Tuesday, December 24, 2013



কোথা  আছে  রে, দীন  দরদী  সাঁই!
পিতৃদেবের  ধেয়ান  ধরো
খবর  পাবে  ভাই।
চক্ষু  আঁধার  ভুলের  ধোঁকায়
কেশের  আড়ে  পাহাড়  লুকায়
কি  রঙ্গ  সাঁই  দেখছে  সদাই,
বসে  নিগম  ঠাঁই।
অহরহ  দেখছ  তারে
চেনতে  নারো  ভুলের  ঘোরে
পিতার  মাঝে  পরমপিতা
চিনতে  জানা  চাই।।



যা  পাবে  মায়ের  কাছে, তত স্নেহ  কোথা  আছে?

আর  কারও  প্রেমে  তুমি  ভুলিও  না ভাই,
সে  সব  প্রেমের  সরা, সতর্কে  ওজন  করা
    মা'র  প্রেমে  দরদাম  কষাকষি  নাই।



Wednesday, December 11, 2013



জটাটবী-গলজ্জল-প্রবাহ-প্লাবিত-স্থলে, 
গলেহবলম্ব্য লম্বিতাং ভূজঙ্গ-তুঙ্গ-মালিকাম্‌।
ডমড্‌-ডমড্‌-ডমড্‌ ডমন্নিনাদ-বড ডমর্বয়ং, 
চকার চণ্ড তাণ্ডবং তনোতু নঃ শিবঃ শিবম্‌।।



হে প্রভু শিবসুন্দর! তোমার জটার অরণ্য হতে গঙ্গার ধারা গলগল করে বেয়ে এসে তোমার গলদেশকে প্লাবিত করছে, সেই গলদেশ আবার সর্পমালায় বিভূষিত, তুমিই একবার ডমরু বাজিয়ে ডমড্‌ ডমড্‌ ডমড্‌ ধ্বনি তুলে তাণ্ডব-নৃত্যে ত্রিভুবনকে কম্পমান করেছিলে, তুমি আমাদের মঙ্গল বিধান কর।



জটাকটাহসম্ভ্রমভ্রমন্নিলিম্পনির্ঝরী --- 
বিলোলবীচিবল্লরীবিরাজমানমূর্দ্ধনি।
ধগদ্‌  ধগদ্‌  ধগদজ্জ্বল-ললাটপট্টপাবকে
কিশোরচন্দ্রশেখরে রতিঃ প্রতিক্ষণং মম।।



জটারূপ কটাহ হতে বেগে বহমান গঙ্গার চঞ্চল তরঙ্গমালায় যাঁর মস্তক শোভিত এবং যাঁর ললাটে ধগদ্‌ ধগদ্‌ শব্দে অগ্নি দেদীপ্যমান, সেই তুমি কিশোর চন্দ্রশেখর! তোমার চরণ কমলে আমাদের প্রতিক্ষণ রতি হোক।


https://www.facebook.com/pages/tapobhuminarmada/454528151310191

Wednesday, December 4, 2013


.......... মহর্ষি রৈক্ক রাজা জানশ্রুতিকে উপদেশ দিতে আরম্ভ করলেন --বায়ুর্বাব সম্বর্গো --- বায়ুই সম্বর্গ। অগ্নি যখন নির্বাপিত হন, তখন বায়ুতেই লীন হন। সূর্য যখন অস্তগমন করেন তখন বায়ুতেই লীন হন, চন্দ্র যখন অস্তমিত হন, তখন বায়ুতেই লীন হন। বায়ুই হচ্ছে মূল সঞ্চালন-শক্তি।প্রলয়কালে তেজোরূপী সূর্যাদি স্বীয় কারণবায়ুতে লীন হন বলে বায়ুকে সম্বর্গ বলে।যখন জল বিশুষ্ক হন, তখন বায়ুতে লীন হন, কারণ বায়ুই বাহ্য-জগতের সব কিছুকে আত্মসাৎ করেন --- বায়ু র্হি এব এতাম্‌ সর্বান্‌ সংবৃঙ্‌ক্তে।


ঋষি এইভাবে দেবতা গণের মধ্যে সম্বর্গ-দর্শনের রহস্য ব্যাখ্যা করে অনন্তর শরীর মধ্যে সম্বর্গ-দর্শনের তত্ত্ব বলতে লাগলেন --- প্রাণই সম্বর্গ। জীব যখন নিদ্রা যায়, তখন বাগিন্দ্রিয় প্রাণে লীন হয়; চক্ষু প্রাণে লীন হয়, শ্রোত্র প্রাণে লীন হয়, মন প্রাণে লীন হয়, কারণ প্রাণই এই সমুদয়কে আত্মসাৎ করে।


এই দুটি তত্ত্বই অর্থাৎ দেবতাদের মধ্যে বায়ু এবং ইন্দ্রিয়গণের মধ্যে প্রাণ --- উভয়েই সম্বর্গগুণশালী --- তৌ বা এতৌ দ্বৌ সম্বর্গৌ বায়ুরেব দেবেষু প্রাণঃ প্রাণেষু।


রাজা জানশ্রুতি রৈক্কমুনির কাছে এই সম্বর্গ বিদ্যা লাভ করে কৃতকৃত্য হলেন। তিনি আত্মঞ্জান লাভ করলেন।



সম্বর্গ শব্দের অর্থ হল ---  সম্যক বর্গ অর্থাৎ সজাতীয় বস্তুকে সম্যকরূপে একশ্রেণীভুক্ত-করণ অর্থাৎ একীকরণ। জীবাত্মা ও পরমাত্মা সজাতীয় বস্তু, যেটুকু ভেদ আছে তা শুধু সজাতীয় ভেদ, একই গাছের বড়পাতা ও ছোটপাতার মধ্যে যে পার্থক্য সেই পার্থক্যকে দর্শনশাস্ত্রের পরিভাষায় সজাতীয় ভেদ বলে। পরমাত্মা ও জীবাত্মা --- একই চিন্ময় বস্তু,পরমাত্মা সর্বব্যাপক, কিন্তু জীবভাবের আবরণ পড়ায় জীবাত্মা দেহের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ থাকে। জীব ভাব খসে পড়লে আত্মা পরমাত্মার একীকরণ ঘটে।

সংস্কৃতে সমপূর্বক বৃজ্‌ ধাতুর উত্তর ঘঞ প্রত্যয় করে সম্বর্গ পদ সিদ্ধ হয়।বৃজ ধাতুর অর্থ বর্জন বা ত্যাগ করা। যে অলৌকিক বিদ্যার সাহায্যে জীবাত্মা স্থূলাকাশ ত্যাগ করে সূক্ষ্মাকাশে, সূক্ষ্মাকাশ বর্জন করে কারণজগতে, ক্রমে কারণজগত ত্যাগ করে মহাকারণে লীন হয়, আত্মস্বরূপ প্রতিষ্ঠিত হয়, সেই সজাতীয় ভেদ রহিত পরমাত্মার সহিত একীকরণ পদ্ধতিই হল এই সম্বর্গবিদ্যা --- ঔপনিষদিক যুগের ঋষিদের অতি প্রিয় গুহ্যতত্ত্ব।



https://www.facebook.com/pages/tapobhuminarmada/454528151310191

Wednesday, November 20, 2013


"মরম  না  জানে, ধরম  বাখানে, এমন  আছয়ে  যারা
কাজ  নাই  সখী  তাদের  কথায়  বাহিরে  রহুন  তারা।
আমার  বাহির  দুয়ারে  কপাট  লেগেছে, ভিতর  দুয়ার  খোলা
তোরা  নিসাড়া  হইয়া  আয়লো  সজনি, আঁধার  পেরিয়া  আলা
আলার  ভিতরে  কালাটি  রয়েছে, চৌকি  রয়েছে  সেথা
সে  দেশের  কথা  এদেশে  কহিলে  মরমে  লাগিবে  ব্যথা।"



Monday, November 11, 2013


........... বিকেল  তখন  সাড়ে  তিনটে  চারটে  বাজে। হঠাৎ  নজর গেল  মন্দিরের  বাঁদিকে  প্রায়  দেড়  মানুষ  সমান  উঁচু  পাঁশুটে  রঙা ঘাসের  মধ্যে  সোনালী  চমক। আমি সেদিকে  সকলের  দৃষ্টি  আকর্ষণ করে  সকলকে  নিয়ে  মন্দিরের  দরজা  ধাক্কা  দিয়ে  খুলে  ভিতরে ঢুকে  দরজা  বন্ধ  করে  দিলাম।  শিবমন্দিরের  বাঁদিকের  জানলা খুলে  দেখি  ঘাসের  জঙ্গল  ভেদ  করে  দেখা  যাচ্ছে  না  কিছুই। বুক ঢিপঢিপ  করছে।


হরানন্দজী  ফিস্‌ফিস্‌  করে  বললেন --- চিতা! দেখুন একটা  নয় একসঙ্গে  চারটে। মা  এবং  প্রায়  সাবালক  তিনটি  শাবক। ঘাসের মধ্যে  গা  ডুবিয়ে  সর্তক  ভঙ্গীতে  এগোচ্ছে  শিকারের  সন্ধানে। শাবকগুলি  একইভাবে  মাকে  অনুসরণ  করছে। এবার  একটা  বড় পাথরের  উপর  এসে  উঠে  দাঁড়াল  মা চিতা। বাচ্চাগুলিও  মায়ের গা  ঘেঁসে  পাথরের  উপর  উঠে  দাঁড়াল। সোনালী  চামড়ার  উপর কালো  বুটি। তার  সবল  পেশীতে  ফুটে  উঠছে  যেন  নৃত্যের সুষমা। চিতাগুলির  দাঁড়াবার  ভঙ্গী  দেখে  মনে  হল  চিতার  লক্ষ্য  চিতল হরিণ। কিন্তু  না!  মা  চিতা  হঠাৎ  দিক  পরিবর্তন  করে  গা ডাকা দিয়ে  গুঁড়ি  মেরে  এগোতে  আরম্ভ  করল  বাইসনগুলির দিকে।

হরিণের  গতি  ও  চিতার  গতি  ঘণ্টায়  ৫০ মাইল  হলেও  হরিণ একটানা  দৌড়াতে  পারে  কিন্তু  চিতার  অতক্ষণ  দৌড়াবার  ক্ষমতা নেই।  পাছে  শিকার  ফস্কে  যায়  তাই  সুচতুর  চিতা  লক্ষ্য  পরিবর্তন করে  ঘাসের  মধ্যে  গা  ঢাকা  দিয়ে  গুঁড়ি  মেরে  এগোতে  আরম্ভ করেছে। চিতা এগিয়ে  চলেছে  সন্তর্পণে।  হঠাৎ  চিতাটি  লাফিয়ে গিয়ে  পড়ল  বাইসনদের  মধ্যে।


