Wednesday, February 15, 2012

খাড়েশ্বরী মহারাজঃ---


Cont (Last) .............. 

গুলজারী ঘাটের মন্দির দর্শনের পর বিন্ধ্যেশ্বরীজী বললেন---- 
গুরুজীকো ছোড়কে জ্যায়দা সময় বাহার মেঁ রহ্‌না ঠিক নেহি। গুলজারী ঘাটের শিবমন্দিরের দরজা খুলেছে। প্রণাম করে গুলজা গ্রামে ঠাড়েশ্বরী মহারাজের আশ্রমে ফিরে এলাম। 

তখনও অনেক বেলা আছে। এসে দেখলাম ঠাড়েশ্বরীজী সেই একইভাবে দাঁড়িয়ে আছেন। বিন্ধ্যেশ্বরীজী তাঁর গুরুদবকে প্রণাম করে কুটিরে গিয়ে ঢুকলেন, আমি নর্মদার ঘাটে গিয়ে বসলাম। মনের মধ্যে অনেক চিন্তা ভিড় করে এল। হিন্দুধর্মের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সাধুদেরকে ইষ্টসিদ্ধির জন্য অনেক রকম শারীরিক নির্যাতন ভোগ করতে দেখেছি। প্রয়াগে কুম্ভমেলায়, কল্পবাস ব্রত পালনের সময় মাঘমেলায় আমি ঊর্ধবাহু, আকাশমুখী, পঞ্চধুনী, জলশয্যী প্রভৃতি নানা শ্রেণীর সাধু দেখেছি। গুদড়ী সম্প্রদায়ের সাধু সবসময় চলতে থাকেন, হয় পথে নতুবা একটা নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে পদচালনা করতে করতে তাঁদের দুটো পা ফুলে গেছে তবুও হাঁটার ছন্দে তাঁদের পদচালনায় বিরাম নাই।

কেউ কেউ এক বা উভয় বাহুকে সতত উর্ধেই তুলে রাখেন। কেউ বা উপরের দিকে কোন গাছের ডালে পা দুটো বেঁধে রেখে অধোমস্তকে ঝুলতে থাকেন এবং মাথার নিচে অগ্নিকুণ্ড স্থাপন করেন। এঁদের নাম ঊর্ধমুখ তপস্বী।মেদিনীপুর জেলার ধলহারা গ্রামে 'পাগলী মা' বা গৌরীমা নামে একজন মহাসাধিকা ছিলেন। আমার জীবনে তিনিই প্রথম সাধু। তখন আমার বয়স মাত্র বার।আমাদের গ্রামবাসী পুঁটিরাম পাত্র নামে পাগলীমায়ের এক শিষ্যের সঙ্গে তাঁকে দর্শন করার জন্য বাবা আমাকে পাঠিয়েছিলেন।

গিয়ে দেখেছিলাম, বৈশাখ মাসের খর রৌদ্রে পাঁচ পাশে পাঁচটা অগ্নিকুণ্ড জ্বেলে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সেই যোগেশ্বরী মা পঞ্চতপা করছিলেন। তাঁর গুরু ভূষণানন্দজী ছিলেন ত্রাটক সিদ্ধ মহাযোগী।তিনি প্রতিদিনই সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সূর্যের দিকে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন।কুম্ভমেলাতে কাউকে দেখেছি কাঁটার উপর শুয়ে আছেন, কেউ বা প্রচণ্ড শীতে গলা পর্যন্ত জলে ডুবিয়ে সাধনা করে চলেছেন। এঁদের নাম জলশয্যী।অযোধ্যার সরযূতীরে এক মহাত্মার জল-তপস্যা দেখেছিলাম, একটি মাচার নিচে একটি খাদ, খাদটি জলপূর্ণ, তার মধ্যে তিনি গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে বসে আছেন, মাচার উপর একটি ছিদ্রযুক্ত কলস, দুজন সেবক অহরহ সেই কলসে জল ঢালছেন,সেই জল সাধুর মাথার উপর গিয়ে পড়ছে। তিনি তন্ময় হয়ে ইষ্টনাম জপ করে চলেছেন।

পঞ্চধূনী বা পঞ্চতপার চেয়েও এই জল-তপস্যাকে কঠিনতর বলে মনে হয়েছিল।এখানে এই গুলজা গ্রামের ঠাড়েশ্বরী মহারাজকে দেখছি দিবারাত্র দণ্ডায়মান অবস্থায় নিজের সাধনায় মগ্ন আছেন। 
এইসব কথা ভাবতে ভাবতে নিজের মনে ধিক্কার জন্মাল।আমার পক্ষে ত কোন উগ্র তপস্যাই সম্ভব নয়। তাহলে আমার কি হবে? নর্মদেশ্বর শিবের উদ্দেশ্যে বললাম- প্রভু! তোমার কৃপালাভ করতে হলে এত যদি উৎকট উগ্র তপস্যার প্রয়োজন হয়, তাহলে তোমার নাম আশুতোষ কেন?

