Thursday, May 31, 2012

উত্তরা সুষুম্নাই উত্তরাপথ; উত্তরায়ণের পথ; সাক্ষাৎ ব্রহ্মমার্গ:-

Cont..... (Last)


------এই  ত্রিকোণাকার  যোনিমণ্ডল  পরা  প্রকৃতির  চরম পরম 
অবস্থা, এখানেই  প্রণবের অর্ধচন্দ্রাকৃতি  মহানাদ  নিত্যপ্রকট। এই  নাদমুখে  ত্রিভুবনের  মুক্তিদায়ক  সদানন্দময়  সদাশিব  অর্ধনারীশ্বর  রূপে  নিত্যবিরাজিত,


লোকানাং  যুক্তিজনকো  লোকানাং  মুক্তিদায়কঃ।
সদানন্দকরো  দেবশ্চার্ধ নারীশ্বরো বিভুঃ।।

----- এই  অর্ধনারীশ্বরের  জ্যোতিতেই  দিব্য  পিতৃলোক উদ্ভাসিত  আছে। ভগবান অর্ধনারীশ্বরের চিদ্‌বীর্য  প্রাণচৈতন্য  মায়াশক্তির আশ্রয়ে  স্থূলরূপে  যখন  বিকাশোন্মুখ হয়  তখন তা সর্বপ্রথম  বিশুদ্ধ  ব্যোমমণ্ডলে  অনুপ্রবিষ্ট  হয়।

রহস্যময়  সৃষ্টিধারার  ক্রম  বজায়  রাখার  জন্য  প্রকৃতির  বিধানে মাতাপিতা যখন উভয়ে মিলিত হন, তখন তাঁরই চিদ্‌রশ্মি  পঞ্চীকরণের  নিয়মানুসারে  রজোবীর্যের স ংযোগে মাতৃগর্ভে পাঞ্চভৌতিক শরীর গঠনে সাহায্য করে। তারই  পরিণাম  আপন  আপন  মাতাপিতার পুত্রকন্যারূপে  জন্মলাভ।

সচ্চিদানন্দ  অর্ধনারীশ্বরের  ক্ষেত্র  হতে  ঐ  ধারা  নেমে  আসে  বলে  মা-বাবার  আপন  সন্তানের  প্রতি  নিঃস্বার্থ  ভালবাসা  থাকে, তাঁরা  সন্তানের  জন্য  সদাকল্যাণ  তৎপর  হয়ে  থাকেন। পুত্র-কন্যার  পক্ষে  তাই  মাতাপিতার  ঋণ  অপরিশোধ্য।

পুত্রকন্যা  যদি  মাতা-পিতাকে  ঐ  অর্ধ নারীশ্বর  ঞ্জানে  এই  পথে  অর্থাৎ  অর্ধনারীশ্বর ক্ষেত্র  হতে পূর্বোক্ত চিদ্‌রশ্মিপথে
 ( যা  তার  আপন  আঞ্জাচক্রে  রয়ে  গেছে ) ধ্যান  করেন, তবে  ঐ অর্ধনারীশ্বর ক্ষেত্র  সহজেই  উদ্দীপিত  হয়, ঐ  চিদ্‌রশ্মির  টানে  উত্তরণের  পথ  সহজ  হয়। তার  ফলে  অন্তে  সান্দ্র  ব্রহ্মানন্দ  লাভ  হয়। নিজ  জীবনে  কৃতকৃত্য  ও  চরিতার্থ  হওয়ার  এটি  গুহ্যতম  সিদ্ধপথ।

মহাযোগেশ্বরদের  মতে,

ইহস্থাং  ঞ্জাত্বা  নিয়তনিজচিত্তোনরবরো
ন  ভূয়াৎ  সংসারে  ক্বচিদপি  চ  বদ্ধস্ত্রিভুবনে।।

এই  রহস্য  ঞ্জাত  হয়ে  যিনি  নিজ  চিত্ত  এইরূপ  ধ্যানের  পথে  লীন করতে  পারেন,  তিনি  স্বর্গমর্ত্ত্যপাতালের  কোন  স্থানে  আর  আবদ্ধ  হন  না, তাঁকে  আর  স ংসারে  জন্মগ্রহণও  করতে  হয়  না।

আমি  কেবল  প্রার্থনা  করব,

ভগভক্তস্য  তে  বয়ং উদশেমতবাবসা
মূর্ধ্বাং  রায়ঃ  আরভে।। (ঋগ্বেদ)

হে  প্রভু,  হে  বরণীয়  ভর্গদেবতা, এই  পথ  অনুসরণ  করে  জীব  যেন  প্রাণস্রোতের  মূর্ধ্বাতে  উজান  বেয়ে  চলে  যেতে  পারে।।

ওঁ  শিবমস্তু।

Tuesday, May 29, 2012

উত্তরা সুষুম্নাই উত্তরাপথ; উত্তরায়ণের পথ; সাক্ষাৎ ব্রহ্মমার্গ:-

Cont....... (5)


সুষুম্না ও  ব্রহ্মরন্ধ্রঃ---- মস্তিষ্কের পশ্চাৎ ভাগস্থ সুষুম্নাপথে ব্রহ্মরন্ধ্র হতে নিবৃত্তিমূলক শক্তি এবং সম্মুস্থ  সুষুম্নাপথে প্রবৃত্তিমূলক শক্তি আঞ্জাচক্রে আসে বা জাগে। এই নিবৃত্তি ও প্রবৃত্তি শক্তির দুটি ধারাকেই আঞ্জাচক্রের দ্বিদল বলা হয়; ইতর যোগীদের ধারণামত ধ্যানাবস্থায় সত্য সত্য দুই পাঁপড়ি বিশিষ্ট কোন পদ্ম ফুল ফোটে না!