যে  বাইসনটি  লক্ষ্য  করে  চিতা  ছুটছে, সেই  পালাচ্ছে  প্রাণভয়ে। মনে  হচ্ছে  চিতাটি  বাতাসে ভর  করে  উড়ে  যাচ্ছে। মাটি  স্পর্শ করছে  না  তার  পা। হঠাৎ  বাইসনটি  তার  শিং  বাগয়ে  ঘুরে দাঁড়াল। কিন্তু  চিতাটি  তার  বেগ  সামলাতে  না  পেরে  কিছুটা  এ গিয়ে  গেল।


তারপর  চিতাটি  ফিরে  আসতেই  আমরা  দেখলাম  এক  লোমহর্ষক বাইসন  ও  চিতার  লড়াই।দুজনেই  রক্তাক্ত  হয়ে  উঠেছে। হঠাৎ বাইসনটি  তার  সরু  সূচালো  শিঙটা  ঢুকিয়ে  দিল  চিতার  পেটে। কিন্তু  তাতেও  সে  থামবে  না। বীভৎস! বীভৎস! এদৃশ্য! আস্তে  আস্তে থেমে এল  অসম  লড়াই। তারপর  দেখলাম  দুজনেই  দুদিকে  ছিটকে পড়ল।


বাইসনটা  কয়েকবার  উঠবার  চেষ্টা  করল। কয়েকবার  ঘড়ঘড়ে আওয়াজে  ডেকে  উঠল। কিন্তু চিতার  দেহ  নিথর, নিষ্পন্দ। তারপর সব  চুপচাপ। এবার  যে  পাথরের  উপর  বাচ্চা  চিতাগুলি  দাঁড়িয়ে ছিল  সেদিকে  তাকিয়ে দেখি  তারাও  উধাও।


আমাদের  হাঁফ  ছাড়ল। আমরা  সবাই  ঘেমে  নেয়ে  গেছি। শরীর, হাত, পা  সবই  অবশ। ঘটনার  বীভৎসতা  ও  প্রচণ্ডতা  আমাদের বিহ্বল  করে  তুলেছে।  পিপাসায়  গলা  শুকিয়ে  গেছে। জল খাওয়ার জন্য  কমণ্ডলুর  দিকে  যেতে  গিয়ে  পা  দুটো  থরথর করে  কেঁপে উঠল। কিছুক্ষণ  পরে  কতকটা  সামলে  নিয়ে  কমণ্ডলুর  সমস্ত জলটা  ঢকঢক  করে  গিলে  ফেললাম। যেন  ধড়ে  প্রাণ  ফিরে  এল। আমার  সঙ্গীদের  কোন  সাড়া  পাচ্ছি  না। সকলের  অবস্থা  তথৈবচ। সবাইকে  কমণ্ডলুর  জল  পান  করালাম। কিছুক্ষণ  পরে  হরানন্দজী কাঁপাকাঁপা  গলায়  রব তুললেন--- হর  নর্মদে, হর  নর্মদে, হর  নর্মদে।


আজ  আর  জপে  মন  নেই। কোনক্রমে  নিজেদের  গাঁঠরী  খুলে বিছানা  পেতে  শুয়ে  পড়লাম। রাত্রি বাড়ছে। গভীর  রাত্রে  অরণ্যের ভাষা  মুখর  হয়ে  ওঠে। মাঝে  মাঝেই  নানা  শব্দ  কানে  ভেসে আসতে  থাকল। রাত্রিচর  কোন  পাখীর  ডাক  শুনতে  পেলাম। মিষ্টি সুর। আশ্চর্য, সারাদিন  দেহমনে  এত  পরিশ্রম  হয়েছে  কিন্তু  ঘুম আসছে  না  কেন? চোখ  খোলা  রেখেই  আমি  ধ্যানে  ডুববার  চেষ্টা করছি। মনে  হচ্ছে  নিরবিচ্ছিন্ন  একটা  সুরেলা  ধ্বনি  বা  তান গমকে  গমকে  যেন  ঊর্ধ্বের  দিকে  উঠে  যাচ্ছে। একটা  অস্বাভাবিক আনন্দ  আমাকে  পেয়ে  বসল।


সকালে  জেগে  উঠলাম। মন্দিরের  বারান্দায়  বসে  বসে  দেখলাম ভুবন  প্রকাশক  উদিত  হচ্ছেন, সাতপুরার  শীর্যদেশে; তাঁর রশ্মিছটায়  আলোয়  আলোয়  সব  কিছুকে  ফুটিয়ে  তুলছেন, প্রকাশ করছেন। দূরে  চিতা ও বাইসনের  দেহকে  ঘিরে  ধরেছে শকুনির দল।


প্রায় ৮ টা নাগাদ  যাত্রা  শুরু  করলাম।  প্রায়  আরো  দুমাইল  হাঁটার পর  উৎরাই-এর  মুখে  এসে  পৌঁছলাম। সাবধানে  পা  ফেলে  ফেলে নামতে  লাগলাম  ঢালুতে। একটু  অসাবধান  হলে  গড়িয়ে  পড়তে হবে খাদের  মুখে। বনের  প্রকৃতি  ক্রমশ  বদলে  যাচ্ছে। চারদিকে শুধু পাথর পাথর  আর  পাথর  কিন্তু  বড়  বড়  বনস্পতির  আর  দেখা মিলছে  না।


প্রায়  আধঘণ্টা  উৎরাই-এর  পথে  হাঁটার  পরে  আমরা  মোটামুটি সমতল  প্রান্তরে  নেমে  এলাম। সামনেই  মা  নর্মদাকে  দেখা  যাচ্ছে।যতক্ষণ  দুর্গম  বনপথে  হাঁটছিলাম  তখন  ডানদিকেই  তাঁর জলধারা  দেখতে  পাচ্ছিলাম। এখন  সামনে  বাঁদিকে  তাকিয়ে দেখছি  নর্মদা  বন  পাহাড়  ভেদ  করে  বক্রযান  গতিতে  সামনে এসে উপস্থিত  হয়েছেন।এ  অঞ্চলে  দেখছি, পাহাড়  ফাটিয়ে  তার  খাঁজে খাঁজে  বহু  চাষযোগ্য  জমি  বের  করা  হয়েছে, তাতে চাষবাস হচ্ছে। কোন  কোন  জমিতে  গম  জোয়ার  ভুট্টার  গাছ  দেখা  যাচ্ছে। ধীরে ধীরে  আমরা  নর্মদার  কিনারে  এসে  পৌঁছলাম।


নর্মদার  পবিত্রধারাকে  স্পর্শ  ও প্রণাম  করে  আমরা  পূর্বদিকে  বাঁক নিতেই  দূরে  একটা মন্দিরের  চূড়া  দেখতে  পেলাম। শিবমন্দিরটি পাথরের  তৈরী, পোতার  উপর  একটা  বড়  হলঘর। হলটা  দেখলেই বুঝা  যায়  বেশ  পুরাতন। দরজা  জানলাও  নেই।  থাকলেও তা খসে পড়ে  জীর্ণ  হয়ে  নষ্ট  হয়ে  গেছে।


আমরা  আমাদের  ঝোলা  গাঁঠরী  একস্থানে  রেখে  সবাই  মিলে  ঘাটে স্নান  তর্পণাদি  করতে  বসলাম। আজ  আমরা  তিন দিন  অভুক্ত। নর্মদার  জল  ছাড়া  কিছুই  জোটে  নি।  তা  বলে  আমাদের  ক্ষিদেও নেই, শরীরে  ক্লান্তিও  নেই। বসে  বসে  ভাবতে  লাগলাম, বিচার করতে  লাগলাম --- এই  পরিক্রমা পথে  পরিক্রমা বাসীদের তপ  জপ ও  বিভিন্ন  সাধুসঙ্গ ও নূতন  নূতন  ঞ্জান লাভ  ছাড়াও  যে  বিরুদ্ধ পরিবেশের  মধ্যে  পড়ে  স্বতঃই  যে  শম দম  ত্যাগ  তিতিক্ষা  হিংস্র শ্বাপদসঙ্কুল  দুর্গম  অরণ্যের  মধ্যে  ঘুরতে  ঘুরতে  প্রতিপদে  যে  ঈশ্বর নির্ভরতা  বাড়ছে, সঙ্কটকালে  যখন  দিশেহারা  হয়ে  পড়েছি, নিজেকে  একান্ত  অসহায়  ভাবছি, তখন  যেভাবে  আচম্বিতে অভাবনীয়ভাবে  রক্ষা  পাচ্ছি, হঠাৎ  হঠাৎ  যেভাবে  দরদী  সঙ্গী ও সাথীরা  জুটে  যাচ্ছেন  তাতে  স্পষ্টতই  মনে  হচ্ছে  কেউ  যেন আড়ালে  থেকে  রক্ষা  করছেন। কেবলেই  মনে  হচ্ছে  নর্মদা  মাতা রক্ষা  করছেন, নর্মদেশ্বর  শিব  রক্ষা  করছেন।  এই  শরণাগতির ভাবটাই  এই পরিক্রমার  সর্বশ্রেষ্ঠ  প্রাপ্তি।




https://www.facebook.com/pages/tapobhuminarmada/454528151310191

Friday, November 1, 2013

*** সরস্বতীর স্বরূপ বর্ণনা:---


ব্রহ্ম-বৈবর্ত পুরাণে আছে, সৃষ্টিকালে প্রধানা শক্তি ঈশ্বরের ইচ্ছায় পাঁচভাগে বিভক্ত হন --- রাধা, পদ্মা, সাবিত্রী, দুর্গা ও সরস্বতী। সরস্বতী  কৃষ্ণ কণ্ঠ  হতে  উদ্ভুতা। শ্রীকৃষ্ণ এই দেবীকে প্রথমে পূজা করেন। তখন থেকেই এই দেবীর পূজা প্রচলিত হয়। দেবী শ্রীকৃষ্ণ হতে উদ্ভুতা হয়ে শ্রীকৃষ্ণকেই কামনা করেন। তখন শ্রীকৃষ্ণ সরস্বতীকে নারায়ণ ভজনা করতে বলেন। লক্ষ্মী এবং সরস্বতী দুজনেই নারায়ণের স্ত্রী। ভাগবত মতে সরস্বতী ব্রহ্মার স্ত্রী।


পুরাণকারদের  মতে, পরমাত্মার  মুখ  হতে এই  দেবীর আবির্ভাব হয়। এই  দেবী  শুক্লবর্ণা, বীণাধারিণী এবং চন্দ্রে শোভাযুক্তা,  ইনি  শ্রুতি ও শাস্ত্রের  মধ্যে  শ্রেষ্ঠা, কবি এবং বিদ্বানদের  ইষ্টদেবতা, এইজন্য  এঁর নাম  সরস্বতী।


সরস্বতী জ্যোতিঃ (প্রঞ্জাজ্যোতিঃ) এবং রসের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। 

সরস্বতী স, রসবতী। "রসো বৈ সঃ" অর্থাৎ রসস্বরূপ পরব্রহ্মের তিনি পরম প্রকাশ।

ঋগ্বেদেরই ১৪২ সূক্তে ঋষি দীর্ঘতমা দৃষ্ট ৯ নম্বর মন্ত্রে দেবী সরস্বতীকে ইলা এবং ভারতী নামে অভিহিত করা হয়েছে।