সূর্যাস্ত হচ্ছে, ধীরে ধীরে অন্ধকারের ঢল নামছে বিন্ধ্যপর্বতের সর্বত্র। আশ্রমে ফিরে এলাম, পাঁচ-ছয়জন মহিলা এসে আমলকীর ডালে প্রদীপ জ্বালিয়ে ঝুলিয়ে দিচ্ছেন।

বিন্ধ্যেশ্বরীজী ধূপ, দীপ এবং কর্পূর জ্বালিয়ে তাঁর গুরু ঠারেশ্বরী মহারাজের আরতি করতে করতে বলছেন----


আনন্দমানন্দকরং প্রসন্নং ঞ্জানস্বরূপং নিজবোধযুক্তম্‌।
যোগীন্দ্রমীড্যং ভবরোগবৈদ্যং শ্রীমদ্‌গুরুং নিত্যমহং ভজামি।।

ঠাড়েশ্বরীজীর দেহে মনে কোন চাঞ্চল্য নাই, বিকার নাই, কোন দিকে দৃকপাত করছেন না, তাঁর অপলক দৃষ্টি একইভাবে নর্মদার দিকে নিবদ্ধ রয়েছে।

আরতি শেষ হতেই মায়েরা চলে গেলেন। বিন্ধ্যেশ্বরীজী ঠাড়েশ্বরীজীকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলেন। আমিও প্রণাম করলাম। প্রণাম করে উঠে দাঁড়াতেই দেখলাম, তাঁর ডানহাতের তর্জনীটি আহ্বানের ভঙ্গীতে নড়ে উঠল,দৃষ্টি সেই একইভাবে নর্মদার দিকে, আমি তাঁর তর্জনীর ইঙ্গিত বুঝতে পারিনি, বিন্ধ্যেশ্বরীজী আমার গায়ে টোকা দিয়ে মহাত্মার কাছে এগিয়ে যেতে সংকেত করলেন। আমি তাঁর কুণ্ডলের কাছে এগিয়ে যেতেই তিনি মৃদুকণ্ঠে বলে উঠলেন---য়হু খালা কা ঘর নাঁহি। 

এই খণ্ডিত বাকাংশের মর্ম কিছু বুঝলাম না। বক্তার দৃষ্টিতে যদি কোন vibration or expression না থাকে তাহলে এমনিতেই বক্তব্য বিষয়ের রস বা ভাব উপলব্ধি করা যে কোন শ্রোতার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে, বিশেষতঃ এখানে তাঁর উচ্চারিত শব্দগুলি আংশিকভাবে উচ্চারিত হয়েছে, যার আক্ষরিক শব্দার্থ হল---এটা মাসীর বাড়ী নয়! হঠাৎ কোন কথা নাই বার্তা নাই, বিনা প্রসঙ্গে আচমকা তিনি এমন কথা কেন বললেন বুঝতে পারলাম না। আমি নীরবে দাঁড়িয়েই রইলাম।

এক মিনিট পরেই তিনি আবার মৃদুকণ্ঠে বলতে লাগলেন--- 


কবীর য়হু ঘর প্রেম কা,খালা কা ঘর নাঁহি।
সীস উতারৈ হাথি করি, সে পৈসে ঘর মাহিঁ।।
কবীর নিজ ঘর প্রেম কা মারগ অগম অগাধ।
সীস উতারি পগ তলি ধরৈ তব নিকটি প্রেম কা স্বাদ।।

অর্থাৎ নিজের হাতে মাথা কেটে হাতে নিয়ে প্রবেশ করতে হবে প্রভুর প্রেম-মন্দিরে।দুর্গম সেই পথ, অসীম তার বিস্তার।এ মাসীর বাড়ী নয় যে আবদার করলে আর চোখের জল ফেললেই যা চাওয়া যায় তাই পাওয়া যাবে!

মহাত্মা আর কিছু বললেন না---আগের মতই নীরব নিথর নিস্পন্দ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। আমরা কুটিরে ফিরে এলাম।বিন্ধ্যেশ্বরীজী আমাকে জড়িয়ে ধরে খুব আনন্দ প্রকাশ করতে লাগলেন।কারণ, তাঁর গুরুদেব ক্কচিৎ কদাচিৎ কারও কারও সঙ্গে দু'একটি কথা বলেন বটে কিন্তু গত বিশ বৎসরের মধ্যে আমাকে নিয়ে মোট তিনজনের সঙ্গে কথা বলতে তিনি দেখলেন।কাজেই আমার মহাসৌভাগ্য। 