শৈবাগমের ঋষি ঐ আঞ্জাচক্রের মাহাত্ম্য প্রকাশ করতে গিয়ে বলেছেন-

যঃ করোতি সদা ধ্যানম্‌ আঞ্জাপদ্মস্য গোপিতম্‌।
পূর্বজন্মকৃং কর্ম বিনশ্যত্যবিরোধতঃ।।

---যিনি সর্বদাই প্রকৃত আঞ্জাচক্র বা দ্বিদলের ধ্যান করেন, তাঁর পূর্বজন্মকৃত সমূহ কর্ম অবাধে বিধ্বস্ত হয়।

স্বয়ং সদাশিব বলেছেন--- দ্বিদল পদ্মে ধ্যানের মহিমা আমিও সম্যক বলতে পারি না। যে করবে সেই জানবে যে এই ধ্যানের ফলে বিচিত্র বিচিত্র ফল দিব্যানুভূতি ও দিব্যাশক্তি আশাতীত ভাবে লাভ করা যায়।

দ্বিদলধ্যানমাহাত্ম্যং কথিতুম্‌ নৈব শক্যতে।
যঃ করোতি স জানাতি বিচিত্র ফলসম্ভবম্‌।।

ঐ আঞ্জাচক্রের ঊর্ধ্বে মস্তক মধ্যস্থ ব্রহ্মতালু বা ব্রহ্মরন্ধ্রে সহস্রদল পদ্মের বিকাশ স্থল। সহস্র শব্দের অর্থ এখানে অনন্ত। অনন্ত শক্তির আধার বলে এই কেন্দ্রকে সহস্রদল কমল বলা হয়। বিভিন্ন  চক্র, দল, অক্ষর ও দেবতাদিতে যত রকমের শক্তি ও জ্যোতির প্রকাশ আছে, তাদের সমষ্টি-কেন্দ্র এটি।

শূন্যের  মধ্যে  বা  গ্রামোফোন  রেকর্ডের  মধ্যে যেমন শব্দ বা সুরশক্তি অন্তর্নিহিত থাকে, সেইরকম এই  সহস্রদল  কমলের মধ্যে  ব্রহ্মাণ্ড  প্রকাশের  মূলীভূত  দিব্যতেজ নিহিত রয়েছে। এই  কেন্দ্র  উজ্জীবিত  হলে  উদয়কালীন  সূর্যের  মত  শ্বেতবর্ণের  জ্যোতিতে  দীপ্তিমন্ত হয়ে ওঠে। চিত্র মধ্যস্থ  ব্রহ্মতালুতে  সেই  উদয়কালীন  সূর্যবৎ  জ্যোতির  ছটা  দেখানো  হয়েছে।  সহস্রদল কমলের  জাগরণী  পর্ব।

বৈঞ্জানিকরা  বলেন  ঊর্ধ্বাকাশ  হতে  আলোগতি  যখন  ছুটে  আসে  তখন  তার  আকার  ইংরাজী  "ভি" অক্ষরের (V) মত। পূর্ব কথিত  আদ্যাশক্তির তেজও যখন ভূমণ্ডলে প্রকট হয় তখনও তার আকৃতি  দাঁড়ায়  ঐ " ভি" এর মত।


কিন্তু বিদৃতিদ্বার দিয়ে ব্রহ্মরন্ধ্র পথে জীবদেহে ক্রিয়ামান হওয়ার সময় তার গতি হয় উল্টা "ভি" অর্থাৎ 'A'। ঐ তেজ যখন ঊর্ধ্বায়িত হয় অর্থাৎ সাধনার দ্বারা জীবাত্মা ঊর্ধ্ব পথে অগ্রসর হলে সেই জীবাত্মা-জ্যোতির রূপ হয় 'V' এর মত। এটি যোগীর উত্তরায়ণের পথে উত্তরণ পর্ব। চিত্র  মধ্যস্থ  যোগীর ব্রহ্মরন্ধ্রে যে জ্যোতি মণ্ডিত 'V' এবং চারদিকে ছটার মণ্ডল দেখানো হয়েছে, তা উপর্যুক্ত তত্ত্বেরই সূচক।


এখানে স্থূলদেহের মস্তিষ্ক প্রদেশের চিত্র দেখিয়ে তত্ত্বটি পরিস্ফুট করার চেষ্টা করছি বটে কিন্তু সহস্রারাদি দিব্যকেন্দ্র প্রকৃতপক্ষে বিশুদ্ধব্যোম মণ্ডলে বিরাজিত। শিবস ংহিতার ভাষায়,


অতঊর্ধ্বং দিব্যরূপং সহস্রারং সরোরুং
ব্রহ্মাণ্ডাখ্যস্য দেহস্য বাহ্যে তিষ্ঠতি মুক্তিদম্‌।।

--- আঞ্জাপদ্মের ঊর্ধ্বদেশে ঐ দিব্যসহস্রদল কমল, ব্রহ্মাণ্ডাখ্য এই দেহের বহির্দেশে বিদ্যমান। অর্থাৎ এই  কেন্দ্রের বিস্তারের মধ্যেই স্থূলদেহ। এই কেন্দ্র পরম নির্বাণের স্থান।

তস্য  মধ্যান্তরালে  শিবপদমমলং
শাশ্বতং  যোগিগমনং,
নিত্যানন্দাভিধানং পরমবোধিপদং
শুদ্ধবোধপ্রকাশং।
কেচিদ্‌  ব্রহ্মাভিধানং  পদমতি  সুধিয়ো
বৈষ্ণবং তল্লপন্তি,
কেচিৎ হংসাখ্যমেতং  কিমপি সুকৃতিনো
মোক্ষবর্ত্মপ্রকাশং।।

---সারমর্ম হল, যাঁরা শৈব তাঁদের কাছে ঐ স্থানই পরমশিবপদ কৈলাসক্ষেত্র, যোগীদের কাছে চিরায়ত আনন্দের শান্তিবন তূরীয় ব্রহ্মপদ, সুধী বৈষ্ণবদের নিকট বিষ্ণুর পরম অব্যয়পদ, রামভক্তদের কাছে সাকেতভূমি অযোধ্যা, শাক্তদের কাছে মহাশক্তিপীঠ, নাথ ও সিদ্ধদের নিকট ঐটিই হ ংসপদ, আবার কোন কোন সুকৃতিমান্‌ ব্যক্তি একে মোক্ষপদের দ্বার বলে কীর্তন করেন।

আঞ্জাচক্রের কিঞ্চিৎ ঊর্ধ্বে অথচ সহস্রদল কমলের কিঞ্চিৎ অধোভাগে নিষ্কলঙ্ক সুধাস্রাবী চন্দ্রমণ্ডল আছে। এই চন্দ্রমণ্ডলের অন্ত হতে মধ্যভাগ পর্যন্ত এক আনন্দময় দিব্যস্থানে বিদ্যুদাকার এক ত্রিকোণ যন্ত্র আছে---

ত্রিকোণং  তস্যান্তঃ  স্ফুরতি  চ  সততং  বিদ্যুদাকাররূপং।


To  be  Continued...........