"শুচির্দেবেষ্বপিতা হোত্রা মরুৎসু ভারতী।

ইলা সরস্বতী মহী বর্হিঃ সীদন্তু যঞ্জিয়াঃ।"

এই মন্ত্রে ইলা, সরস্বতী, ভারতীকে অগ্নির ত্রিমূর্তি হিসাবে বন্দনা করা হয়েছে। ভারতী স্বর্গস্থ বাক্‌দেবতা, ইলা পৃথিবীস্থ বাক্‌দেবতা এবং সরস্বতী অন্তরীক্ষস্থ বাক্‌দেবতা।


সরঃ শব্দের অর্থ হল জল; সরস্বতীর প্রথম অর্থ নদী। আর্যাবর্তে সরস্বতী নামে যে নদী ছিল (এখন লুপ্তপ্রায়) তাই প্রথমে সরস্বতী দেবী বলে পূজিত হয়েছিলেন।এই নদীতটেই বৈদিক ঋষিদের আবাসস্থল ছিল। সারা বৎসর ধরে এই নদী তীরে নানাবিধ যঞ্জ সম্পাদন করা হত এবং বেদধ্বনি হত বলে কালক্রমে সরস্বতী নদী পবিত্রমন্ত্রে দেবী বাক্‌দেবীরূপে রূপান্তরিত হলেন। বেদমন্ত্রে সরস্বতীর এই ভাবে মহিমা প্রকাশ পেয়েছে।


বাক্‌দেবীরূপে এঁর মহিমা ঋষিরা এইভাবে প্রকাশ করেছেন --- মানুষের হৃদয়কে পবিত্র ও নির্মল করেন, যিনি যঞ্জশালিনী এবং অন্নদাত্রী সেই সরস্বতী আমাদের যঞ্জ কামনা করেন। ইনি সুন্দর ও সত্যবাক্যের প্রেরণকর্ত্রী, ইনি মহাসমুদ্রের ন্যায় অসীম পরমাত্মাকে চিহ্নের দ্বারা প্রকাশ করেন। ইনি সমুদয় নরনারীর হৃদয়ে জ্যোতিঃ সঞ্চারিত করেন।


শৈবাগমতন্ত্রে যাঁকে সিদ্ধবিদ্যা ষোড়শী বিদ্যা বলা হয় সেই ষোড়শী বিদ্যার দেবীকেই সরস্বতী বলা হয়। শৈবাগম সাধকদের নিকট সাধারণভাবে ইনি বাণী, বীণাপানি, বাক্‌দেবী, শুভ্রা, হংসবাহনা প্রভৃতি নামে পরিচিত।


পৌরাণিক সরস্বতী এবং বৈদিক সরস্বতীর সঙ্গে এঁর সাদৃশ্য থাকলেও ধ্যান ও মন্ত্ররহস্য সম্পূর্ণ পৃথক। এই দেবী নানা স্থানে নানাভাবে পূজিত হয়ে থাকেন। দেবীর বহুরূপ, বহুবাহন ও বহুলীলা।



দেবী কখনও দ্বিভূজা, কখনো চতুর্ভুজা আবার প্রয়োজনবোধে কখনো বা ষোড়শভূজা। প্রত্যেক রূপেই মন্ত্র যন্ত্র পৃথক পৃথক। ষোড়শী বিদ্যাদেবীর ষোলটি নাম, ষোল রকমের রূপ। সকলেরই মাথার উপর মন্দিরের মত উঁচু মুকুট। সকলেই ললিত মুদ্রাসনে আসীনা, একটি পা নীচু করে রেখেছেন, একটি পা আসনের দিকে গুটানো। সকলেরই দক্ষিণ হস্ত বক্ষোপরি বরমুদ্রায় স্থাপিত, বামহস্ত মোড়া এবং উঁচুতে তোলা। প্রত্যেকটি অঙ্গভঙ্গীই গভীর ভাবের দ্যোতক, বিভিন্ন যোগরহস্যের সঙ্কেত-সূচক।

সরস্বতীর ষোড়শ নামের:---


1. রোহিনী --- দেবীর বাহন জলচৌকি। দেবী চতুর্ভুজা। দক্ষিণ ও বাম উভয় হস্তেই চক্র। দেবীর অপর নাম ---"অজিতবালা"।


2. প্রঞ্জপ্তী --- দেবীর বাহন হংস। দেবী  ষষ্ঠভুজা। তাঁর হাতে অসি, কুঠার, চন্দ্রহাস ও দর্পণ। দেবীর অপর নাম --- "দুরিতারী"।


3. বজ্রশৃঙ্খলা --- দেবীর বাহন হংস। দেবী  চতুর্ভুজা। হাতে পারিখ ও বৈষ্ণবাস্ত্র।


4. কুলিশাঙ্কুশা --- দেবীর বাহন অশ্ব। দেবী চতুর্ভুজা। তাঁর ডান হাতে অসি এবং বাম হাতে ভূষণ্ডী। দেবীর অন্যান্য নাম যথাক্রমে "মনোবেগা", "মনোগুপ্তি", "শ্যামা"।


5. চক্রেশ্বরী ---  দেবীর বাহন গরুড়। দেবী ষোড়শভূজা। উপরের দক্ষিণ ও বাম হস্তে শতঘ্নী এবং ১০ হাত মুষ্টিবদ্ধ। দুই হাত কোলে স্থিরভাবে পতিত এবং বাকী দুই হাতে বরদানের মুদ্রা।


6. পুরুষদত্তা  ভারতী --- দেবীর বাহন হস্তী। দেবীর দক্ষিণ হস্তে চক্র এবং বাম হস্তে শতঘ্নী। এঁর মুখমণ্ডল চতুস্কোণ বিশিষ্ট, পুরুষাকৃতি। দেহের গঠন সুদৃঢ় ও বলিষ্ঠ, কোমর সিংহের মত সরু।


7. কালী --- এই কালী দশমহাবিদ্যার কালী নন। বাহন  বৃষ। দেবী চতুর্ভূজা। দক্ষিণ  হস্তে ত্রিশূল ও বাম হস্তে শতঘ্নী। দেবীর অপর নাম "শান্তি"।


8. মহাকালী --- ইনিও তন্ত্রোক্ত দশমহাবিদ্যার মহাকালী নন। দেবীর কোন বাহন নেই। দেবী  চতুর্ভুজা। ডান হাতে ষষ্ঠি এবং বাম হাতে শতঘ্নী। দেবীর অপর নাম "অজিতা" এবং "সুরতারকা"।


9. গৌরী ---  দেবীর বাহন বৃষ। দেবী চতুর্ভূজা। এঁর দক্ষিণ হস্তে মঙ্গলঘট এবং বাম হস্তে ষষ্ঠি। দেবীর মস্তকের মন্দিরাকৃতি মুকুটের বাম পার্শ্বে "চন্দ্র"। দেবীর অপর নাম "মানসী"ও "অশোকা"।


10. গান্ধারী --- দেবী চতুর্ভূজা, কোন বাহন নেই। এঁর ডান হাতে পরিখ অর্থাৎ লৌহকণ্টকযুক্ত মুদগর আর বাম হাতে সীর(লাঙ্গলাস্ত্র); এর দুই স্থান বাঁকা। মুখ ও মূলাংশ লৌহবদ্ধ, সাধ্য ত্রিহস্ত পরিমিত দীর্ঘ। এই মন্ত্রের কাজ আকর্ষণ ও নিপাতন। এই দেবীর অপর নাম "চণ্ডা"।


11. সর্বাস্ত্রমহাজ্বালা --- দেবী অষ্টভূজা। এঁর বাহন বৃষ। দক্ষিণহস্তে অসি, ত্রিশূল, ভল্ল (বর্শা বিশেষ)। কার্য--- নিক্ষেপে ছেদন, নিপাতন ও শায়িত করণ। বৈষ্ণবাস্ত্র এবং বাম হস্তে ব্রহ্মশির অস্ত্র, তীর ও পাশ। মস্তকে মন্দিরাকৃতি বিরাট মুকুট। মুকুটের চতুর্দিকে অরণ্য। দেবীর অপর নাম "জ্বালামালিনী","ভৃকুটি"।


12. মানবী --- দেবী চতুর্ভূজা।এঁর বাহন সাপ। দেবীর দু'হস্তে দর্পণ, এক হাতে ষষ্ঠি, অপর হাত বরমুদ্রায় স্থাপিত। দেবীর অপর নাম "অশোকা"।


13. বৈরাট্যা --- দেবী চতুর্ভূজা।এঁর বাহন সাপ।এঁর দু'হস্তে বৈষ্ণবাস্ত্র ও ভল্ল। দেবীর অপর নাম "বৈরোটি"।


14. অচ্ছুপ্তা --- দেবী চতুর্ভূজা। এঁর বাহন হংস। দক্ষিণ হস্তে ভল্ল  এবং বাম হস্তে  বিজয়ধনু। দেবীর অপর নাম "অনন্তবতী","অঙ্কশা"।


15. মানসী --- দেবী চতুর্ভূজা। এঁর বাহন সিংহ। দক্ষিণ হস্তে ভল্ল ও কুঠার এবং বাম হস্তে দর্পণ ও বিজয়ধনু। দেবীর অপর নাম "কন্দর্পা"।


16. মহামানবী --- দেবী চতুর্ভূজা। এঁর বাহন ময়ূর। দক্ষিণ হস্তে ভল্ল ও বাম হস্তে চক্র। দেবীর অপর নাম "নির্বাসী"।



ষোড়শী বিদ্যা সরস্বতীর এই ষোল রকমের দিব্যমূর্তি নিয়ে ভক্তের কাছে প্রকাট হন। তাই তাঁর  ষোড়শী রূপই আমাদের ধ্যানের ধন। তাঁর প্রত্যেকটি রূপেরই মন্ত্র যন্ত্র পৃথক পৃথক থাকলেও সব মিলিয়ে তাঁর যে দিব্যস্বরূপ, সরস্বতী বলতে আমরা তাঁকেই বুঝি।


https://www.facebook.com/pages/tapobhuminarmada/454528151310191

Friday, October 18, 2013

*** "মাতৃদেবো ভব, পিতৃদেবো ভব" :---


মন্ত্রদাতা  ঞ্জানদাতা
তাঁরে  বলি  গুরু,
সদ্‌গুরু  সেই  যাঁহা  হতে
ব্রহ্মদর্শন  শুরু।
স্থিতি  ভেদে  সংঞ্জা  ভেদে
সুকৃতিতে  মিলে
মহাগুরু  মাতাপিতার
জন্ম  হতেই  কোলে।।

পিতা  ও  মাতা  একত্রে  শিব-শিবানী  অর্থাৎ অর্ধনারীশ্বর।

"মাতাপিতাই  শ্রী-শ্রীপতি
উমা  মহেশ্বর, 
মাটির  মূর্ত্তি  ছেড়ে  রে  মন,
তাঁদের  চরণ  ধর।।"


"জগত  পিতরৌ  বন্দে  পার্বতীপরমেশ্বরৌ।
কালিদাসেন  যদুক্তং  পিত্রোস্তদনুভূয়তে।।"

