Sunday, February 28, 2016

"স্বামী ভোলানন্দ তীর্থ" ---


কামরূপ মঠের উত্তরাধিকারের যোগ্যতম উত্তর সাধক ছিলেন --- স্বামী ভোলানন্দ তীর্থ। এঁর পূর্বাশ্রমের নাম ছিল ভোলানাথ মুখোপাধ্যায়। জন্মস্থান --- বর্ধমান। সংসারে তাঁর একমাত্র বন্ধন ছিলেন মা। মায়ের দেহান্তের সঙ্গে সঙ্গে তিনি বর্ধমান, পুরী, ভুবনেশ্বর, হরিদ্বার, কাশী ও প্রয়াগ প্রভৃতি স্থানের ১২ খানি অট্টালিকা এবং নগদ ৩ লক্ষ টাকা চতুষ্পাঠী স্থাপন এবং সৎ কাজের জন্য দান করে দিয়ে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। সন্ন্যাস গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে  কামরূপ মঠের যে গুফাটিতে আশ্রয় নেন, সেখানে থেকে রাত্রি ৩টে একমাত্র গঙ্গা স্নান ছাড়া অন্য কোন কারণেই মঠের বাইরে যেতেন না। মঠের পেছনে প্রায় দুইশত গজ দূরেই গোধূলিয়ার মোড়। কিন্তু তিনি তাঁর সুদীর্ঘ ৬২ বৎসরের সন্ন্যাস জীবনে গোধূলিয়া দেখেন নি। পবিত্র সন্ন্যাস-ধর্ম যে কী কঠিনতম ব্রত, তা অজগর-বৃত্তিধারী এই মহাতপা যোগীর পুণ্যজীবন দেখলে তবেই মর্মে মর্মে অনুভব করা যায়। 

তাঁর জীবন-দর্শনের আভাষ ---

ভারত বিখ্যাত মহামহোপাধ্যায় বামাচরণ ন্যায়াচার্যের পুত্র পণ্ডিত গোপাল ন্যায়াচার্য একদিন স্বামীজীর সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। তিনি ছিলেন, তাঁর ভগ্নীপতি কবিরাজ নিবারণ ভট্টাচার্যের প্রতিষ্ঠিত দিল্লী আয়ুর্বেদিক ফার্মেসীর কর্মাধ্যক্ষ। দিল্লী ও উত্তরপ্রদেশের নানা স্থানে তার শাখা প্রশাখা আছে। এই কবিরাজী দোকানের কাজে তাঁরা বহু অর্থ উপার্জন করেছিলেন। তিনি স্বামীজীকে বললেন --- 'তোমার আশীর্বাদে আমরা বহু অর্থ উপার্জন করেছিলাম, অহংকারে তোমাকে মানিনি, আজ বড় দুঃসময়, গতবছর থেকে আমরা ব্যবসায়ে মার খাচ্ছি। তুমি আশীর্বাদ কর। আমাদের পূর্বের অবস্থা ফিরিয়ে দাও।' 

স্বামীজী --- সে কি ভগবন্‌। আমি আবার তোমার ভাগ্য ফিরালুম কবে? আমি নিজে ভিখিরি, বিশ্বনাথের দুয়ারে পড়ে আছি। ভিখিরি আবার টাকার সন্ধান জানবে কি করে? তুমি তোমার কর্ম অনুযায়ী ফল পেয়েছ বা পাচ্ছ। অতবড় পণ্ডিতের ছেলে তুমি, পাছে টাকার প্রয়োজনে অন্য কোন বৃত্তি তুমি অবলম্বন করে ফেল, এজন্য বলেছিলাম সংস্কৃত জান যখন, আয়ুর্বেদের চর্চা করে বিশুদ্ধ কবিরাজী ঔষধের দোকান কর। আশা ছিল --- তোমার সংসারের প্রয়োজনও মিটবে আর ...... আর যে বিরাট প্রতিভা থেকে তোমার জন্ম, হয়ত একদিন তোমার হাত দিয়ে কোন বিস্ময়কর ওষুধও বের হয়ে যেতে পারে। নতুবা আমার মত ভিখিরি, টাকার সুলুক-সালুক কি করে জানবে ধন? ছিঃ বাবা, সন্ন্যাসীর কাছে টাকা চাইতে নেই, টাকা দিতে নেই, টাকার প্রসঙ্গ তুলতে নেই। 

স্বামীজীর এই কথা শুনে গোপালবাবু বড় কাতর হয়ে পড়লেন। কিছু পরে স্বামীজী উঠে পড়লেন। বললেন চল ভগবন্‌, উপরে লাইব্রেরী ঘরে যাই। তিনতলায় ছাদের উপর তখন মঠ সংলগ্ন একটা অশ্বত্থ গাছের ছায়া পড়েছে। সূর্যাস্ত হতে তখন বেশী দেরী ছিল না। হঠাৎ স্বামীজী গোপালবাবুকে জিঞ্জেস করলেন --- ' ভগবন্‌! এই যে এখানে দাঁড়িয়ে আছি, একটু আগে এখানে রোদ ছিল, এখন ছায়া পড়েছে। এই যে ছায়া এটা কি সূর্যের জন্য, না কালের জন্য? 