Friday, May 25, 2012

উত্তরা সুষুম্নাই উত্তরাপথ; উত্তরায়ণের পথ; সাক্ষাৎ ব্রহ্মমার্গ:-

Cont...... (4)


ঋষিদের মত আজকাল বৈঞ্জানিকরাও স্বীকার করছেন যে সৃষ্টির মূলে স্পন্দন--Vibration, Sound বা শব্দ। স্পন্দনের মাত্রা (Wave-length) এবং ঘনত্বের (Pitch) তারতম্যানুসারে জগতের বিভিন্ন পদার্থের সৃষ্টি। সৃষ্টির মূল কারণীভূত স্পন্দনের মাত্রা ও ঘনত্বের অন্তর্নিহিত জীবনী বা তেজশক্তিই এক একজন দেবতা।


বেদঞ্জানবিরহিত তথাকথিত সাধু যোগী তান্ত্রিক ও পুরাণের বর্ণনানুসারে দেবতারা বর্তমানে ভক্তদের কাছে মানবাকৃতি হয়ে পড়লেও উপরের গূঢ় রহস্য মনে রেখে ঋগ্বেদে দেবতার অন্য নাম দেওয়া হয়েছে---স্পন্দ্রা। স্পন্দ্রা মানে স্পন্দনের অন্তর্নিহিত অগ্নি তেজ বা প্রাণশক্তির "র" অর্থাৎ প্রকাশ বা বিস্তৃতি।


জীবনীশক্তির (Energy) ক্রিয়ায় সর্বদাই দুটি রূপ অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত থাকে--- পুরুষ (Static) ও প্রকৃতি (Dynamic), সুতরাং দেবতারা বেদের ভাষায়---'সযোষা', যোষিৎ বা স্ত্রী সহ; সেই জন্যই শক্তি সহ শিব, মাতাসহ পিতা, অঙ্গাঙ্গীভাবে অর্ধনারীশ্বর। মাতাপিতাকে অর্ধনারীশ্বর, একত্রে শিব শিবানী বলে বর্ণনা করা হয়েছে। মাতাপিতার প্রত্যক্ষ সেবা পরিচর্যা দ্বারা দেহমল, মনমল, চিত্তমল শোধন হয়, সেই সঙ্গে তাঁদেরকে জীবন্ত ঈশ্বর-ঈশ্বরী ঞ্জানে প্রকৃত আঞ্জাচক্রে ধ্যান জপ করলে চিতিশক্তির জাগরণ অবশ্যম্ভাবী।


বিশ্ব সৃষ্টির আদি কারণ ঐ বিদ্যুৎরূপা শক্তির লহর বা ঢলের উত্তরণ ও অবরোহন কিভাবে প্রতি বস্তুতে ছন্দায়িত হয়ে উঠছে, তার কতকটা সাদৃশ্য সমুদ্রের ঊর্মিমুখর ঢেউ দেখলে অনুমান করা যায়। সমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করলেই দেখতে পাবেন অজস্র ঢেউ অনবরত উঠানামা করছে, তটভূমিতে এসে আছড়ে পড়ছে।ঐ বিদ্যুৎরূপা মহাশক্তির সৃষ্টিবিক্রিয়ারও বিরাম নাই।


সমুদ্রের তরঙ্গ প্রথমতঃ হাতের কনুই ভাঙার মত ঊর্ধ্বে উত্থিত হয়ে নিম্নে পতিত হয় অর্থাৎ তার গতি ভঙ্গিমাটি ভুজের মত গমন করে অর্থাৎ ভুজগ; তর্‌তর্‌ করে গড়িয়ে স ংস্কৃত ভাষায় সুপ্‌ করে অগ্রসর হয়, তাই এর এক নাম সর্প (সুপ ধাতু হ'তে নিষ্পন্ন, বিদ্যুৎরূপা ঐ মহাতেজের লহর  সুপ্‌ধর্মী)।


সমুদ্রের ঢেউ গর্জে উঠে অগ্রসর হওয়ার সময় কুণ্ডলী পাকায়, ঐ দিব্যশক্তির খেলাও তদ্রূপ, সেইজন্য তার নাম দেওয়া হয়েছে কুণ্ডলিনী বা হ্বার। সমুদ্রের  জলে যেমন কুণ্ডলী পাকিয়ে স্প্রিং এর মত সহসা তড়াক্‌ করে লাফিয়ে উঠে সেইরকম ঐ আদ্যাশক্তির চিদ্‌ধারাও কুণ্ডলী পাকিয়ে স্প্রিং এর ঊর্ধ্বে নর্তনশীলা হয়ে স্থুল সুক্ষ্ম কারণ জগতের সমূহ বস্তু সৃষ্টিও নিয়মন করে চলেছে। সেইজন্য এর অপর নাম----পৃদাকু।


দূর প্রান্তের পরিধি পর্যন্ত সমুদ্রের ঢেউ এগিয়ে যায় সত্য কিন্তু জল যেখানে ছিল সেইখানেই থাকে, জল এ গিয়ে যায় না।আদ্যাশক্তির ধারাও সৃষ্টির স্তরে স্তরে উছল হয়ে উঠলেও তা কোন মতেই সৃষ্টির যে ঋতম্‌, বা ছন্দ তা লঙ্ঘন করে না, অতিক্রম করে না, এগিয়ে যায় না--ন+আগ=নাগ।


বাস্তব জগতে সর্প নামক জীবের  চলন-গমনে এই সমস্ত ধর্ম দেখা যায়, তাই ঐ মহাচৈতন্যের ধারাকে ভুজগা, নাগ, কুণ্ডলিনী প্রভৃতি আখ্যা দেওয়া হয়েছে; অননুভবী ও মূর্খদের কল্পিত ধারানুযায়ী সত্য সত্যই মানুষের Spinal Cord এর মধ্যে লিঙ্গমূলে ঐ রকম কোন সর্পাকৃতি বস্তু সুপ্তাবস্থায় পড়ে নাই।