মহাকবি  কালিদাস  তাঁর  রঘুবংশম্‌  নামক  মহাকাব্যে  জগতের আদি মাতাপিতা পার্বতী ও মহেশ্বরকে শব্দ ও অর্থের ন্যায় সংপৃক্ত, নিত্যসম্বন্ধ যুক্ত ('বাগর্থাবিব  সম্পৃক্তৌ') ঞ্জানে  বন্দনা  করেছেন।

মহাকবির ধ্যানদৃষ্টিতে এই রূপটি শাস্ত্রোক্ত অর্ধনারীশ্বরের রূপ। 'অর্ধনারীশ্বরেণ যৎ, আম্নাতং পিতরৌ মম'। দিব্যভূমিতে যিনি অর্ধনারীশ্বর, মর্ত্তভূমিতে তিনিই মাতাপিতারূপে প্রত্যেকের ঘরে ঘরে বিরাজিত।।

মাতা:--- 

'যো  মিমীতে  মানয়তি  সর্বান্‌  জীবান্‌  স  মাতা' ---

দয়াময়  ভগবান  যেমন  সকল  জীবের  সুখ ও উন্নতি কামনা করেন, আমাদের জন্মদাত্রীও তেমনি  নিঃস্বার্থভাবে  নিজ  সন্তানদের সুখ ও শ্রীবৃদ্ধি  কামনা করেন। জননীকে  মাতা  নামে  অভিহিত  করে ঋষিরা বুঝাতে চেয়েছেন যে,মাতা পরমেশ্বরের সমান ইষ্ট ও উপস্যা।

অন্যত্র প্রেমের বিরাম আছে, বাধাও আছে, জগতে মাতৃস্নেহই কেবল অবিরত ও অপ্রতিহত; মৃদুলগামিনী ক্ষুদ্র স্রোতস্বতীর মত মাতৃস্নেহ অবিরলধারে সন্তানের জীবনক্ষেত্রে প্রবাহিত হয়ে নিরন্তর তার মঙ্গল সাধনা করে চলেছে। জগতে মাতৃস্নেহই যথার্থ প্রেম, নিঃস্বার্থ প্রেম, উজ্জ্বল স্পর্শমণি, স্বর্গের অমূল্যরত্ন।

মা-ই জীবন্ত প্রত্যক্ষ দেবী। মায়ের যে যথার্থ রূপ, তা অন্তশ্চক্ষুর গোচর, জড়চক্ষু তার দর্শন পায় না। মায়ের আন্তর দেহ চিন্ময়, স্থূল দেহ তার ছায়া মাত্র। আনন্দ তার মুখ, দয়া তার হস্ত, প্রেম তার কাণ্ড, ধৈর্য ও তিতিক্ষা তার চরণ-কমল।

রক্ত যেমন বক্ষস্থল হতে সঞ্চালিত হয়ে বহুবিধ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অবশেষে হস্তপদাদির আকারে আকরিত হয়, মাতৃহৃদয়ের প্রেমও সেইরকম ভিন্ন ভিন্ন অবস্থায় ভিন্ন ভিন্ন আকার ধারণ করে চিন্ময় মাতৃদেহ নির্মাণ করেছে।

এই চিন্ময়ী মূর্তিই যথার্থ মায়ের মূর্তি --- বাইরের জড়মূর্তি তার প্রতিকৃতি মাত্র! যতক্ষণ এই জড়মূর্তি দেখি, ততক্ষণ প্রকৃত মাতৃদর্শন হয় না। চক্ষুদ্বয় নিমীলিত করে যখন অন্তর-রাজ্যে প্রবেশ করি, তখনই মা প্রত্যক্ষ হ'ন, তাঁর অলোক-সামান্য রূপ দর্শনে প্রাণ পুলকিত হয়, দিব্যঞ্জান লাভ হয়।


"বিদৃতি  সে  মহাদ্বার  ব্রহ্মরন্ধ্র  পাশে
জীবাত্মা-জনমকালে  সহসা  বিকাশে।
জঠরে  প্রবেশি  আত্মা  যুক্ত  প্রাণ-তারে
ওঁ-ওঁ-ওমা-ওমা  স্বতঃই  ঝঙ্কারে।
মাতৃপ্রাণ  হ'তে  রস  টানে  নিজ  প্রাণ  তরে
মাতৃপূজা  মাতৃসেবা  সেই  ঋণ  শুধিবার  তরে।।"

পিতা:---


নমঃ  পিত্রে  জন্মদাত্রে  সর্বদেবময়ায়  চ।
নমঃ  সদাশুতোষায়  শিবরূপায়  তে  নমঃ।।

শিব ও পিতা  দুটি  শব্দই  সমার্থক, দুজনেই  সমান। পিতা = শিব। পিতা  অসীম  শিবেরই  সসীম  রূপ। ঘটাকাশ, গৃহাকাশ এবং মহাকাশে  যেমন  কোন  স্বরূপতঃ প্রভেদ  নেই। একই  আকাশ  ঘট ও গৃহের  সীমায়িত  স্থানে  আবদ্ধ  থাকায়  ঘটাকাশ  গৃহাকাশ  সংঞ্জা দেওয়া  হয়  মাত্র। ঘট  বা  গৃহ  ভগ্ন  করলে  যেমন একই  আকাশ থাকে, তেমনি  অমর্ত্য  শিব  যখন  মর্ত্য  শরীরের  আবেষ্টনীতে  থেকে আমাদের  সামনে  ঘুরে  বেড়ান, তখনই  আমরা  তাঁকে  পিতা  বলি। পিতা  ও  শিবে  স্বরূপতঃ কোন  ভেদ  নেই, পিতাই  শিব।

"তোমার --- তোমার --- আমি  হে  তোমার
--- প্রতি  পরমাণু  কহে  বারবার,
বাবা, তুমিই  আমার  নন্দন-সার
সুন্দর  প্রেমখনি;
কেশ  বেশ  ঢেকে  আসিয়াছ  শিব!
অমৃত-পরশমণি।।"

মাতাপিতার  ধ্যান  পূজা  সেবা  পরিচর্যাই  শ্রেষ্ঠ স্বাধ্যায়, শ্রেষ্ঠ তপস্যা এবং শ্রেষ্ঠ যোগ।

https://www.facebook.com/pages/tapobhuminarmada/454528151310191

Wednesday, September 18, 2013


" জ্যোতির  মাঝে  শ্রেষ্ঠ  জ্যোতি  নামল  উষা  ঐ  গগনে,
বিচিত্রতার  দীপ্ত  কিরণ  ছড়িয়ে  পড়ে  সব  ভুবনে।
সবিতা  সে  অন্তকালে  জাগায়  তিমির  রজনীরে,
দ্যুতিমতী  উষায়  তথা  রাত্রি  জাগায়  ধীরে  ধীরে।।

শুভ্র  বরণ  দীপ্ত  মোহন  উষা  এল  সূর্যসনে,
কৃষ্ণবর্ণা  রাত্রি  পালায়  তিমিরঘেরা  নিজসদনে।
রাত্রি  উষা  অমৃতময়  সূর্যসখা  তারা  দোঁহে,
একের  বরণ  অন্যে  নাশে  দীপ্ত  হয়ে  জগৎ  মোহে।।

অনন্ত  পথ  উভয়  বোনের  বিধান  করেন  দেবতারা,
সেথায়  নিত্য  ভ্রমণ  করে  একের  পরে  অন্য  তারা।।
ভিন্নরূপা  নক্ত  উষা  চিত্ত  তাদের  সমান  তবু,
দেয়  না  বাধা  পরস্পরে  চুপটি  করে  রয়না  কভু।।

সুনৃত  বাক  তারই  দেওয়া  প্রভাময়ী  জানি  তারা,
চিত্র  তিনি  খোলেন  দ্বারে  তিমির  ভরা  অন্ধকারে।
সর্বজগত  আলোয়  ভরি  প্রকাশ  করি  দিলেন  ধনে,
জাগিয়ে  দিলেন  জ্যোতির্ছটায়  বিশ্ববাসী  সকল  জনে।।

বক্র  হয়ে  ছিল  শুয়ে  উষা  তাদের  দিলেন  ডাকি,
কেউ বা  যাগে  কেউ  বা  ভোগে  কেউ  বা  কাজে  মাতল  হাঁকি।
উষা  তাদের  দৃষ্টি  বাড়ায়  অল্প  যারা  দেখতে  পারে,
দীপ্ত  উষা  জাগান  হেসে  বিশ্বজগৎ  পারাবারে।।

কেউ  বা  জাগে  ধনের  লাগি  কেউ  বা  জাগে  অন্ন  তরে,
কেউ  বা  জাগে  যঞ্জ  তরে  কেউ  বা  ইষ্ট  যাচ্ঞা  করে।
প্রকাশ  করেন  বিশ্বভুবন  বিশ্বজনের  হিতের  লাগি,
চলেন  সবাই  আপন  কাজে  তন্দ্রা  হতে  ভোরে  জাগি।।"





Monday, September 2, 2013

"সাধু হো তো য়্যাসা" ---


কামরূপে মঠে স্বামী কেবলানন্দ নামে এক সন্ন্যাসী থাকতেন।কন্দর্পকান্তি দেহ, শালপ্রাংশু মহাভুজ, বয়স ৩০/৩২ এর বেশী হবে না।সবসময় ধ্যানানন্দে বিভোর থাকতেন।রাত্রি ৩টে স্বামীজীর সঙ্গে গঙ্গাস্নানে,বেলা ১২টা,১টার সময় মাধুকরী করতে যাওয়া ছাড়া তিনি গুম্ফার বাইরে বেরুতেন না।ব্রহ্মচারী মহেশ চৈতন্য নামে মঠের একজন ব্রহ্মচারী একবার স্বামীজীর কাছে এসে অভিযোগ করলো -'স্বামীজী,কেবলানন্দজী মাধুকরী করতে বেরিয়ে নারদ ঘাটের এক শেঠানীর বাড়ীতে গিয়ে রোজ মাধুকরী করে।খোঁজ নিয়েছি ঐ বাড়ীতে ৪৫/৪৬ উমরকা এক বিধবা শেঠানী থাকে আর কেউ থাকে না। হমারা ডর হ্যায়, 'ইসমে মঠকা কৌঈ বদনামী না হো'। 

মহেশ চৈতন্যের এই অভিযোগ শুনে স্বামীজী সঙ্গে সঙ্গে কেবলানন্দজীকে উপরে ডেকে পাঠালেন। মহেশ চৈতন্যের অভিযোগ সত্য কিনা জিঞ্জেস করলেন।


কেবলানন্দজী অবিচল কণ্ঠে বললেন - সিকায়ৎ সচ হ্যায়।উনোনে হামারা বড়া বহিন হ্যায়।স্বামীজী ছোটবেলা আমি মা বাপকে হারিয়েছি।ঐ বহিনজীই আমাকে মানুষ করেছিলেন। আমি সংসার ত্যাগের পর বহিনজীও কাশীতে এসে বাস করছেন, জপ পূজার মধ্যেই সময় কাটান। আমি যে কাশীতে থাকি তা তিনি জানতেন না। আজও জানেন না আমি এই মঠে আপনার চরণাশ্রয়ে থাকি।