গোপাল --- কালের জন্য। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। তাই ছায়া। 

স্বামীজী --- আবার রোদ আসবে? 

গোপাল --- হ্যাঁ, আবার রাত্রি গত হলে কাল সকালে এইখানে রোদ আসবে। 

স্বামীজী --- তবে দেখ, রোদের পর ছায়া, দিনের আলোর পর সন্ধ্যা --- এই তো নিয়ম। কাল শুভ হয়েছিল, তোমার ঐশ্বর্য হয়েছিল, এখন সন্ধ্যা --- অপেক্ষা কর, আবার ঘুরে ঘুরে সূর্যের আলো এইখানেই এসে পড়বে। এই নিয়ম। এতে কারও হাত নেই। মনে কর, একটা নাচ-উলি, হাসিমুখে নাচ দেখিয়ে চলে গেল সোনারপুরার দিকে। তুমি বসে আছ জঙ্গমবাড়ীতে। এখন তুমি যদি তাকে ঐখানে আটকে রাখতে না পার অথচ তার নাচ দেখবার জন্য আবার যদি ইচ্ছা কর, তাহলে তোমাকে অপেক্ষা করতেই হবে, ঠায় ঐখানটায় দাঁড়িয়ে থাকতে হবে যতক্ষণ না সে নাচ-উলি আবার ঐ রাস্তা দিয়ে ফিরে আসে। আবার এটাও ভেবে দেখা দরকার, ঠিক এই পথ দিয়েই সে আসতেও পারে, নাও পারে। এলেও হাসিমুখে আবার নাচ দেখাবে কিনা তার কোন ঠিক নেই। সবই তাঁর ইচ্ছা ভগবন্‌।

Monday, February 15, 2016

"কামরূপ মঠ" ---


কামরূপ মঠ হল কাশীর প্রাচীনতম মঠগুলির মধ্যে অন্যতম। বর্তমানে যেখানে বারাণসী শহর অতি প্রাচীনকালে তার উপর দিয়ে গোদাবরী নদী বয়ে যেত। এই নদী দাক্ষিণাত্যের বিখ্যাত গোদাবরী নয়। কাশীস্থ এই গোদাবরী নদীর উভয়দিকে বিস্তীর্ণ গোচারণ ভূমি ছিল, গোক্ষুরোত্থিত ধূলিতে গোদাবরীর উভয়তীর সমাচ্ছন্ন থাকতো বলে পরবর্তীকালে কাশীর বিখ্যাত কেন্দ্রস্থলটির নাম হয়েছে গোধূলিয়া। 


গোদাবরী, বরুণা এবং অসি নদীর সঙ্গমস্থলেই ছিল ব্রহ্মা কর্ত্তৃক অনুষ্ঠিত  দশটি অশ্বমেধ যঞ্জের কেন্দ্রস্থল। কালক্রমে নদীগুলি একটু একটু করে স্থান পরিবর্তন করে গঙ্গার সঙ্গে মিশে গেছে। 


ব্রহ্মার প্রধান যঞ্জকুণ্ডের উপরেই এই কামরূপ মঠ গড়ে ওঠে। মঠের তাম্রশাসনে দেখা যায়, কামরূপের রাজা চন্দ্রকান্ত সিংহ মবল ১২৩০ শকাব্দে তাঁর গুরু মহাযোগী মহাদেবানন্দ তীর্থের তপস্যা-ক্ষেত্র হিসাবে এই মঠ স্থাপন করেন। এই মঠের আচার্যগণের ত্যাগ ও তপস্যার নানা কাহিনী প্রবাদ বাক্যের মত প্রচলিত। স্মরণাতীতকাল থেকে ভারতের সাধু সমাজে এই মঠ এক অসাধারণ মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত। 


অদ্বৈতবেদান্ত রাজ্যের যিনি দ্বিতীয় শঙ্করাচার্য, অমূল্য মহাগ্রন্থ অদ্বৈতসিদ্ধিঃ প্রণেতা আচার্য শ্রীমধুসূদন সরস্বতীও এই মঠের তলদেশস্থ ধ্যান গুহায় কিছুদিন বাস করেছিলেন। পুরীর গোবর্ধন মঠের শঙ্করাচার্য, বিশ্ববিশ্রুত অঙ্কবিদ্‌ এবং বৈদান্তিক শ্রীমৎ স্বামী ভারতী কৃষ্ণতীর্থ মহারাজের গুরুদেব শ্রীমৎ স্বামী মধুসূদন তীর্থজীও ছিলেন এই মঠেরই অনুগত সন্ন্যাসী। তিনি প্রায়ই বলতেন --- 'সন্ন্যাসীর পক্ষে অহমিকা থাকা অপরাধ। কিন্তু যখনই মনে করি যে আমি কামরূপ মঠের সন্ন্যাসী, তখন আমার মনে অহঙ্কার জাগে!'



September 2, 2013  ("সাধু হো তো য়্যাসা")