যাঁরা বৈদিক মহাযোগে সিদ্ধকাম কিংবা যাঁরা বেদাধ্যায়ী তাঁরাই সবাই জানেন, আদ্যাশক্তি বা ত্রিজগৎব্যাপ্ত ঐ মহাচিতিশক্তির  খেলা অন্তদৃষ্টিতে লক্ষ্য করেই ঋগ্বেদের ঋষি সূর্য রশ্মির অন্তর্নিহিত তড়িৎশক্তিকে 'সসর্পরী বাক্‌' বলে বন্দনা করেছেন। অর্থববেদেও অগ্নি, ওষধি, জল ও বিদ্যুৎজাত সৃপধর্মী তেজ বা তড়িৎকণার মহিমা প্রকাশ করতে গিয়ে বলা হয়েছে,


সসর্পরী  বহুধা  মহান্তি
মর্ত্ত্য  অমর্ত্ত্যেন  স  যোনিঃ।।

----ঐ সৃপধর্মী দিব্যতড়িৎ কণাই মর্ত্ত্য ও অমর্ত্ত্যলোকের মূল সৃজনীধারা, তার দ্বারাই সৃষ্টি ঐশ্বর্য বহুধা বিকশিত হয়।

ঋষিরা তাঁদের দিব্য অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে যে সব রহস্যময় পারিভাষিক শব্দ ব্যবহার করেছেন তার নিগূঢ় অর্থবোধও হওয়া চাই।আঞ্জাচক্র হতে সহস্রারের মধ্যেই এই মহাপিতৃযাগ বা পিতৃসাধনার সুরু এবং শেষ।


মহাত্মা গোরক্ষনাথ প্রণীত অমনস্কযোগ, গোরক্ষসিদ্ধপদ্ধতি, শিবযোগ, যোগি-যাঞ্জবল্ক্যম্‌ ধ্যান বিন্দু ও নাদবিন্দু উপনিষদ্‌ এবং আরও বহুতর বেদ মন্ত্রে যে সব তত্ত্বের ইঙ্গিত আছে তা স্বাধ্যায় করলে জানা যায়, মেরুদণ্ডের মজ্জার সঙ্গে যে স্থানে মস্তিষ্কের মজ্জার স ংযোগ আছে সেই স্থানের নামই প্রকৃত আঞ্জাচক্র (ছবিতে চিহ্নিত)।


মস্তিষ্ক মধ্যস্থ ব্রহ্মরন্ধ্র হ'তে নিঃসৃত প্রাণাত্মার চিদাত্মক ঞ্জানশক্তি এই কেন্দ্র হতে নিয়মিত (Controlled & regulated) হয়ে স্থূল শরীরে আসে বলেই ঐ কেন্দ্রের নাম আঞ্জাচক্র। সুষুম্না এই স্থান হতে দুভাগ হয়ে ব্রহ্মরন্ধ্রে গিয়েছে।


আঞ্জাচক্র হতে সম্মুখস্থ ললাট প্রদেশের অভ্যন্তর পথে অর্ধবৃত্তকারে বেঁকে ব্রহ্মরন্ধ্রের কাছে তার একটি মুখ, অপর মুখটিও অর্ধবৃত্তাকারে বেঁকে ব্রহ্মরন্ধ্রের অপর পাশে গিয়ে ঠেকেছে বটে তবে সেটি গিয়েছে আঞ্জাচক্রের পেছন দিক দিয়ে।এই উভয় পথই শূণ্য-নালী অর্থাৎ আকাশময়।


ব্রহ্মতালুদেশে সুষুম্নার ঐ দুইমুখের মধ্যস্থলে ব্রহ্মরন্ধ্র। ব্রহ্মরন্ধ্রের অর্থ, যে রন্ধ্র বা ছিদ্র দিয়ে ব্রহ্মমার্গে জীবাত্মার উৎক্রমণ ঘটে, কিংবা যে রন্ধ্র দিয়ে পরমাত্মা শরীরস্থ সীমায়িত স্থানে এসে জীবাত্মারূপে প্রকট হন।


ঐতরেয় উপনিষদে এই তত্ত্ব বিশদীকৃত করতে গিয়ে বলা হয়েছে, সৃষ্টিকর্তা মাতৃগর্ভস্থ  শিশুর তালু ভঞ্জ্‌ বা বিদীর্ণ করে তন্মধ্যে প্রবিষ্ট হ'য়ে জীব রূপে প্রতিভাত হন। ব্রহ্মরন্ধ্রের সূক্ষ্মস্থানে এই বিদারণ ক্রিয়া হয়, তাই তার নাম বিদৃতিদ্বার। ভঞ্জ করে আসেন বলে তাঁর নাম---ভগ। ঋগ্বেদে তাই প্রাচীন আদি দেবতার নাম ভগ, এখন বলা হয় ভগবান।


To  be  Continued.........

Wednesday, May 23, 2012

উত্তরা সুষুম্নাই উত্তরাপথ; উত্তরায়ণের পথ; সাক্ষাৎ ব্রহ্মমার্গ:-

Cont...... (3)


স্বামী বিবেকানন্দ প্রণীত রাজযোগ, কলিকাতা হাইকোর্টের ভূতপূর্ব প্রধান বিচারপতি স্যার জন উড্‌রফ প্রণীত The Serpent Power প্রভৃতি পুস্তক ছাড়াও আর ও বহুবিধ তান্ত্রিক, হঠযোগী, স্বয়ংসিদ্ধযোগী হবুযোগীদের রচিত পুস্তক এমন সব ছবি প্রচারিত হয়েছে যে, যোগাভ্যাসী মাত্রেই ধারণা সার্দ্ধ ত্রিবলয়াকারা কুণ্ডলিনী লিঙ্গমূলে সর্পাকৃতি হয়ে ঘুমিয়ে রয়েছে। যোগের দ্বারা তা জাগবে এবং শির্‌ শির্‌ করে চক্র হতে চক্রান্তরে উঠে ব্রহ্মরন্ধ্রে গিয়ে ঢুকবে।সে সব ছবির কী বাহার! কুণ্ডলী-পাকানো একটি সাপ শিরদাঁড়ার ভিতরে ফোঁস ফোঁস করে উঠছে! আর পদ্মগুলি ফুটে উঠছে, কোনটিতে চারটি পাঁপড়ি, কোনটিতে ছয়টি, কোনটিতে দশটি, কোনটিতে দুটি!