একদিন মাধুকরী করতে গিয়ে হঠাৎ বিশ্বনাথের গলিতে দেখা হয়ে যায়। তিনি বিশ্বনাথের পূজা করে ফিরেছিলেন। ভীষণ কান্নাকাটি করেন। রাস্তার মধ্যেই তিনি মূর্চ্ছা যান। সংঞ্জা ফিরে পেয়ে বলেন -তোকে কোথাও না কোথাও তো মাধুকরী করতেই হয়। তুই আমার কাছে মাধুকরী করবি বলে গঙ্গাজল, বিশ্বনাথের নির্মাল্য নিয়ে শপথ করান।


স্বামীজী আমি অপরাধী, মায়া মমতার ডোর আমার মধ্যে সুপ্ত ছিল।আমার গোস্তাকী হয়েছে, আপনাকে সব নিবেদন করা উচিত ছিল।মহেশ চৈতন্যকে সঙ্গে দিয়ে স্বামীজী আর এক ব্রহ্মচারীকে সব বৃত্তান্তের খোঁজ নিতে পাঠালেন। সেই ব্রহ্মচারী সব খোঁজ নিয়ে এসে স্বামীজীকে বললেন, কেবলানন্দজীর কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্য।


স্বামীজী কেবলানন্দজীকে বললেন - ভগবন্! কলিতে সন্ন্যাস ধর্মকে বড় কঠিনতম ব্রত বলে। বিরজা হোমের সময় বাইরের জগৎ আর তার হাতছানি রূপ, রস, গন্ধ, শব্দ, স্পর্শকেও যেমন ন্যাস করতে হয় তেমনি অন্তর জগতের যোগজ শক্তি বিভূতি ইত্যাদিকেও ন্যাস করতে হয়। পূর্বাশ্রমকে ভুলতে হয়, এমনভাবে ভুলতে হয় যে, যেন নিথর রহস্য ঢাকা পড়ে যায়। নিজেকে মৃতঞ্জানে সন্ন্যাসী নিজেরই শ্রাদ্ধ করেন গৈরিক বস্ত্র গ্রহণের পূর্বে। এটা অনুমান করলে চলবে না, সত্যি সেইরকম জীবন্ত বোধটি হওয়া চাই।


এই মঠের আচার্যরা এইভাবে কঠোরতম তপস্যা ও কৃচ্ছসাধনের দ্বারা পবিত্রতম সন্ন্যাস ধর্মের জ্যোতিকে জ্বালিয়ে রেখে গেছেন। আমার মত অপদার্থ এর আগে কেউ এই মহান মঠে বসেনি। কিন্তু আমার বল বুদ্ধি ভরসা তো তোমরা। তোমাদের মুখ চেয়েই সেই ব্রহ্মবিদ্বরিষ্ঠ আচার্যদের ব্রত পালনের ভার নিয়েছি। তোমারা যদি সাহায্য না কর, সহয়তা না কর তাহলে সন্ন্যাস ধর্ম কি করে থাকবে ভগবান? তুমি বলে দাও বাছা, তোমার ঐ কাজ সন্ন্যাস ধর্মের অনুকূল কিনা? আমি তো মুখ্যু সুখ্যু মানুষ বাবা।


কেবলানন্দজী দণ্ড,কমণ্ডলু এবং তাঁর গৈরিক উত্তরীয়খানি স্বামীজীর পদতলে রেখে বললেন -- এই শরীরের পাতিত্য দোষ ঘটেছে প্রভু!পূর্বাশ্রমের সঙ্গে কোন সংস্পর্শ রাখা কোন সন্ন্যাসীর উচিত নয়। আমি সন্ন্যাস ধর্মের অমর্যাদা করেছি। তাই ভাবছি--এখন উত্তরায়ণ চলছে,আগামীকাল সকাল ৮টায় এই অশুদ্ধ দেহটা ফেলে দেব।উপস্থিত সকলেই হতচকিত। কিন্তু ভোলানন্দজী নির্বিকার। 

ভোলানন্দজী ধীর স্থির ভাবে তখনই কামরূপ মঠের স্বীকৃত ৫ জন সাগ্নিক ব্রাহ্মণকে পরদিন প্রাত:কালে উপস্থিত হওয়ার অনুরোধ জানিয়ে এক সাধুকে পাঠালেন আর এরপরই বজ্রগম্ভীর কণ্ঠে ব্রহ্মচারী মহেশকে মঠ ছেড়ে যাবার নির্দেশ দিলেন। 

ভোর ৪টে কামরূপ মঠে উপস্থিত হলেন একে একে পাঁচজন সাগ্নিক ব্রাহ্মণ -- গোপীনাথ কবিরাজ,মঙ্গলদেব শাস্ত্রী,পণ্ডিত তারাকিশোর, ব্রহ্মদত্ত জিঞ্জাসু এবং ছোট বামাচরণ। 

কেবলানন্দজী নিজে হোমকুণ্ড সাজাচ্ছেন। পাঁচজন ব্রাহ্মণের জন্য পাঁচটি আসন পাতা আছে। কেবলানন্দজী তাঁদের "নম নারায়ণায়" জানিয়ে আসন গ্রহণের অনুরোধ জানালেন। যথাসময়ে যথালগ্নে শুরু হল বিরজা হোম। পাঁচজনে একত্রে উচ্চারণ করতে লাগলেন অগ্নি প্রজ্জ্বলনের মন্ত্র --- কেবলানন্দজী ধ্যানস্থ - নিথর নিস্পন্দ দেহ। 

"হরি ওঁ তৎসৎ, হরি ওঁ তৎসৎ" উচ্চারণ করতে করতে ভোলানন্দজী নেমে এলেন। কেবলানন্দজীর মাথায় দণ্ড স্পর্শ করে মন্ত্র উচ্চারণ করতে লাগলেন। 

বদ্ধ পদ্মাসনে ঋজু আয়তদেহে উন্নত মেরুদণ্ডে উপবিষ্ট সিদ্ধতাপস কেবলানন্দজীর ব্রহ্মরন্ধ্র দিয়ে একটি উজ্জ্বল শিখা উর্ধাকাশে গিয়ে মিলিয়ে গেল। হোমকুণ্ডের সামনে পড়ে রইল "পাতিত্য দোষে দুষ্ট" কেবলানন্দজীর অশুদ্ধ দেহ!


www.ananda-tapobhuminarmada.blogspot.com


Monday, August 12, 2013


"হে  নাথ!  অবঞ্জা  করি  যেও  নাকো  ফিরে,
আমার  এ  ধূলিস্তূপ  খেলাঘর  দেখে।
খেলাঘরে  শুনিতে  পেয়েছি  থেকে  থেকে  যে  চরণ-ধ্বনি
জগতের  প্রতি  বস্তু  মাঝে  যে  সঙ্গীত  রাজে
তাই  যেন  নিত্যকাল  শুনি।"

"জীবনের  ক্লেদ  গ্লানি  যাক্‌  ডুবে  অনন্ত  পাথারে
সুখ  দুঃখ  মৃত্যুভয়  যাক্‌  ভেসে  দূর  দূরান্তরে
তোমার  পরশে  হল  বোধির  বোধন
প্রঞ্জার  প্রকাশ  হল  রসঘন  আনন্দ  দীপন
হে  ব্রহ্মর্ষি, তব  পদে  নমি  বারংবার।"



Tuesday, July 23, 2013


মিত্রদ্রোহিতা, বন্ধু  হয়ে  বন্ধুর  সঙ্গে  ছলনা, ব্রহ্ম হত্যার  মত অতি ঘৃণ্য পাপ। ভারতীয় সংস্কৃতির শিক্ষা হল -


মিত্রদ্রোহী  কৃতঘ্নশ্চ  যে  নরাঃ  বিশ্বাসঘাতকাঃ।
তে  নরাঃ  নরকং  যান্তি  যাবচ্চন্দ্রদিবাকরৌ।।

মিত্রদ্রোহী, কৃতঘ্ন  এবং  বিশ্বাসঘাতক --- এই  তিন  প্রকৃতির  লোকই হল  প্রকৃত  চিহ্নিত  পাপিষ্ঠ। যতদিন  আকাশে  চন্দ্র, সূর্য  থাকবেন, ততকাল ঐ  তিন  প্রকৃতির পাপিষ্ঠকে  নরক  যন্ত্রণা  ভোগ করতে হবে। বন্ধুর  বিরুদ্ধাচারণ  করতে  নেই। মত  ও  আদর্শে  যদি কোনদিন উভয়ের  মধ্যে  পার্থক্য  দেখা  দেয়, সসম্মানে  দূরে  সরে থাকাই  ভাল, তবুও  তার  কোনদিন  অনিষ্ট  করতে নেই। উপকারীর উপকার  স্মরণে  না  রাখলে  কিংবা  প্রত্যুপকারের পরিবর্তে  তার  কোনদিন  অপকার  করার  প্রবৃত্তি  জন্মালে, তার নাম  কৃতঘ্নতা। এটি  একটি  মহাপাপ।  কেউ  বিশ্বাস  করে  কোন গোপন কথা  বললে  বা  বিশ্বাস  করে   কোন  দ্রব্য  জমা  রাখলে, প্রাণপন  চেষ্টায়  মন্ত্রগুপ্তির  মত  সেই  বিশ্বাস  রক্ষা  করা  উচিত।


https://www.facebook.com/pages/tapobhuminarmada/454528151310191

Monday, July 15, 2013


প্রাণায়াম:--- প্রাণায়ামে  আয়ু  বাড়ে  কিন্তু  প্রাণায়াম  বলতে ভারতবর্ষের  তাবৎ  লোক  যা  বুঝে  থাকেন  সেই  শ্বাস  প্রশ্বাসের ক্রিয়ার  দ্বারা  আয়ু  বাড়ে  না।  বরং  রোগবৃদ্ধি  হয়, স্বাস্থ্যের হানি ঘটে। মানুষের শরীর কামারশালার  ভস্ত্রা  নয়।কাজেই রেচক পূরক কুম্ভকের নামে  শ্বাস প্রশ্বাসের  কসরৎকে প্রাণায়াম বলে না।"প্রাণায়াম" শব্দটির  অর্থ --- প্রাণের  অয়মন  বা  বিস্তার। সত্যকার প্রাণায়াম  প্রাণঘাতী  নয়। প্রাণায়ামকে  শ্রেষ্ঠ  তপস্যা বলে বর্ণনা করা  হয়েছে। প্রাণায়ামে  সত্য সত্যই  চিত্তবৃত্তির  বিরাম ঘটে।

ভগবান  পতঞ্জলির  মতে  প্রাণায়াম  রূপ  যোগাঙ্গের  অনুষ্ঠানে অশুদ্ধি  ক্ষয়  হয়, অশুদ্ধি  ক্ষয়  হলে  বিবেকখ্যাতি পর্য্যন্ত  ঞ্জানদীপ্তি হয়ে  থাকে।


