতনাথ মন্দিরের চারদিকে সারি সারি গাছ লাগিয়ে "লক্ষ্মৌ এর ভুলভুলাইয়া" নির্মাণ করেছিলেন। সেইসব গাছপালা ক্রমে জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। "লক্ষ্মৌ এর ভুল ভুলাইয়াতে" প্রবেশ করে সাধারণ যাত্রী যেমন বিভ্রান্ত হয়, সঠিক পথ সহজে খুঁজে পায় না, তেমনি ভূতনাথের জঙ্গলে প্রবেশ করে পথ খুঁজে পাওয়া দুঃসাধ্য।


রুদ্রপিশাচ বা ভূত প্রেতাদির গল্প সম্পূর্ণ কুসংস্কার প্রসূত। যেখানে ভূত আছে সেখানে ভূতনাথও আছেন।



https://www.facebook.com/pages/tapobhuminarmada/454528151310191


".......................  বেলা তখন ৮টা বেজেছে। চমৎকার মিষ্টি রোদে হাঁটতে ভালই লাগছে। দূরে দূরে জনবসতিপূর্ণ শস্যশ্যামল গ্রাম দেখতে দেখতে মনের আনন্দে  হেঁটে চলেছি; আনন্দের কারণ আজ হরিধামে পৌঁছে যাব। আজ না নৌকা পেলেও কাল নিশ্চয়ই নৌকা পেয়ে যাব। মহাত্মা পূষণ গিরিজীর ছাড়পত্র অর্থাৎ নৌকার চিঠি ত কাছেই আছে, ভাবনা কি। প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা হাঁটার পর সামনে জঙ্গল দেখে থমকে দাঁড়ালাম। বুকটা ধ্‌ক করে উঠল। ভূতনাথের জঙ্গল।


ভূতনাথের জঙ্গল যেখানে জনশ্রুতি রুদ্রপিশাচের বাস। রুদ্রপিশাচ থাকুন না থাকুন, সকলের মুখে শুনে আসছি এটি ভয়ঙ্কর স্থান! গতবার মোহান্তজীর সঙ্গে নিজেই ত দেখে গেছি, ভূতনাথের মন্দিরে পৌঁছতে কত ঘুরপাক খেতে হয়েছে। সোজা জঙ্গল অতিক্রম করে যাওয়ার উপায় নেই। নিরাপদে সমুদ্র পেরোতে হলে প্রত্যেক পরিক্রমাবাসীকে ভূতনাথের মন্দিরে প্রণাম ঠুকে যেতেই হবে। তা না হলে সমুদ্রে নৌকাডুবি হয়ে যায়। আমি ঝোলা গাঁঠরী পথের উপর রেখে বাবা এবং মা নর্মদার উদ্দেশ্যে প্রণাম জানালাম। জঙ্গলে ত কোন জন্তু জানোয়ারের ভয় নেই, ভয় কেবল বনের গোলক ধাঁধাকে। যা হবার হবে। হর নর্মদে বলতে বলতে ঢুকে পড়লাম বনের ভিতরে।


আমার খুব ভাল করেই মনে আছে, সেবারে একটা অশ্বত্থ ও পরপর তিনটে শিমূল গাছ অতিক্রম করে একটা বড় বেলগাছ এবং আমলকী গাছের আড়ালে কালচে রং এর প্রাচীন মন্দিরটি চোখে পড়েছিল। আমি বনের মধ্যে বেল ও শিমূল গাছের চূড়া লক্ষ্য করে নানারকম লতাপাতা ঠেলে ঠেলে হাঁটতে লাগলাম। কোথাও কোন পথের চিহ্ন খুঁজে পাচ্ছি না। মিনিট পনেরো হাঁটার পর একটা শিমূল গাছের চূড়া দেখতে পেয়ে সেইদিকে দৃষ্টি রেখে হাঁটতে লাগলাম। কাছাকাছি এসে দেখি প্রায় ১০ ফুট ব্যাস যুক্ত গুঁড়িওয়ালা শিমূলগাছ। তার পিছনে অসংখ্য বনপাদপ, নটরাজের মত তাণ্ডব নৃত্যের ভঙ্গীতে শাখা বাহু ছড়িয়ে বনের শোভা বাড়িয়ে দিয়েছে। শোভা দেখার মন এখন নেই। নিরাশ হলাম! কারণ ভূতনাথের মন্দিরের কাছে এত বড় গাছ ছিল না। সেখানে আছে পরপর তিনটি শিমূল গাছ, বেলগাছ ও আমলকী গাছ। যা এখানে ধারে কাছে দেখছি না।