ঐ ঐ শব্দের বৈদিক অর্থ সম্পূর্ণ ভিন্ন! বেদে সসর্পরী বাক্‌, সর্প প্রভৃতি শব্দের উল্লেখ আছে বটে, কিন্তু বেদঞ্জান বিরহিত অননুভবী তথাকথিত যোগীদের ধ্যান ধারণা সে পথ ধরে চলে নি।যোগচিন্তাপথে যে সব চক্র বা আধ্যাত্মিক কেন্দ্র উদ্ভাসিত হয়, সেগুলির অবস্থান বিশুদ্ধব্যোম মণ্ডলে।


আপনার ঘরের দেওয়ালে ভারতের একটি মানচিত্র দেখিয়ে যদি ছেলেকে বলেন, এই দেখ পশ্চিমবঙ্গ, এই হাওড়া পূর্বদিকে দেখ আসাম, ঐ দেখ উত্তরে হিমালয়, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, তা বললে যেমন আপনার ঘরের দেওয়ালে সত্যি সত্যি ঐ সব স্থান থাকে না, তেমনি অনুভবসিদ্ধ যোগীরা সাধরণভাবে আধ্যাত্মিক তত্ত্ব বুঝাতে গিয়ে বলেছেন----


If this be the lowest plexus Muladhar, then this is the highest i.e. Sahasrar. সত্যি সত্যি দেহের মধ্যে ঐ সব চক্র বা সর্প নাই।


জীবের মধ্যে যে চৈতন্য ধারা নখাগ্র থেকে কেশাগ্র পর্যন্ত ব্যাপ্ত হয়ে রয়েছে তার কেন্দ্রস্থল, সেই ধারার accumulating centre আঞ্জাচক্র নামে অভিব্যক্ত।ধ্যানবিন্দু উপনিষদের মতে ঐটাই যদি জীবাত্মা, রুহ্‌ বা সুরতের স্থান হয় অ র্থাৎ আপনার 'আপনি' যদি ঐখানে থাকে তাহলে তার ঊর্ধ্বের পথে অভিসার ঐখান থেকেই হবে! মনে করুন, একটি সাততলা অট্টালিকার উচ্চতম তলায় আপনার বাবা আছেন, আপনি আছেন ছয় তলায়, বাবার সঙ্গে দেখা করার জন্য আপনি কি নীচতলায় নেমে এসে পুনরায় প্রত্যেক তলায় সিঁড়ি ভেঙে সাত তলায় যাবেন?


আঞ্জাচক্রে ধ্যান বলতে প্রায় প্রত্যেকেই ভ্রূদ্বয়ান্তর্বতী স্থানকে বোঝেন, তাই সকলেই চোখ বন্ধ করে ঐ স্থানে ধ্যান জপ করেন।কিন্তু ঐ স্থান আঞ্জাচক্র নয়, চিত্রে প্রদর্শিত বৃত্ত মধ্যস্থ ক্রশ চিহ্নে চিহ্নিত স্থানটিই আঞ্জাচক্র, যোগী বা যোগাভ্যাসীর প্রকৃত হৃদয়।


এই চিত্রে চিহ্নিত স্থানেই ধ্যান করে পিতৃসাধনা সুরু হয়, কিছুদিন অভ্যাস করলেই দিব্য জ্যোতির প্রকাশ ঘটে। এই জ্যোতি হঠযোগী ক্রিয়াযোগী তান্ত্রিক প্রভৃতি আবিষ্কৃত চোখ-কান টেপা, ন্যাস প্রাণায়াম কুম্ভকের কুহেলিকা নয়, মায়া কী প্রাঙ্গন মেঁ মজ়ে কা খেল্‌ নয়, কোন বাহ্যিক ক্রিয়া প্রক্রিয়ার প্রহেলিকা নয়, এই জ্যোতিই প্রকৃত চৈতন্য রাজ্যে প্রবেশের ছাড়পত্র।


বেদানুসারী যোগসন্ধ্যাধৃত বচনটি  হল---


অকল্পিতোদ্ভবং জ্যোতিঃ স্বয়ং জ্যোতিঃ প্রকাশিতম্‌
অকস্মাৎ দৃশ্যতে জ্যোতিস্তৎ জ্যোতিঃ পরমাত্মনি।

যে জ্যোতি বিনা কল্পনায় বিনা প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন হয়, যে জ্যোতি স্বয়ং প্রকাশিত হয় এবং যে জ্যোতি হঠাৎ দেখা যায়, সেই জ্যোতি পরমাত্মার জ্যোতি। এই পরমাত্ম-জ্যোতিতেই পিতৃলোক উদ্ভাসিত।

বিঞ্জানাচার্যদের আচার্য ঋষি আইনষ্টাইন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিকারিণী প্রকৃতি শক্তির লীলাবিলাস বর্ণনা করতে গিয়ে সঙ্কেতে বলেছেন, 

E=(MC)squre; E= শক্তি (Energy), M= পদার্থ (Mass), C= আলোর গতি (Velocity of light)।

তাঁর সাঙ্কেতিক ফরমূলার সরল অর্থ, আদ্যাশক্তি আলোগতি রূপে বিভিন্ন অনুপাতে প্রত্যেক পদার্থে সন্নিবিষ্ট আছেন।প্রত্যেক পদার্থই আদ্যাশক্তির বিভিন্ন রূপ।

গীতায় এই কথা বলতে গিয়ে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন---


 "মমৈবাংশো জীবলোকে জীবভূতঃ সনাতনঃ"। 


অংশ বলতে সবাই বোঝেন ভাগ। কিন্তু পূর্ণের কোন ভাগ বা খণ্ড হয় না। অংশ অর্থে অংশু বা কিরণ, বৈদিক পরিভাষায় স্ফুরজ্যোতিঃ। সকল জীবই সেই একই ব্রহ্মশক্তির স্ফুরিত জ্যোতির ধারা মাত্র।