ভগবান  মনু  বলেছেন  অগ্নিতে  দগ্ধ  করলে  যেমন  সুবর্ণাদি ধাতুর 
মল  নষ্ট  হওয়ায়  তা  শুদ্ধ ও উজ্জ্বলতর  হয়, তেমনি প্রাণায়াম করলে  মন  প্রভৃতি  ইন্দ্রিয়কৃত  দোষ  নষ্ট  হয়।

বেদ এবং পাণিনি  মতে প্রকৃত প্রাণায়াম  হল 'বিচ্ছর্দনাভ্যাম্‌' এ এক রকমের  বমন  ক্রিয়া ---  উদ্ধৃত্ত  কফ-বায়ুপিণ্ডের  বমন, তমোগুণের বমন, বিষয়লিপ্সার  বমন,  কামনার  বমন  এবং যুগপৎ ব্রাহ্মীস্থিতি। এই  গুপ্ত  পদ্ধতি  গুরুমুখগম্য।

পরিণাম:--- ১৯৪৭  সালে  পূজার  ছুটিতে  এলাহাবাদ  গিয়েছিলাম। ত্রিবেণী  তটস্থ  বাঁধের  পূর্বদিকে  হাড়োয়া  বাবা  নামে এক হঠযোগী বাস  করতেন। বাঁধের  পশ্চিম  দিকে  থাকতেন  সুদত পুরী  নামে আর  এক  সাধু, তিনিও  হঠযোগী। সকাল  ও  সন্ধ্যায় দলে  দলে লোকে  আসতেন  তাঁদের  আশ্রমে।

সুদত  পুরীকে  সবাই  বলতেন 'আসন  সিদ্ধ', হাড়োয়া  বাবাকে বলতেন --- 'প্রাণায়াম সিদ্ধ'। সুদত  পুরীর  শিষ্যরা  প্রচার  করতেন যে  আকাশগমনাদি  ব্যাপার  তাঁদের  গুরুর  কাছে  নিতান্ত ছেলেখেলা  বিশেষ। যদি  কাউকে  জিঞ্জেস  করতাম, 'আপনি  কি নিজের  চোখে  এ  সব  দেখেছেন?' উত্তর  পেতাম --- ' অমুকের কাছে শুনেছি, উনোনে  বোলা...'। সেই  'অমুককে' খুঁজে  জিঞ্জেস করলে তিনি  জবাব  দিতেন --- 'তমুকের  কাছে  শুনেছি, তমুক  খুদ্‌ আঁখসে দেখা  হ্যায়।' এই  অমুক  তমুকরা  ধর্মজগতে  সাধুবাবাদের আদি  ও অকৃত্রিম  প্রচারক। তাঁদের  কথা  সকলের কানে  ভেসে আসে, তাঁদের কেউ  দেখা  পায়  না, আমিও পাই  নি।

দুই  সাধু  বাবারই খ্যাতি  তখন  তুঙ্গে। যোগাভ্যাসীদের 'জয় বজরংবলী'  ধ্বনিতে  উভয়ের  আশ্রম  মুখর থাকত। যে কোন ভাবে হোক, আমার  উপর  হাড়োয়া  বাবার বিশেষ কৃপাদৃষ্টি পড়েছিল। তিনি  তাঁর  আশ্রমের  একটি  কুটিরেই আমাকে থাকতে দিয়েছিলেন। যখনই  এলাহাবাদ  যেতাম, তাঁর কুটীরেই থাকতাম।

দেখতাম  যোগাভ্যাসীরা  সুদত  পুরীজীর  আশ্রমে  ব্রজাসন,ময়ূরাসন, কাকাসন, পরশুরামাসন, মৎস্যেন্দ্রাসন, শাম্ভবী, যোনিমুদ্রা, জালবন্ধমুদ্রা, মহামুদ্রা  প্রভৃতি  অভ্যাস  করতেন। তাঁরাই  আবার হাড়োয়া  বাবার  আশ্রমে  এসে  অভ্যাস  করতেন উজ্জায়ী, ভস্ত্রায়ী, কেবলী  প্রভৃতি  প্রাণায়ামবিধি। অনেকে  আবার খেচরী  সিদ্ধ হওয়ার বাসনায়  জিহ্বার  ছেদন  দোহনাদি  ক্রিয়া একনিষ্ঠভাবে অভ্যাস করতেন।

হাড়োয়া  বাবার  এক  শিষ্য, বিষ্ণুদেবানন্দ  পুরী  বাঁধের  নীচে  এক বিরাট  গর্ত  করে  তার  মধ্যে  থেকে 'গুহাসাধনা  করতেন। জমজমাট  ব্যাপার, চারদিকে  শুধু  'যোগীপুরুষের' ভীড়!  সুদত পুরী একদিন  গুহ্যদ্বার  দিয়ে  নাড়ীভুঁড়ি  বের  করে দেখিয়েছিলেন। একদিন  হুঙ্কার  দিয়ে  শাল প্রাংশু  মহাভুজ  হাড়োয়া  বাবা যোগাসনে বসলেন ---  সঙ্গে  সঙ্গে  শিবনেত্র। দৃষ্টি  স্থির। আধঘণ্টা পরে  ডাক্তার স্টেথোস্কোপ  দিয়ে  পরীক্ষা  করে  বললেন, বুকের মধ্যে  কোন স্পন্দন  নেই, নাড়ীর  গতিও  রুদ্ধ। তাঁর  বুকে  হাত দিয়ে দেখেছিলাম  হৃদপিণ্ডে  সত্যই  কোন  স্পন্দন  ছিল  না। দু'ঘণ্টা  পরে হাড়োয়া  বাবা  চোখে  মেলে  তাকালেন।

যোগের  নামে  নানাবিধ  কসরৎ ও ভোজবাজীতে  সিদ্ধপীর  এই যোগীবরের  প্রাত্যহিক  জীবনচর্চা  আমার  চোখে  মহাপুরুষোচিত বলে  মনে  হয়  নি। "ঐ  সকল  আসন  ও  প্রাণায়ামে  কি চিত্তবৃত্তির নাশ  হয়? আসন ও প্রাণায়ামে  এত  নৈপুণ্য  সত্ত্বেও  জীবনধারাতে ইন্দ্রিয়  জয়ের  চিহ্ন  কেন  পরিলক্ষিত  হয়  না? যে সব  যোগ প্রণালীতে  প্রঞ্জা  স্ফুরণের  কোন  লক্ষণ  দেখা  যায়  না, তা  কি যোগ পদবাচ্য?"------ এবম্বিধ  প্রশ্নজালে  জর্জরিত  হয়ে  হাড়োয়া বাবা আমার  উপর  বিষম  ক্রুদ্ধ  হন।

কয়েক  বৎসর  পরে  কুম্ভমেলাতে  গিয়ে  শুনলাম, 'গুহাসাধনার ফলে বিষ্ণুদেবানন্দ  বদ্ধ  উন্মাদ  হয়ে  যায়, সংবাদ  পেয়ে  তার আত্মীয় স্বজন  এসে  তাকে  রাঁচির  পাগলা  গারদে  রেখে  এসেছেন।গুহ্যদ্বারের  পথে  নাড়ীভুঁড়ি  নিষ্কাশনের  কসরৎ  দেখাতে  গিয়ে আন্ত্রিক রক্তক্ষরণের ফলে  সুদত পুরীজী  কালগ্রাসে পতিত হয়েছেন। 
হাড়োয়া  বাবার  আশ্রমে  গিয়ে  দেখলাম  তাঁর  অন্তিম  দশা আগত প্রায়। হায়? তাঁর  সেই  বিশাল  'যোগসিদ্ধ' দেহের এ কী অবস্থা! উৎকট  হাঁপানী  রোগে  তাঁর  দেহ  কঙ্কালসার। হাঁফের  টানে  এক একবার  মনে  হতে  লাগল  তাঁর  চোখ  দুটো  যেন  ঠিকরে  বেরিয়ে আসবে! দমকে  দমকে  কাশি, কাশির  টান  কমলেই  ক্ষীণকণ্ঠে বলে চলেছেন  'হাঃ  প্রাণায়াম!  প্রাণ  গয়া  রাম!' কোথায়  গেল  সেই 'জয় বজরংবলী'  হুঙ্কার আর  অট্টনাদ। একী  শোচনীয়  দশা! ইঙ্গিতে  কাছে ডেকে  আমাকে বললেন --- 'সচ  কহু, ইস  প্রাণায়াম বেগারমেঁ  ঞ্জান কা  প্রাপ্তি  নাহি  হোতি। হাঃ  প্রাণায়াম। প্রাণ  গয়া রাম। হাড়োয়া বাবা  সাধুপুরুষ  সন্দেহ নাই।

কলিকাতায়  ফিরে  আসার  কিছুদিন  পরেই  হাড়োয়া  বাবার মৃত্যুসংবাদ  পাই।



https://www.facebook.com/pages/tapobhuminarmada/454528151310191

Tuesday, June 18, 2013


প্রায়  সাধু-সন্ন্যাসী  থেকে  গৃহী  সবাইকে  বলতে  শুনি---- আমি  নিত্য  গুরুর  নির্দিষ্ট  পন্থায়  সাধন-ভজন  করি, নিত্য  ধ্যান  করি, দৈবী  অনুভূতির  আশায়  বিভিন্ন  ধর্মস্থানে  ঘুরে  বেড়াই, গুরুকে  ভালবাসি, ইষ্টকে  ভালবাসি। কিন্তু  কাজের  কাজ  কিছুই  হচ্ছে  না। কারণ  "ভালবাসি" অর্থাৎ অহং  এই  কথাটা  দগ্‌দগে  ঘায়ের  মত  মনের  মণিকোঠায়  থেকে  যায়। কারণ "ভালবাসি"র  মধ্যে  আমি  থাকে, থাকে  মায়া, থাকে  লোভ। তাই "ভালবাসি"র  ফুল  বাসি  হয়ে  যায়। ফুল  তুললে, মালা  গাঁথলে, গলায়  পরলে, ঠাকুর  সাজালে  তারপর  প্রয়োজন  ফুরালেই 'বাসি'  ফুল  ফেলে  দিতে  হয়। ভালবাসা  রূপ 'বাসি' ফুলে কি  মৌমাছি  বসবে!  না  গুণ্‌গুণ্‌  করবে!  মধু  জমবে  কোথা  থেকে? তাই  ভালবাসার  জন্য  ভাললাগা  ভাল। তাতে  কি  হচ্ছে  আর  হচ্ছে  না, তার  হিসাব  থাকে  না। যে  বাসায়  ভালবাসা  থাকে  সেখানেই  ত  বাস  প্রেমের  ঠাকুর  মদনমোহনের। ভালবাসাই  ভগবান।