বিছানায় বসে নানা কথা ভাবতে লাগলাম।বিকেলে নর্মদার ঘাটে বসে পঞ্চতপা, জলতপা, উর্ধ্বপদ, হেঁটমুণ্ডে থাকা এবং দিন রাত্রি দাঁড়িয়ে থাকা প্রভৃতি তপস্যাকে আমি উৎকট এবং উগ্র ভেবে মনে মনে ভগবানের কাছে ফরিয়াদ জানাচ্ছিলাম যে এত কঠোর তপস্যা ছাড়া তোমাকে পাওয়া যাবে না, এই যদি তোমার বিধান হয় তাহলে তোমার আশুতোষ নাম কি মিথ্যা? বুঝতে পারলাম---ঠাড়েশ্বরী মহারাজ আজ সন্ধ্যায় তারই জবাব দিয়েছেন।বিন্ধ্যেশ্বরীজী আমাকে আগেই কথায় কথায় জানিয়েছেন যে আমি যেদিন সন্ধ্যায় এখানে এসে পৌঁছলাম সেদিনই মধ্যাহ্নে নাকি তাঁর গুরুদেব আমার আসার কথা পূর্বাহ্নেই জানিয়ে দিয়েছিলেন।মহাত্মা কি সত্যই অন্তর্যামী? 

হোন তিনি অন্তর্যামী, তবুও তাঁর ঐরমক তপস্যার উগ্রতাকে ভগবৎ প্রাপ্তির উপায় বলে সর্বান্তকরণে গ্রহণ করতে পারছিলাম না। আমার মনে হল, আপাতঃদৃষ্টিতে ঠারেশ্বরী মহারাজের ঐরকম বিচিত্র তপশ্চরণকে যতই কঠোর মনে হোক, এর মূলেও আছে ভগবানের প্রতি বিশুদ্ধ প্রেম।

প্রীতম প্রিয়তমের প্রতি আকুল-করা পাগল-করা সেই সব ভুলানো প্রেম ভাব না জন্মালে কি কোন মানুষের পক্ষে নরদেহ ধারণ করে এত কষ্ট সহ্য করা সম্ভব হয়? কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ভক্তিস্নিগ্ধ ভাষায় এই রকম অবস্থার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন, যার হৃদয়ে ভগবৎ প্রেমের আলো এসে পড়েছে---'তার বক্ষে বেদনা অপার, তার নিত্যজাগরণ'। 

যে ভগবানের প্রেমে বিভোর হয়, সেই ত জীবনে এবং আচরণে দেখাতে পারে, বলতে পারে---ওরে মন, ওরে আমার প্রিয়বন্ধু, বিবেচনা করে দেখ, প্রণয়ী হলে কি তার শোয়া চলে? সমুঝ দেখ মন মিত পিয়ারা আসিক হো কর্‌ শোনা ক্যা রে? 

ঠারেশ্বরী মহারাজের আমার শুকানো যোগীমাত্র বলে মনে হচ্ছে না, তিনিও আসিক।প্রেমিক বলেই তাঁর শোয়া বসা নাই। অপলক দৃষ্টিতে অহোরাত্র তাঁর প্রেমাস্পদের দিকেই তাকিয়ে আছেন। 

কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না। যখন ঘুম ভাঙলো, তখন ভোর হয়ে আসছে। কম্বল মুড়ি দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম। ফাল্গুন মাস পড়ে গেলেও তখনও খুব শীত। কুশায়ার অন্ধকারে সব ঢেকে আছে।কৌতুহল বশে পা টিপে টিপে মহাত্মা যেখানে দাঁড়িয়ে সেখানে এলাম। তাঁর জটা এবং পরিধেয় গৈরিক বস্ত্রখণ্ড শিশির পড়ে ভিজে গেছে। তাঁর ডান দিকের এক কোণে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম, যাতে তিনি আমাকে দেখতে না পান। সহসা দক্ষিণ হস্তের তর্জনী কিঞ্চিৎ নড়ে উঠল। সন্ধ্যাবেলার মত এটাকে তর্জনী সংকেত মনে করে সাহসে ভর করে সামনে এসে দাঁড়ালাম। প্রায় দু'মিনিট পরে পূর্বের মতই মৃদুকণ্ঠে বলে উঠলেন---- 


প্রীতম্‌ হসনাঁ দূরি করি, করি রোবন সৌঁ চিত্ত।
বিন্‌ রোয়াঁ বস্তুঁ পাই এ প্রেম পিয়ারা মিত্ত।।
হঁসি হঁসি কান্ত ন পাইএ,জিন্‌ পায়া তিন্‌ রোই।
জো হাঁসে হী হরিমিলৈ তব্‌ নহীঁ দুহাগিন্‌ কোঈ।।

অর্থাৎ প্রিয়তম এমনিতর দুঃখের পথ দিয়েই আসেন। হাসতে হাসতে তাঁকে পাওয়া যায় না। যে তাঁকে পেয়েছে কাঁদতে কাঁদতেই পেয়েছে; দিন রাত তার চোখের জল ঝরছে, তবে প্রিয়তমের সঙ্গে তার মিলন ঘটেছে। হাসতে হাসতে যে হরিকে পেল তার মত দুর্ভাগা আর কেউ নাই।

আবার সব চুপচাপ। আমি ধীরে ধীরে তাঁর কাছ হতে সরে এলাম।

https://www.facebook.com/pages/tapobhuminarmada/454528151310191