বেদের মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি দীর্ঘতমা আরও সুন্দরভাবে ঐ তত্ত্ব পরিস্ফুট করতে গিয়ে বলেছেন, ঐ আদ্যাশক্তি--- "সা চিত্তিভিনি হি চকার মর্ত্তং বিদ্যুদ্ভবন্তী প্রতি ব্রবিম্‌ ঔহৎ"। 

অর্থাৎ তাঁর চঞ্চল গতি সমূহের চরণপাতে অর্থাৎ স ংঘাতে সৃষ্ট প্রত্যেক মর্ত্যজাত পদার্থের মধ্যে বিদ্যুৎরূপা হয়ে নিজের স্বরূপ উদ্‌ঘাটিত করে দেন।


আইনস্টাইন যাঁকে বলেছেন আলোগতি, বৈদিক-বৈঞ্জানিক দীর্ঘতমা তাঁকেই বলেছেন---বিদ্যুৎগতি। সঙ্কেতে এই শক্তির সৃষ্টি-প্রক্রিয়া বর্ণনা করার সময় বৈদিক ঋষি তথা বৈঞ্জানিকরা বিভিন্ন স্তরের স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্য প্রকাশের জন্য নানা বর্ণাত্মক অক্ষর ব্যবহার করতেন,সেইগুলিকে বর্তমানে বীজমন্ত্র বলা হয়। যার অন্তনির্হিত তাৎপর্য না বুঝেই লক্ষ লক্ষ ভক্ত নিরন্তর জপ করে চলেন।


যেমন একটি বীজ মন্ত্র, ধরুণ---হ্রীঁ। একে রূপকভাবে মায়াবীজ, ভুবনেশ্বরী বীজ ইত্যাদি বলা হয়। আসলে এর তাৎপর্য হল----আকাশ তত্ত্ব (হ) এর সঙ্গে প্রাণাগ্নিশক্তি (র) যুক্ত হয়ে সম্বিদ্‌ক্ষেত্র বিন্দুতে (ঁ) অর্থাৎ উর্ধ্বের পথে তার কেন্দ্রমুখীন্‌ যে অগ্রগতি বা অভিসার, ঐ বীজ তারই সূচক। চিত্রপদর্শিত প্রকৃত আঞ্জাচক্রে জপ ধ্যান করলে তবে মহাচেতন সমুত্থানের পথে অগ্রগতি সম্ভব হবে।


উপরে এই যে বিদ্যুৎরূপা শক্তি, বা চৈতন্যধারার কথা বলা হয়, ঐ শক্তি বৃত্তধর্মযুক্তা, বৃত্তধর্মসৃষ্টিকারিণী অর্থাৎ বৃত্তকারে ঐ তেজের ঢল নেমে আসে, বৃত্তকারেই কেন্দ্রীভূত হয়। একথা সবাই জানেন, একটি বিন্দু কেন্দ্রকে আশ্রয় করে প্রসারতা লাভ করলে একটি বৃত্ত হয়।


বৃত্তের সাধারণতঃ পরিধি পর্যন্ত সর্বাঙ্গের প্রত্যেকটি বিন্দু পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত থাকে আবার কেন্দ্রের সঙ্গেও যুক্ত থাকে।বৃত্তের সাধারণ ধর্ম বহির্মুখী (Centrifugal) হলেও এর প্রত্যেকটি অঙ্গ-বিন্দুযুগপৎ কেন্দ্রোন্মুখীও (Centripetal) হয়, যুগপৎ চর ও অচর।


শব্দ বা বাক্‌ অর্থাৎ স্পন্দন (Vibration) বৃত্তকারে চরাচর বিশ্বভুবনময় বিস্তারিত হওয়ার ফলেই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের সব কিছু পদার্থের সৃষ্টি হয়েছে। সৃষ্টি-বিঞ্জানের রহস্যই এই। প্রত্যেক পদার্থ ঐ তেজ বিদ্যুৎ বা শক্তির তরঙ্গ ভিন্ন আর কিছু নয়।প্রত্যেক তরঙ্গের মধ্যে পূর্বোক্ত আদিশক্তি বিদ্যুৎরূপে অবস্থিত। সুতরাং একথা স্পষ্ট হল যে ঐ শক্তি বিদ্যুৎরূপা হয়ে বৃত্তধর্মী তরঙ্গ রূপে এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড সৃজন ও পরিচালনা করছেন। চিত্র প্রদর্শিত মস্তিষ্কগ্রন্থিতে বৃত্তচিহ্ন দ্বারা সেই তত্ত্বটিকে সূচিত করা হয়েছে।


To  be  Continued..........

Monday, May 21, 2012

উত্তরা সুষুম্নাই উত্তরাপথ; উত্তরায়ণের পথ; সাক্ষাৎ ব্রহ্মমার্গ:-

Cont..... (2)


এবার সাধনার কথা আসা যাক। মাথাটা চিৎ করে দিলে যেখানটায় ভাঁজ  বা  টোল খায় সেই স্থানটিকে মস্তকগ্রন্থি বলে। এইখানে আঞ্জাচক্রের কেন্দ্র।বৃত্তমধ্যস্থ ক্রশ চিহ্নের দ্বারা চিত্রে এই স্থানটিকে সূচিত করা হয়েছে।ধ্যানবিন্দু উপনিষদের ঋষির উপলব্ধি, এই স্থানটিই আত্মার অধিষ্ঠান ক্ষেত্র--- হৃদিস্থানে আঞ্জাচক্রং বর্ততে। তন্মধ্যে রেখাবলয়ং কৃত্বা জীবাত্মরূপ ং জ্যোতিরূপমণুমাত্রং বর্ততে। 