আমি-হীন, মায়া-হীন, লোভ-হীন  প্রকৃত  ভালবাসা  যাঁর  হয়  মহাকালের  সেই  মন্দিরা  তখনই  বাজে---- সুখে  বাজে, দুঃখে  বাজে, ফুলে  বাজে, কাঁটায়  বাজে! আলো-ছায়ায়, জোয়ার ভাঁটায়, ভালয়  মন্দয়,  আশা ও শঙ্কার  মধ্যে  বেজে  চলেছে, তাঁর  নিত্যকালের  ডমরু! তিনি  দয়ার  সাগর। তিনি  মন্দিরে  থাকুন  বা  না  থাকুন  তাঁর  সর্বব্যপ্ত  বিরাট  স্বরূপের  অনুধ্যানই  আসল।


অহংতা  চুরি, অহং  চামারি, অহং  নীচেন  কি  নীচ।
অহং  না  হোতি  বিচমে  তো  সাক্ষাৎ  থে  ঈশ।।

অর্থাৎ  অহংকার  চৌর্যাপরাধের  মত  জঘন্য  অপরাধ। অহংকার-বৃত্তি  মেথরাণী  বা  চণ্ডালিনীর  মত  নীচ। জীব ও  ব্রহ্মের  মধ্যে  দুর্লঙঘ্য  বাধা  স্বরূপ  এই  অহং। এই  অহং  না  থাকলে  জীব  সহজেই অনুভব  করতে  পারত  যে  সে  স্বয়ং  ব্রহ্ম  স্বরূপ। 
তখনই  তাঁর  ইষ্ট  বস্তু  লাভ  সহজ  হয়।


https://www.facebook.com/pages/tapobhuminarmada/454528151310191


Monday, June 3, 2013

ভক্তবেশে  আমায়  যারা
                ব্যথাই  হানে  নিতি
আজকে  পাঠাই  তাদের  তরে
                    মোর  হৃদয়ের  প্রীতি।
বন্ধু  নহে  শত্রু  যারা
                      চক্ষে  বহায়  অশ্রুধারা,
পলায়  দূরে  অন্তরেতে
                   ভীষণ  সায়ক  হানি'
আজকে  ভালবাসব  তাদের
               বক্ষে  লব  টানি'।

করল  যে  জন  কৃতঘ্নতা
             'মারীচ'  সম  আসি'
ছল  করে  যে  জানায়  মুখে ---
            'বড়ই  ভালবাসি',
চতুর  সাজি  আমায়  যারা
                           চায়  ভুলাতে  কথার  দ্বারা,
পাঠাই  শুভ  কামনা  মোর
                 পুঁথির  বেশে  সাজি,
পিতরৌ- এর  মন্ত্রবাণী
                           জাগাক্‌  তাদের  আজি।।

Monday, May 27, 2013

তিনি দেখছেন :---


তিনি  দেখছেন !  সতত  পরত  দেখছেন  আমাদেরকে। তাঁর  নির্ণিমেষ  দৃষ্টিতে  আমাদের  প্রতিটি  কর্ম, ভাব  ভাবনা  এষণা  সবই  ফুটে  রয়েছে।  তিনি  বিশ্বতোচক্ষুঃ, তাঁর  বিশ্বব্যাপী  সেই  পরাবর  দৃষ্টির  বাইরে  যাবার  বা  কোন  কিছু  করার  সাধ্য  জীবের  নাই।  তিনি  সবই  সবসময়  দেখছেন। তিনি  দেখছেন   আমরা  কর্মফল  ভোগ  করছি, তাঁরই  অঙ্গীভূত  ও  অংশগত  হয়ে  আমরা  ঘোর  কর্মে  আবদ্ধ  হচ্ছি; তিনি  কেবল  লক্ষ্য  করছেন।  আমরা  জীবরা  বুঝতে  পারছি  না----  নিজেদের  অঞ্জাতসারে----  মোহ  মরীচিকায়  বিভ্রান্ত  হয়ে, অপকর্মের  পর  অপকর্ম  করে  চলেছি। ভ্রমেও  একবার  মনে  করছি  না  যে, একজন  উপর  হতে  আমাদের  দিকে  অপলক  দৃষ্টিতে  তাকিয়ে  রয়েছেন।

কিন্তু  বারেকের  জন্যও  হ্যয়, তাঁর  প্রতি  যদি  আমাদের  দৃষ্টি  পড়ত!  যদি  জীবের  একবারও  দৃষ্টি  পড়ত!  তাঁর  দিকে, যদি  একটিবার  বুঝতে  পারত, অনুভব  করতে  পারত  যে  আর  একজনের  দৃষ্টি  তার  উপর  ন্যস্ত  আছে,  তাহলে  কি  কোন  অপকর্মে  কেউ  প্রবৃত্ত  হতে  পারত? নিজের  ঘরে  স্বামী  স্ত্রী  উভয়ে  মিলিত  হতে  গিয়ে  যদি  দেখে  পাশের  বাড়ী  হতে  জানালা  দিয়ে  কোন  বয়স্ক  পুরুষ  মহিলা  এমনকি  একটি  ফুটফুটে  কচি  শিশুও  তাদের  দিকে  তাকিয়ে  আছে, তাহলে  লজ্জা  ও  সঙ্কোচ  বসে  নিজের  ঘরের  জানালাটা  বন্ধ  করে  দিয়ে, আলো  জ্বললে  অন্ততঃ  আলোটা  নিভিয়ে  দেয়। সেইরকম  জীবের  যদি  বোধ  জাগে  যে, সব  কাজেরই  সাক্ষী  রয়েছেন  একজন তাহলে  কারও  পক্ষে  কোন  অসৎ  ভাবনা  বা  অসৎ  কাজ  করা  কোন  মতেই  সম্ভব  হত  না। 

দ্রষ্টার  প্রতি  দৃষ্টি  পড়লে  তিনি  আছেন, সর্বত্র  আছেন। তাঁর জ্যোতিষ্মান  দৃষ্টি  অহরহ  জাগ্রত  আছে। এই বোধ  দৃঢ়  হলেই কর্মেরর বিপাক  কেটে  যায়। সেই  দৃষ্টিই  দ্রষ্টার  নিকটে  দোর্ষিতকে  নিয়ে যায়। সেই  দৃষ্টির  প্রভাবেই  জীব  মুক্তি  লাভ  করে। ব্যষ্টি  মিলে যায় সমষ্টিতে। জীব চৈতন্যের নির্যান ঘটে অনন্ত চৈতন্যে।

Monday, May 13, 2013

*** মাতৃস্নেহের মাত্রা কেহ জানেনা ধীমান্‌ !


Cont ......(last)

চোখ  বন্ধ  হওয়ার  সঙ্গে  সঙ্গে  আমার  চোখে  এক  অপরূপ  দৃশ্য  ফুটে  উঠল। ফুটে  উঠল  এই  মন্দির। আমরা  হর  নর্মদে  বলতে  বলতে  অর্জুনেশ্বর  মন্দিরে  এসে  পৌঁচেছি, দড়াম  করে  মন্দিরের  দরজা  খুলে গেল। সেই  শুক্লবসনা  শুভ্রকেশী  বৃদ্ধা  গলায়  রুদ্রাক্ষ মালা, দুধের  কলসী  হাতে  নিয়ে  বেরিয়ে  এলেন। অপলক  দৃষ্টিতে  তাঁর  দিকে  তাকিয়ে  আছি।


ধীরে  ধীরে  তাঁর  দেহাভ্যন্তর  থেকে  প্রকটিত  হল  আর  এক  দিব্যাঙ্গনা, জ্যোতির্মণ্ডিতা  মায়ী। সেই  মায়ের  ডান  হাতে  ত্রিশূল বাম  হাতের  চেটোয়  এক  অপূর্ব  সুন্দর  জ্যোতির্লিঙ্গ, লিঙ্গ  হতে  জ্যোতির  কণা  ঠিকরে  পড়ছে। এখন  আর  সেই  দুগ্ধদানরতা  মাতৃমূর্তি  চোখে  ভাসছে  না। সামনে  ভাসছে  তাঁর  নতূন  পরিবর্তিত  দিব্যরূপ; যাঁর  দেহের  প্রতিটি  রোমকূপ  হতে  যেন  স্বর্গীয়  সুষমা  ঝরে  পড়ছে। তাঁকে  ঘিরে  তাঁর  সামনে  পিছনে  জটাজুট  বহু  মহাত্মা  নতজানু  হয়ে  কৃতাঞ্জলি  পুটে  গাইছেন ------



ওঁ  সুখদাং  সমুদাং  সুরনরবন্দিতাং  সর্বকামদাং  শর্মদাং।
বন্দে  নর্মদাং। বন্দে  নর্মদাং।
ওঁ  উজ্জ্বলাঙ্গীং  নতজনতারিণীম্‌  তূর্ণগামিনীং  জনবনচারিণীং।
তরঙ্গিণীং  তততটশোভিনীম্‌  শুভদাং  বরদাং কর্মদাম্‌।
বন্দে  নর্মদাম্‌।। বন্দে  নর্মদাম্‌।।

বিহ্বল  ও  বিভোর  হয়ে  এই  দৃশ্য  দেখতে  লাগলাম। মনে  আর  আনন্দ  ধরে  না। তারপর  ধীরে  ধীরে  সেই  দৃশ্য  অন্তর্হিত  হয়ে  গেল। আমি  জ়েগে  উঠলাম। ঘর  অন্ধকার, চোখ  খুলে  কিছু  দেখতে  পাচ্ছি  না, পাখীর  কলরব  শুনে  বুঝতে  পারছি  সকাল  হয়ে  গেছে। 

উঠে  বসলাম।  হাতের  কাছে  টর্চটা  টিপে  দেখলাম, একমাত্র  বাসবানন্দজী  এবং  তুরীয়  চৈতন্য  নামক  ব্রহ্মচারী  ছাড়া  আর  সকলেই  উঠে  বসেছেন। হরানন্দজী, প্রেমানন্দ  প্রভৃতি  দণ্ডী  সন্ন্যাসীরা  নীরবে  কাঁদছেন। আমি  উঠে  বসে  দেখি  হিরন্ময়ানন্দজী  অশ্রুসজল  কণ্ঠে  বলে  উঠলেন --- হম্‌  সচ্‌  হু, দুপহরমেঁ  যো  মায়ী  হম্‌  লোগোঁকো  দুধ  দিয়া  থা,  উনোনে  স্বয়মেব  নর্মদা।

হরানন্দজী  কাঁদতে  কাঁদতেই  বললেন ---  সে  বিষয়ে  আমার  কোনই  সন্দেহ  নাই। তবে  দুঃখ  এই  স্বপ্নে  মা  তাঁর  পরিচয়  দিয়ে  গেলেন, জাগ্রতাবস্থায়  মাকে  চিনতে  পারলাম  না। তখনই  আমার  হাতদুটো  নিস্‌  পিস্‌  করছিল  পা  দুটো  জড়িয়ে  ধরতে। কিন্তু  দণ্ডী  সন্ন্যাসীর  ফালতু  মর্যাদাবোধ  আমাকে  সে  কাজ  করতে  বিরত  করেছে।

