"............ এমন সময় পেণ্ড্রা হতে উৎরাই-এর পথে এই কোটেশ্বরের মন্দিরে নেমে এসেছিলাম, সেই দিক দিয়ে একদল লোককে নেমে আসতে দেখা গেল। আমরা মন্দিরের বারান্দায় বসেছিলাম নর্মদার দিকে মুখ করে, কাজেই আমাদের চোখে পড়ে নি। মন্দিরের পিছনে গাছ তলায় যে তিন চারজন নাগা বসেছিলেন, তাঁরাই প্রথম দেখতে পায় তাদেরকে নেমে আসতে। তাঁরাই ছুটে এসে মোহান্তজীকে খবর দেয় যে একদল সশস্ত্র ভীলকে এদিকে আসতে দেখা যাচ্ছে। সংবাদ শুনেই মোহান্তজীর মুখ গেল শুকিয়ে।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে লক্ষ্মণভারতীজী উঁকি মেরে দেখেই মৃদু কণ্ঠে বললেন --- 'ভীল লোগ আ গয়ে। জয় কোটেশ্বর! 'হর নর্মদে, হর নর্মদে।' মন্দিরের পেছনে পৌঁছেই তারা হুঙ্কার তুলল মূক্ মূক্ মূক্। সমস্ত নাগাই তখন বারান্দায় এবং সিঁড়িতে জড় হয়েছেন। ভীলরা এসেই লাফ দিয়ে বারান্দায় উঠেই এলোপাতাড়ি লাঠি চালাতে লাগল। কয়েকজন নাগা ত্রিশূলের খোঁচা মেরে বাধা দিবার চেষ্টা করেছিলেন।
মোহান্তজী হাত জোড় করে তাদেরকে বলতে লাগলেন ---- হমারা যো কুছ হ্যায় লে যাও, হম দে দেতে হেঁ। লেকিন মার ডালো মৎ। লক্ষ্মণভারতীজী যেটুকু ভীল ভাষা জানেন তারই সাহায্যে চেঁচিয়ে বললেন মোহান্তজীর বক্তব্য। কিন্তু কে শুনে কার কথা।
লক্ষ্মণভারতীকে ধরে তাঁর কাঁধের ঝোলা ছিনিয়ে নিয়ে তা উল্টিয়ে দেখতে লাগল। ঝোলার মধ্যে ছিল তাঁর একটি কৌপীন, একটা নেকড়াতে বাঁধা আধসেরটাক আটা এবং উনুন ধরানোর জন্য দুটো শুকনো ঘুঁটে। যে নাগারা তাদেরকে ত্রিশূলের খোঁচা মেরেছিল তাঁদেরকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছে সিঁড়ির ধাপ থেকে নিচে।
ইতিমধ্যে প্রত্যেক নাগাই তাঁদের ঝুলি ঝেড়ে প্রত্যেকের সঞ্চিত সেই আধসেরটাক করে আটা তাদের পাতা একটা ময়লা কাপড়ে উপুড় করে ঢেলে দিতে লাগলেন । যে ভীল দস্যুটা লক্ষ্মণভারতীর ঝোলা উপুড় করে দেখছিল । সে তাঁর সেই ঘুঁটে দুটো ভেঙে গুঁড়ো করতে আরম্ভ করতেই তার ভিতর থেকে ঠং করে পড়ল দুটো গিনি । আর যায় কোথায় ? প্রচণ্ড উল্লাসে মূক্ মূক্ শব্দে হুঙ্কার দিতে দিতে তারা তাঁকে চড় চাপড় দিতে লাগল । যে ভীল দুজনকে ত্রিশূলের খোঁচা মারা হয়েছিল তাদের শরীর রক্ত ঝরছে । তারা ক্রুদ্ধ আক্রোশে যাকেই হাতের কাছে পাচ্ছে তাকেই এলোপাতাড়ি লাঠিপেটা করছে। চারদিকে হৈ হৈ শব্দ, আর্তনাদ, "হর নর্মদে হর নর্মদে" শব্দে পরিত্রাহি চীৎকার।
দুজন ভীল এসে আমার গাঁঠরী খুলে আমার ঋগ্বেদ ও রেবাখণ্ড প্রভৃতি বই চার খানাকে পাতা উলটিয়ে দেখতে লাগল তাতে কোন টাকা লুকানো আছে কিনা । মতীন্দ্রজীর কোর্তা ঘেঁটে পেয়ে গেল তার হাতঘড়ি।
মোহান্তজীর ঝোলা ঘেঁটে পেল কিছু টাকা এবং একটি পকেট ঘড়ি । একজন সেগুলি তাদের সর্দারের কাছে জমা দিল, একজন তাঁর মাথায় যে জটার কুণ্ডলী চূড়ার আকারে কুণ্ডলিত ছিল, তা ধরে টান দিয়ে খুলে ফেলতেই আবার ঠং ঠং করে পড়ল তিনটি গিনি। সর্দার সেগুলি কুড়িয়ে নিয়ে কিছু ইশারা করল। দুজন তাঁকে কিল ঘুষি লাগাতে লাগাতে জটা ধরে টান দিয়ে মেঝেতে ফেলে দিয়ে লাথি মারতে লাগল। এ দৃশ্য আমাদের সহ্য হল না।