ইতর যোগীরা হৃদয় বলতে বক্ষস্থলের মধ্যস্থলকে বোঝেন এবং তদনুযায়ী ধ্যানের নির্দেশ দেন। ভ্রান্ত নির্দেশ। শ্রীকৃষ্ণ গীতাতে- ঈশ্বরঃ সর্বভূতানাং হৃদ্দেশে অর্জুন তিষ্ঠতি বাক্যে এই আঞ্জাচক্রকে যে প্রকৃত হৃদয় বলেছেন, শ ংকরাচার্য তৎকৃত গীতার ভাষ্যে তা স্পষ্টীভূত করেছেন। আঞ্জাচক্রই প্রকৃত হৃদয় এবং এইটিই আত্মার অধিষ্ঠান ক্ষেত্র। প্রকৃত অধ্যাত্মসাধনা অর্থাৎ আত্মার অধিরোহনপর্ব এখান থেকেই শুরু হয়।


সারা ভারতবর্ষ জুড়ে নানা মঠ মিশন প্রকাশিত ও প্রচারিত নানাবিধ যোগশাস্ত্রের কৃপায় ধর্ম পিপাসু নরনারীর মন কান ঞ্জান ইড়া পিঙ্গলা সুষুম্না, মূলাধার স্বাধিষ্ঠান মণিপুর অনাহত বিশুদ্ধ আঞ্জা ও সহস্রার প্রভৃতি শব্দগুলির সম্বন্ধে বিচিত্র বিচিত্র ধারণা ও সিদ্ধান্ত করে বসে আছে। মহাগুরু মাতাপিতাকে ধরে উচ্চতম আধ্যাত্মিক মণ্ডলে যাবার যে বৈদিক মহাযোগের কথা বৈদিক ঋষিরা ঐ সম্বন্ধে যা বলতেন সেগুলি হল---


To  be  Continued.......

Tuesday, May 15, 2012

উত্তরা সুষুম্নাই উত্তরাপথ; উত্তরায়ণের পথ; সাক্ষাৎ ব্রহ্মমার্গ:-



বেদের নির্দেশ পিতাকে ঈশ্বরঞ্জান।পিতৃমেধ, পিতৃযঞ্জ, মহাপিতৃযঞ্জ, পিণ্ডপিতৃযঞ্জ, পিতৃঅর্চনা প্রভৃতি বৈদিকযঞ্জ পিতৃপূজারই নামান্তর।বৃহদারণ্যক উপনিষদে মনুষ্যলোক, ধ্যান ধারণা ও তপস্যাদি দ্বারা পিতৃলোক এবং বিদ্যাদ্বারা দেব-লোককে জয় করা যায়---


সোহয়ং মনুষ্যলোকঃ পুত্রেণৈব জয্যো নান্যেন কর্মণা, কর্মণা পিতৃলোকঃ, বিদ্যয়া দেবলোকঃ।


এখানে জয়ের অর্থ তৎ তৎ লোকের কর্তব্যকর্ম সাধনার দ্বারা পরিপূর্ণ ও সার্থক করে তোলা।উক্ত শ্রুতিমন্ত্রের ভাষ্য করতে গিয়ে ঞ্জান-ভাস্কর শংকরাচার্য বলেছেন---


তেষাং সোহয়ং মনুষ্যলোকঃ পুত্রেণৈব সাধনেন জয্যঃ জেতব্যঃ সাধ্যঃ।


এই ঋষিবাক্যের উদ্দেশ্যে ও আশয় হল ঘটনাক্রমে যদি পিতার কোন কর্তব্য কর্ম যথা দান, তপস্যা, অধ্যয়ন, সমাজঋণ, দেবঋণ, ঋষিঋণ প্রভৃতি বাকী থাকে, তাহলে তা পূরণ করে পিতাকে ঋণ মুক্ত করা পুত্রের অবশ্য পালনীয় কর্তব্য। সেই সঙ্গে নিজেও পিতৃচিন্তায় বিভোর হয়ে কৃতকৃত্য হতে পারলে তবেই সন্তান 'পুত্র' নামের যোগ্য।


তস্মাৎ---পূরণেন ত্রায়তে স পিতরম্‌ যস্মাৎ তস্মাৎ পুত্র নাম।


পুত্র কেবল সারা জীবন ধরে একতরফাভাবে মাতাপিতার প্রাণঢালা ভালবাসা আদরযত্ন এবং তাঁদের পরিত্যক্ত বিষয় সম্পত্তির উত্তরাধিকার ভোগ করবে, যথেচ্ছভাবে তাঁদের নিঃস্বার্থ ভালবাসার সুযোগ নেবে এমন কোন সার্বভৌম জন্মসত্ত্ব নিয়ে পুত্রকন্যা পৃথিবীতে আসে নি। মাতাপিতার প্রতিও পুত্রকন্যার তীব্র সাধন-সাপেক্ষ কিছু কর্তব্য আছে। পিতার যে সব ছিদ্র অর্থাৎ অপূর্ণতা থাকে তা পরিপূরণ করতে পারলে তবেই পুত্রের পুত্রত্ব----


ইদং তৎ পুত্রস্য পুত্রত্বম্‌, যৎ পিতুশ্ছিদ্রং পূরয়িত্বা ত্রায়তে।


সত্যদ্রষ্টা ঋষিরা বলেছেন মৃত্যুর পর পিতাতে হিরণ্যগর্ভের সমুদয় অমরপ্রাণ প্রবেশ করে অর্থাৎ তখন তাঁর মর্ত্ত্যভাব চলে যায়; তাঁর প্রাণরশ্মি মৃত্যুর পরে হিরণ্য-গর্ভলোকে বিরাজমান থাকে।তাই বৈদিক পিণ্ডপিতৃযঞ্জে পিতার উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভোজ্য বস্তুকে পৃথিবীরূপে এবং পিতাকে তার অধিষ্ঠাতৃদেবতা অগ্নিরূপে ধ্যান করার বিধান আছে।পিতার প্রতি পুত্রের কেবল ঐহিক কর্তব্য নয়, নিজের পূর্ণতার জন্যই পিতাকে কেন্দ্র করে কিভাবে সিদ্ধ সাধনায় ব্রতী হওয়া যায়, বেদ উপনিষদ ঘোষিত সেই পিতৃলোক কোথায়, কিভাবেই বা পিতাকে ধরেই জীব মুক্তি-সরণীতে পদক্ষেপ করতে পারে।