প্রেমানন্দ  এবং  আরও  দুজন  সন্ন্যাসী  একসঙ্গে  বলে  উঠলেন ---  আমরা  স্পষ্টাস্পষ্টি  বলছি, স্বপ্নে  দেখলাম, সেই  বৃদ্ধমায়ীর  শরীর  ধীরে  ধীরে  রূপান্তরিত  হয়ে  মা  নর্মদার  যে  ধ্যানমূর্তির  বর্ণনা  মহর্ষি  মার্কণ্ডেয়  জগদ্‌গুরু  শঙ্করাচার্য  এবং  মহর্ষি  কপিল  প্রভৃতি  দিয়ে  গেছেন, সেইরকম  শ্বেতাম্বরা  শিবকন্যার  দিব্যরূপ  ফুটে  উঠেছিল।

হরানন্দজী  আবার  বললেন ---  নাঙ্গা  সাধু  ঠিকই  মায়ের  প্রকৃত  স্বরূপ  বুঝতে  পেরেছিল, তাই  তাঁর  দেহে  মনে  অস্বাভাবিক  স্ফুর্তি  প্রকাশ  ঘটেছিল। বেটা, বিন্দুমাত্র  আভাষ  দিলেন  না, একা  একা  সমাধির  আনন্দ  ভোগ  করলেন। অশ্রুরুদ্ধ  কণ্ঠে  রঞ্জন  গেয়ে উঠল 


" যে  তোমায়  ছাড়ে  ছাড়ুক,  আমি  তোমায়  ছাড়বো  না  মা!
            আমি  তোমায়  ছাড়বো  না।
মাগো!  আমি  তোমার  চরণ  করব  শরণ
               আর  কারও  ধার  ধারব  না।
কে  বলে  তোর  দরিদ্র  ঘর,  হৃদয়ে  তোর  রতনরাশি ----
আমি  জানি  গো  তার  মূল্য  জানি।
পরের  আদর  কাড়ব  না  মা, পরের  আদর  কাড়ব  না।
মানের  আশে  দেশবিদেশে,  যে  মরে  সে  মরুক  ঘুরে ---
তোমার  ছেঁড়া  কাঁথা  আছে  পাতা ---
ভুলতে  সে  যে  পারব  না,  ভুলতে  সে  যে  পারব  না।
ধনে  মানে  লোকের  টানে, ভুলিয়ে  নিতে  চায়  যে  আমায় ---
ওমা,  ভয়  সে  জাগে  শিয়র ---  বাগে ---
কারও  কাছেই  হারব  না  মা,  কারও  কাছেই  হারব  না।
যে  তোমায়  ছাড়ে  ছাড়ুক,  আমি  তোমায়  ছাড়বো  না  মা!
                  আমি  তোমায়  ছাড়বো  না। "






*** মাতৃস্নেহের মাত্রা কেহ জানেনা ধীমান্‌ !


...... আমার  কথা  শেষ  হতে  না  হতেই  দড়াম  করে  এক  প্রচণ্ড শব্দে  অর্জুনেশ্বরের  মন্দিরের  দরজা  খুলে  গেল। আমরা  সকলেই  চমকে  উঠলাম। প্রথমে  ভেবেছিলাম  হয়ত  নর্মদার  দিক  হতে  উত্তরের  ঝাপ্‌টা  বাতাসের  ধাক্কায়  দরজাটা  খুলে  গেল। কিন্তু  পরে  দেখলাম  না! দমকা  বাতাসের  ঝাপটা  নয়, মন্দিরের  অভ্যন্তর  হতে  একটা  কালো  রং-এর  কলস  হাতে  নিয়ে  এক  শুভ্রবসনা  শুক্লকেশা  এক  বৃদ্ধমায়ী  বেরিয়ে  এসে  আমাদের  সামনে  বসলেন। কলসীভরা  দুধ  এবং  একটি  গ্লাস  রাখলেন  আমাদের  সামনে।

বললেন ---  হম  অগল  বগল  মেঁ  হি  নিবাস  করতা  হুঁ। ইধর ভগবান  কা পাশ  মে  বৈঠকর  জপ  করতা  থা। কোঈ  জানোয়ার  আ কর  তন্‌  না  করে, ইসীওয়াস্তে  হম্‌  কিবাড়  বন্ধ  কিয়া  থা। দণ্ডী  সন্ন্যাসীয়োঁকে  দুধ  পিলানেকে  লিয়ে  হমারা  বহুৎ  দিনোঁ  সে  সংকল্প  থা, আজ  ভগবান  অর্জুনেশ্বরকী  কৃপা সে  মুঝে  মোকা  মিলা। লেও  দুধ  পিজিয়ে। এই  বলে  তিনি  কলসীতে  তামার  গ্লাস  ডুবিয়ে  ডুবিয়ে  আমাদেরকে  দুধ  দিতে  থাকলেন  প্রত্যেকের  কমণ্ডলুতে। আমরা  দুধ  পান  করতে  লাগলাম।


সবার  শেষে  নাগাজীকে  তামার  গ্লাস  ভর্তি  দুধ  দিয়ে  বললেন --আপকা  পাশ  ত  তনিকভর  কুছ  নেহি, না  লোটা,  না  কমণ্ডলু। আপ্‌  ইসীমেঁ  দুধ  পিকর  ইয়ে  পাত্র  নর্মদা  মেঁ  ফেক  দেনা। হামারা  পাশ  দুসরা  পাত্র  হ্যায়।


মাতাজী  যখন  দুধের  পাত্রটি  নাগা  বাবাকে  এগিয়ে  দিলেন, তখনই  নাগাজীর  উপর  দৃষ্টি  পড়ল। দেখলাম, তিনি  থরথর  করে  কাঁপছেন। যাঁকে  এতদিনের  মধ্যে  একবারও  খেতে  দেখিনি, না  দুধ  না  ফল,  এমন  কি  জলও  নয়, আজ  দেখলাম, তিনি  সাগ্রহে  মায়ীর  হাত  থেকে  দুধের  গ্লাস  নিয়ে  এক  চুমুকেই  শেষ  করে  ফেললেন।


মায়ী  দুধের  কলস  হাতে  নিয়ে  ধীরে  ধীরে  চলে  গেলেন, নিকটস্থ  ভীমেশ্বর  মন্দিরের  দিকে। যেতে  যেতে  পিছন  ফিরে  বলে গেলেন ------ আজ  আপ  লোগোনেঁ  ইধার  ঠার  সকতে  হৈ। জন্তু  জানোয়ার  বগেরাঁ  কো  কোঈ  ডর  নেহি। নাগাজীর  কাঁপুনি  আর  থামে  না। তিনি  কাঁপতে  কাঁপতেই  শুয়ে  পড়লেন, মন্দিরের  দাওয়ায়।


ভীমেশ্বর, ধর্মরাজ  প্রতিষ্ঠিত  ধর্মেশ্বর  মন্দির, লুকেশ্বর  তীর্থ, জটেশ্বর  তীর্থ  পরপর  দেখতে  দেখতে  সাড়ে  ৪ টে  বাজে। ঠাণ্ডা  বাতাস  বইছে।  আমরা  দ্রুত  ফিরে  চললাম  নর্মদার  তট  ধরে  অর্জুনেশ্বর  মহাদেবের  মন্দিরে  উদ্দেশ্যে।  সেখানে  পৌঁছে  দেখি,  নাঙ্গা  মহাত্মা  উঠে  বসেছেন। তাঁর  সর্বাঙ্গে  অস্বাভাবিক  ভাবে উজ্জ্বল  দেখাচ্ছে। হরানন্দজী  তাঁকে  দেখেই  বললেন --- কী  ব্যাপার! আজ  যে  দেখছি, সর্বাঙ্গে  স্ফুরিছে  জ্যোতি, আঁখিপাতে  প্রশান্তির  ছায়া!


তিনি  সলজ্জভাবে  উত্তর  দিলেন --- 'আজ  খুব  ঘুমিয়ে পড়েছিলাম'।


----- ঘুম  না  সমাধি! দেখুন  মশাই  আমাদের  গুরুদেবের  সবিকল্প  আনন্দ  সমাধি  দর্শনের  বহুবার  সুযোগ  হয়েছে। কামরূপ  মঠের  সন্ন্যাসীকেও  জিনিষ  লুকাতে  পারবেন  না। যাক্‌গে, আপনার  মত  সাথী  পেয়ে  আমরা  খুশী।'


নাগাজী  হরানন্দজীকে  আর  কথা  বলার  সুযোগ  না  দিয়ে  তাড়াতাড়ি  উঠে  পড়লেন।  বললেন --- আমি  অদূরে  ধর্মেশ্বর  মন্দিরে  আজ  রাত  কাটাবো। আপনারা  সকলেই  এই  মন্দিরে  প্রবেশ  করুন। ভোরেই  আমি  আপনাদের  কাছে  পৌঁছে  যাবো। এই  বলে  তিনি চলে  গেলেন  ধর্মেশ্বর  মন্দিরের  দিকে। 


আমরা  টর্চ  টিপে  ঢুকে  পড়লাম  মন্দিরে। মন্দিরের  দরজা  বন্ধ  করে  আমরা  যে  যার  আসন শয্য  পেতে  নিলাম। মহাদেব  অর্জুনেশ্বরকে  প্রণাম  করে  আমরা  বসে  গেলাম  সান্ধ্যক্রিয়ায়। ঘণ্টা  দুই  ধরে  সকলেই  জপ  ধ্যান  করে  সকলেই  শুয়ে  পড়লাম, কম্বল  মুড়ি  দিয়ে।


আমার  একপাশে  হরানন্দজী  এবং  অন্যপাশে  রঞ্জন  শুয়েছেন। হরানন্দজী  আমাকে  ফিস্‌ফিস্‌  করে  জানালেন --- আশ্চর্য  বাইরে  যথেষ্ট  কনকনে  ঠাণ্ডা  বাতাস  ঝড়ের  মত  বইলেও  এই  মন্দিরের  মধ্যে  তেমন  ঠাণ্ডা  লাগছে  না। আমি  মতলব  করে  রেখেছিলাম, তিন দিন  আগে  আপনার  দেওয়া  এক  রেণু শঙ্খিনী  খেয়েছিলাম, আজও  ঐ  নাগা  বাবার  দেওয়া  এক মাত্রা  খাবো।কিন্তু  মন্দিরের  মধ্যে  তত  শীত  অনুভব  না  হওয়ায়  আর খেতে  ইচ্ছা  করছে না।


কী ব্যাপার  বলুন  তো, যিনি  আমাদেরকে  দুধ  খাইয়ে  গেলেন, তাঁর  কথামত  আমরা  আজ  মন্দিরে  থেকেছি  বলে  কি, ঐ  শুদ্ধসত্ত্ব  মায়ীর  বাক্য বলেই  শীত  আজ  কম  বলে  অনুভূত  হচ্ছে? আমি  ফিস্‌ফিস্‌  করেই  বললাম --- হতে  পারে! ঐ  মায়ী  যদি  তপস্বিনী  হন, তাহলে তাঁর  বাক্যবলে  সবই  সম্ভব। আমার  খুব  ঘুম  পাচ্ছে, পরে  কথা  হবে। এই  বলে  ঘুমিয়ে  পড়লাম।



To  be continued ............