সে পথ ছেড়ে জঙ্গলের অন্য পথ ধরলাম। শিশিরসিক্ত নিস্তদ্ধ বনস্থলীতে কত রকমের বন্য বিহঙ্গের অদ্ভুত সব কূজন শুনতে পাচ্ছি। একটা পথের চিহ্ন দেখতে পেয়ে আশায় বুক দুলে উঠল। এই পথ নিশ্চয়ই ভূতনাথের মন্দিরে পৌঁচেছে। সেই পথের নিশানা ধরে হাঁটতে লাগলাম। হায় ভগবান, এ যে পৌঁছে গেলাম এমন এক জায়গায় যেখানে অনেকখানি অনাবৃত পাথর বেরিয়ে আছে। পাথরের পাশ দিয়ে হেঁটে মিনিট দশেক পরে পৌঁছলাম বনের এমন একপ্রান্তে যেখানে বন ঢালু হয়ে নিচের দিকে নেমে গেছে, সেখানে এখনও কুয়াশা জড়িয়ে আছে গাছপালায়। মনে হচ্ছে ঢালুতে নিচে কেউ বুঝি আগুন দিয়েছে, তার ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠে আসছে জঙ্গলের ভিতরে। এইভাবে এদিকে ওদিকে ঘুরপাক খেতে খেতে অবশেষে হতাশ হয়ে একটা ফাঁকা জায়গা দেখে বসে পড়লাম গাঁঠরীর উপর।


বড় বড় গাছপালার ফাঁক দিয়ে তির্যকভাবে রোদ এসে পড়েছে গায়ে। আমি হতাশ মনে মা নর্মদার ষড়ক্ষরী মূলবীজ জপ করতে লাগলাম। মিনিট পাঁচেক পরে বনের ভিতরে কোথাও থেকে কানে একটা গান ভেসে এল। কান পাততেই ধীরে ধীরে বুঝতেও পারলাম সেই গানের ভাষা ---



মেরে আখন কে দৌতারে,
পিতা-পুত্রী অভিরাম মনোহর
কৈলাস-কণ্টক মেঁ বাঢ়ে

আমি লাফ দিয়ে উঠে পড়লাম। এ যে ভারোচের সেই 'কঙ্কালসার ভক্ষণাসুর' সাধুর কণ্ঠস্বর! আনন্দে মন নেচে উঠল। গানের সুর লক্ষ্য করে গাছপালা মাড়িয়ে হাঁটতে লাগলাম।

শুক শারদ নারদ বলিহারী
মহিমা বর্ণত হারে।
মেরে আখন কে দৌতারে।

গানের ভাষা ও সুর ক্রমশঃ স্পষ্টতর ও নিকটতর হচ্ছে ---

মেরে আখন কে দৌতারে,
রেবা শিবম্‌, শিবম্‌ রেবা
ইয়ে দৌ, রূপ উজারে।

একটা লতার  ঝোপ অতিক্রম করতেই পরপর তিনটি শিমূল গাছ, বেল ও আমলকী গাছের আড়ালে ভূতনাথের মন্দির চোখে পড়ল। দরজার চৌকাঠে বসে আছেন গায়ক। কিন্তু ইনি ত ভারভূতি বা ভারোচের সেই 'ভক্ষণাসুর' সাধু নন। ইনি যে আমার পরম প্রিয় যোগিরাজাধিরাজ প্রলয়দাসজী! আমার হাত থেকে গাঁঠরী, ঝোলা, লাঠি ইত্যাদি খসে পড়ল। মাথা ঘুরে গেল, আমি ধপ্‌ করে মাটিতে বসে পড়লাম। মিনিটখানিক তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমার বিস্ময়ের ঘোর কিছুতেই কাটছে না, ভাবছি ইনিই কি তিনি অর্থাৎ যাঁর একসঙ্গে প্রায় ৮০টা কলা এবং ৮টা নারকেল খাওয়া দেখে রতনভারতীজী যাঁকে 'ভক্ষণাসুর সাধু' বলে অভিহিত করেছিলেন। তাকাবার সময় উভয়েরই চোখ দুটির অদ্ভুত ধরণের মিজিমিজি ভঙ্গিমা ছাড়া আর কিছু দৈহিক সাদৃশ্য ত চোখে পড়ছে না! 

'আমার কাছে উঠে এসে ভূতনাথকে প্রণাম কর। ভৃগুকচ্ছ ত পরিক্রমা করে এলে তাতে আমি খুব খুশী হয়েছি, তবে কিছু অসন্তোষের কারণ ঘটেছে। মূল শ্রীপতি তীর্থে এবং ভূতেশ্বরের শাম্ভবী পীঠে বিশেষতঃ ফেরার সময় ভারভূতেশ্বরের মহাদেবকে মহর্ষি তণ্ডিকৃত মহাস্তবরাজ শুনিয়ে আসা উচিত ছিল। যাই হোক, এখন মধ্যাহ্ন আসন্ন। মধ্যাহ্নক্ষণ ধরে তোমাকে ভূতনাথের পূজা করতে হবে। মন্দিরের মধ্যে ফুল, বেলপাতা, চন্দন সবই আছে। তুমি পূজা করতে বসে যাও। আমি মহাদেবের জন্য কিছু ভোগ সংগ্রহ করে আনছি।' 


এই বলে তিনি লাঠি হাতে নিয়ে কোথাও যাবার উপক্রম করতেই আমি তাঁর পায়ে লুটিয়ে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলাম। 'শিবং ভূয়াৎ' বলে তিনি লাঠি ঠুকে ঠুকে মন্দিরের পিছন দিকে চলে গেলেন। আমি দু'তিন মিনিট হতভম্ব হয়ে বসে থাকলাম।




To be continued...................