বর্তমানে হিন্দুসমাজে স্মৃতিশাস্ত্র ও পুরাণের (বায়ুপুরাণ, গরুড়-পুরাণ প্রভৃতি) বিধান অনুসারে মাতৃপিতৃশ্রাদ্ধ কালে পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে কুশের উপর পিণ্ডদানাদির যেমন ঘটা দেখা যায়, বৈদিক ধারণায় এই সব আচার অনুষ্ঠানের বিধি বিধান ছিল না।


পালি সাহিত্যে স ংস্কৃত শ্রাদ্ধ কথাটির অনুরূপ শব্দ পাই 'সদ্ধ'।


এই সদ্ধ শব্দটির অর্থ বৌদ্ধ ধারণায় মৃত আত্মীয়ের উদ্দেশ্যে ব্রাহ্মণ গণকে খাদ্য ও অন্যান্য বস্তুদান রূপ প্রেতকৃত্য।


বর্তমান হিন্দুসমাজে প্রচলিত শ্রাদ্ধ-ব্যবস্থায় তার ছায়া পড়েছে।মৃত মাতাপিতার উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা নিবেদনের একটি উপায় হিসাবে দেখলে এতে কোন আপত্তি করার কারণ দেখি না।


কিন্তু নিজের তথাকথিত Status বজায় রাখা এবং নিজ অহ ং-এর স্ফুর্ত্তি ও পূর্ত্তি সাধারণতঃ ঐ সব অনুষ্ঠানের প্রধান অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে আজকাল।


মাতা-পিতার জীবদ্দশায় যে নারকীপুত্র শ্রদ্ধা ও প্রেমবশতঃ তাঁদের সেবাপূজা করল না,তাঁদের দেহান্তের পরেই দেখি তারা শ্রাদ্ধের ঘটা করতে কুণ্ঠিত হয় না। একে প্রহসন ছাড়া আর কি বলা যায়?
বেদে সরাসরি শ্রাদ্ধ শব্দটি না থাকলেও বৈদিকযুগে এমন কি বৌদ্ধযুগের অব্যবহিত পূর্ব পর্যন্ত মাতাপিতার সেবাপূজাকেই পবিত্রতম যঞ্জ এবং পুত্রের অবশ্য প্রতিপাল্য কর্তব্য এবং সাধনার শ্রেষ্ঠ অঙ্গ হিসাবে বিবেচনা করা হত।


অনেক পণ্ডিতের মতে মহর্ষি পাণিনির আবির্ভাব বৌদ্ধ-পূর্ব-যুগে।
তিনি তাঁর বিখ্যাত অষ্টাধ্যায়ী সূত্রে শ্রাদ্ধ শব্দ ব্যবহার করেছেন। সূত্রটি হল-----


'শ্রাদ্ধম্‌ অনেন ভুক্তম্‌ ইণি ঠনৌ'।

এর অর্থ 'অনেন ভূক্তম্‌' এই অর্থে শ্রাদ্ধ শব্দের উত্তরে ইণি ও ঠন্‌ প্রত্যয় হয়। অনেন ভূক্তম্‌ মানে পিতার দ্বারা ভূক্তম্‌ অর্থাৎ মাতাপিতার ভোজন ক্রিয়া; সযত্নে জীবিত মাতাপিতাকে ভোজন করাতে হবে, নিজ হাতে সেবা পরিচর্যা করতে হবে।

পাণিনিরও পূর্ববর্তী মহাকবি ভাসের প্রতিমা নাটকের পঞ্চম অঙ্কে শ্রাদ্ধ শব্দটির প্রয়োগ আছে--- শ্রদ্ধয়া দত্তম্‌ শ্রাদ্ধম্‌। প্রচেতা রচিত শ্রাদ্ধকল্প নামক গ্রন্থের নামও এই নাটকে দেখতে পাওয়া যায় অর্থাৎ মহর্ষি প্রচেতার যুগেও মাতাপিতাকে ভক্তি ভরে সেবা পূজা, তাঁদের সর্ববিধ ইচ্ছার পূরণ, সর্বতোভাবে তাঁদেরকে সুখী ও তৃপ্ত করাকেই শ্রাদ্ধ হিসাবে গণ্য করা হত।

"জ্যান্তে দিল না ভাত কাপড়, মরলে করবে দান-সাগর"----

এ ধরণের জঘন্য রীতিকে শ্রাদ্ধ হিসাবে বৈদিক যুগে গণ্য করা হত না।
জীবিত মাতাপিতার সেবাপূজার পরিবর্তে তাঁরা মারা গেলে যে তথাকথিত শ্রাদ্ধপর্ব তার কোন মূল্য নেই।

কোন ব্যক্তি জীবিত না থাকলে তাঁর সেবা পূজা সম্ভব হয় না। সেব্য ও সেবক মিলিত হলেও তবেই সেবকের পক্ষে সেবা করা সম্ভব হয়। স্বামী দয়ানন্দ তাঁর ঋগ্বেদের ভাষ্য ভূমিকাতে বলেছেন---

"সেব্যসেবকসন্নিকর্ষাৎ সর্বমেতৎ কর্ত্তুং শক্যতে ইতি"।।

সারকথা জীবিত মাতাপিতার প্রত্যক্ষ সেবাপূজা করাই মুখ্য সাধনা।
জীবিত মাতাপিতার সেবা পরিচর্যা ছাড়া তাঁদের জীব্দদশাই এবং তাঁরা গত হলেও এমন একটি সিদ্ধ উপাসনা পদ্ধতি আছে, এমন এক সিদ্ধ মাতৃপিতৃবীজমন্ত্র আছে, যা সাধনা করলে ইষ্ট সাক্ষাৎকার হয়ে থাকে।

মাতাপিতার জীবিত থাকাকালে তাঁদেরকে উপেক্ষা করে তাঁদের মৃত্যুর পর শ্রাদ্ধের ঘটা করা যেমন ভাবের ব্যাভিচার, তেমনি প্রত্যক্ষ সেবা পরিচর্যার পরিবর্তে অত্র প্রদর্শিত পন্থায় কেবল ধ্যানাসনে বসে ধ্যান জপ করলে তা বন্ধ্যা প্রহসনে পর্যবসিত হতে বাধ্য।

To  be  Continued........