মন্ত্রদাতা ঞ্জানদাতা
তাঁরে বলি গুরু,
সদ্গুরু সেই যাঁহা হতে
ব্রহ্মদর্শন শুরু।
স্থিতি ভেদে সংঞ্জা ভেদে
সুকৃতিতে মিলে
মহাগুরু মাতাপিতার
জন্ম হতেই কোলে।।
পিতা ও মাতা একত্রে শিব-শিবানী অর্থাৎ অর্ধনারীশ্বর।
"মাতাপিতাই শ্রী-শ্রীপতি
উমা মহেশ্বর,
মাটির মূর্ত্তি ছেড়ে রে মন,
তাঁদের চরণ ধর।।"
"জগত পিতরৌ বন্দে পার্বতীপরমেশ্বরৌ।
কালিদাসেন যদুক্তং পিত্রোস্তদনুভূয়তে।।"
মহাকবি কালিদাস তাঁর রঘুবংশম্ নামক মহাকাব্যে জগতের আদি মাতাপিতা পার্বতী ও মহেশ্বরকে শব্দ ও অর্থের ন্যায় সংপৃক্ত, নিত্যসম্বন্ধ যুক্ত ('বাগর্থাবিব সম্পৃক্তৌ') ঞ্জানে বন্দনা করেছেন।
মহাকবির ধ্যানদৃষ্টিতে এই রূপটি শাস্ত্রোক্ত অর্ধনারীশ্বরের রূপ। 'অর্ধনারীশ্বরেণ যৎ, আম্নাতং পিতরৌ মম'। দিব্যভূমিতে যিনি অর্ধনারীশ্বর, মর্ত্তভূমিতে তিনিই মাতাপিতারূপে প্রত্যেকের ঘরে ঘরে বিরাজিত।।
মাতা:---
'যো মিমীতে মানয়তি সর্বান্ জীবান্ স মাতা' ---
দয়াময় ভগবান যেমন সকল জীবের সুখ ও উন্নতি কামনা করেন, আমাদের জন্মদাত্রীও তেমনি নিঃস্বার্থভাবে নিজ সন্তানদের সুখ ও শ্রীবৃদ্ধি কামনা করেন। জননীকে মাতা নামে অভিহিত করে ঋষিরা বুঝাতে চেয়েছেন যে,মাতা পরমেশ্বরের সমান ইষ্ট ও উপস্যা।।
অন্যত্র প্রেমের বিরাম আছে, বাধাও আছে, জগতে মাতৃস্নেহই কেবল অবিরত ও অপ্রতিহত; মৃদুলগামিনী ক্ষুদ্র স্রোতস্বতীর মত মাতৃস্নেহ অবিরলধারে সন্তানের জীবনক্ষেত্রে প্রবাহিত হয়ে নিরন্তর তার মঙ্গল সাধনা করে চলেছে। জগতে মাতৃস্নেহই যথার্থ প্রেম, নিঃস্বার্থ প্রেম, উজ্জ্বল স্পর্শমণি, স্বর্গের অমূল্যরত্ন।
মা-ই জীবন্ত প্রত্যক্ষ দেবী। মায়ের যে যথার্থ রূপ, তা অন্তশ্চক্ষুর গোচর, জড়চক্ষু তার দর্শন পায় না। মায়ের আন্তর দেহ চিন্ময়, স্থূল দেহ তার ছায়া মাত্র। আনন্দ তার মুখ, দয়া তার হস্ত, প্রেম তার কাণ্ড, ধৈর্য ও তিতিক্ষা তার চরণ-কমল।
রক্ত যেমন বক্ষস্থল হতে সঞ্চালিত হয়ে বহুবিধ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অবশেষে হস্তপদাদির আকারে আকরিত হয়, মাতৃহৃদয়ের প্রেমও সেইরকম ভিন্ন ভিন্ন অবস্থায় ভিন্ন ভিন্ন আকার ধারণ করে চিন্ময় মাতৃদেহ নির্মাণ করেছে।
এই চিন্ময়ী মূর্তিই যথার্থ মায়ের মূর্তি --- বাইরের জড়মূর্তি তার প্রতিকৃতি মাত্র! যতক্ষণ এই জড়মূর্তি দেখি, ততক্ষণ প্রকৃত মাতৃদর্শন হয় না। চক্ষুদ্বয় নিমীলিত করে যখন অন্তর-রাজ্যে প্রবেশ করি, তখনই মা প্রত্যক্ষ হ'ন, তাঁর অলোক-সামান্য রূপ দর্শনে প্রাণ পুলকিত হয়, দিব্যঞ্জান লাভ হয়।
"বিদৃতি সে মহাদ্বার ব্রহ্মরন্ধ্র পাশে
জীবাত্মা-জনমকালে সহসা বিকাশে।
জঠরে প্রবেশি আত্মা যুক্ত প্রাণ-তারে
ওঁ-ওঁ-ওমা-ওমা স্বতঃই ঝঙ্কারে।
মাতৃপ্রাণ হ'তে রস টানে নিজ প্রাণ তরে
মাতৃপূজা মাতৃসেবা সেই ঋণ শুধিবার তরে।।"
পিতা:---
নমঃ পিত্রে জন্মদাত্রে সর্বদেবময়ায় চ।
নমঃ সদাশুতোষায় শিবরূপায় তে নমঃ।।
শিব ও পিতা দুটি শব্দই সমার্থক, দুজনেই সমান। পিতা = শিব। পিতা অসীম শিবেরই সসীম রূপ। ঘটাকাশ, গৃহাকাশ এবং মহাকাশে যেমন কোন স্বরূপতঃ প্রভেদ নেই। একই আকাশ ঘট ও গৃহের সীমায়িত স্থানে আবদ্ধ থাকায় ঘটাকাশ গৃহাকাশ সংঞ্জা দেওয়া হয় মাত্র। ঘট বা গৃহ ভগ্ন করলে যেমন একই আকাশ থাকে, তেমনি অমর্ত্য শিব যখন মর্ত্য শরীরের আবেষ্টনীতে থেকে আমাদের সামনে ঘুরে বেড়ান, তখনই আমরা তাঁকে পিতা বলি। পিতা ও শিবে স্বরূপতঃ কোন ভেদ নেই, পিতাই শিব।
"তোমার --- তোমার --- আমি হে তোমার
--- প্রতি পরমাণু কহে বারবার,
বাবা, তুমিই আমার নন্দন-সার
সুন্দর প্রেমখনি;
কেশ বেশ ঢেকে আসিয়াছ শিব!
অমৃত-পরশমণি।।"