জয় 'মা নর্মদে' বলে আমি (লেখক) এবং মতীন্দ্রজী একসঙ্গে ত্রিশূল উঁচিয়ে প্রাণপণ শক্তিতে যে মোহান্তজীকে লাথি মারছিল তাকে আঘাত করলাম। লোকটা রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে গেল ঠিকই কিন্তু প্রায় দশজন ভীল দৌড়ে এসে আমাদেরকে পিছন থেকে জাপ্টে ধরে নিরস্ত্র করে টেনে নিয়ে গিয়ে বেঁধে ফেলল দুটো থাম্বায়। সর্দারের আদেশে দুজন দুটো টাঙ্গি নিয়ে আমাদের সামনে এসে দাঁড়াল। তাদের উদ্যত টাঙ্গির সামনে দাঁড়িয়ে মৃত্যু সন্নিকট জেনে ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলেছি।
এমন সময় মন্দিরের ভিতরটা এমন প্রবল হুঙ্কার এবং অট্টাট্ট হাসিতে ফেটে পড়ল যে, আমি ত কেঁপে উঠে চোখ খুললামই, আমাদের সামনের দুজন ঘাতকও এমন কেঁপে উঠেছে যে তাদের হাত থেকে টাঙ্গি খসে পড়ল। দরজা খুলে সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন সেই সাড়ে ছ'ফুট দীর্ঘদেহী দিগম্বর করপাত্রীজী।
তাঁর বিরাট কলেবর ক্রোধে রক্তবর্ণ, হুঙ্কার তুলছেন ----- অ-মূক্ রগড়্যা, অ-মূক্ রগ্যাড়া ! চকমকি ঠুকলে যেমন্ অগ্নিস্ফুর্লিঙ্গ বেরোয়, তেমনি তাঁর রক্তবর্ণ বড় বড় চোখ দুটি থেকে অগ্নুদ্গীরণ হচ্ছে। তিনি দরজার চৌকাঠ পেরিয়েই দড়াম্ শব্দে বসে পড়লেন। সঙ্গে সঙ্গে ভীলরাও যে যেখানে যে যে অবস্থায় ছিল দড়াম্ দড়াম্ শব্দে পড়ে যেতে লাগল। ভীলরা পড়েই থাকল, মহাত্মা উঠে দাঁড়িয়ে একটি হাত ঊর্ধ্বে তুলে হুকুম দিবার ভঙ্গীতে গর্জন করে বলে উঠেলেন ------ অকাতে ভাগ বাকেকানা। ভীলরা তখন ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে কেবলই মাথা ঠুকে চলেছে মহাত্মার উদ্দেশ্যে। তবুও তাঁর জ্বলন্ত চুক্ষু দেখে মনে হল, তিনি এখনও শান্তভাব ধারণ করেন নি। মহাত্মা স্বয়ং এগিয়ে এসে আমার আর মতীন্দ্রজীর বন্ধন মোচন করলেন।
ভীলদের সর্দার পাঁচটি গিনি এবং দুটি ঘড়ি মেঝের উপর রেখে, এমন কি তাদের অস্ত্র-শস্ত্রও ফেলে রেখে বিষণ্ণ বদনে শূন্য হাতে ফিরে যেতে লাগল। মোহান্তজী মহাত্মার পদতলে পড়ে অশ্রু নয়নে প্রার্থনা জানালেন --- ভগবন! এই ভীল লোক বড়ই অভাবী, অভাবের তাড়নায় লুটপাট করে। আপনি দয়া করে এদেরকে আটাগুলি নিয়ে যাবার অনুমতি দিন। বনে জঙ্গলে হিংস্র শ্বাপদের সঙ্গে লড়াই করেই এদেরকে বেঁচে থাকতে হয়, কাজেই তাদেরকে অস্ত্র-শস্ত্রও নিয়ে যেতে আঞ্জা দেওয়া হোক। মহাত্মা মাথা নেড়ে সম্মতি দিতেই ভীলরা আটা এবং তাদের অস্ত্রশস্ত্র কুড়িয়ে নিয়ে মন্দিরের পিছন দিকে নেমে গিয়ে পেণ্ড্রার দিকে চড়াই এর পথ ধরল।
মহাত্মাও দ্রুত মন্দির থেকে নেমে তাদের পেছনে পেছনে যেতে লাগলেন। আমরা করজোড়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখলাম, তাঁকে পিছনে ফিরে দেখতে পেয়েই ভীলরা ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড় লাগালো। করপাত্রীজী অনেকখানি চড়াই এর পথে উঠে গিয়ে হেঁকে বললেন --- সামকা বখৎ ভেট হোগা। আভি আরাম করিয়ে।"
https://www.facebook.com/pages/tapobhuminarmada/454528151310191