Tuesday, July 23, 2013


মিত্রদ্রোহিতা, বন্ধু  হয়ে  বন্ধুর  সঙ্গে  ছলনা, ব্রহ্ম হত্যার  মত অতি ঘৃণ্য পাপ। ভারতীয় সংস্কৃতির শিক্ষা হল -


মিত্রদ্রোহী  কৃতঘ্নশ্চ  যে  নরাঃ  বিশ্বাসঘাতকাঃ।
তে  নরাঃ  নরকং  যান্তি  যাবচ্চন্দ্রদিবাকরৌ।।

মিত্রদ্রোহী, কৃতঘ্ন  এবং  বিশ্বাসঘাতক --- এই  তিন  প্রকৃতির  লোকই হল  প্রকৃত  চিহ্নিত  পাপিষ্ঠ। যতদিন  আকাশে  চন্দ্র, সূর্য  থাকবেন, ততকাল ঐ  তিন  প্রকৃতির পাপিষ্ঠকে  নরক  যন্ত্রণা  ভোগ করতে হবে। বন্ধুর  বিরুদ্ধাচারণ  করতে  নেই। মত  ও  আদর্শে  যদি কোনদিন উভয়ের  মধ্যে  পার্থক্য  দেখা  দেয়, সসম্মানে  দূরে  সরে থাকাই  ভাল, তবুও  তার  কোনদিন  অনিষ্ট  করতে নেই। উপকারীর উপকার  স্মরণে  না  রাখলে  কিংবা  প্রত্যুপকারের পরিবর্তে  তার  কোনদিন  অপকার  করার  প্রবৃত্তি  জন্মালে, তার নাম  কৃতঘ্নতা। এটি  একটি  মহাপাপ।  কেউ  বিশ্বাস  করে  কোন গোপন কথা  বললে  বা  বিশ্বাস  করে   কোন  দ্রব্য  জমা  রাখলে, প্রাণপন  চেষ্টায়  মন্ত্রগুপ্তির  মত  সেই  বিশ্বাস  রক্ষা  করা  উচিত।


https://www.facebook.com/pages/tapobhuminarmada/454528151310191

Monday, July 15, 2013


প্রাণায়াম:--- প্রাণায়ামে  আয়ু  বাড়ে  কিন্তু  প্রাণায়াম  বলতে ভারতবর্ষের  তাবৎ  লোক  যা  বুঝে  থাকেন  সেই  শ্বাস  প্রশ্বাসের ক্রিয়ার  দ্বারা  আয়ু  বাড়ে  না।  বরং  রোগবৃদ্ধি  হয়, স্বাস্থ্যের হানি ঘটে। মানুষের শরীর কামারশালার  ভস্ত্রা  নয়।কাজেই রেচক পূরক কুম্ভকের নামে  শ্বাস প্রশ্বাসের  কসরৎকে প্রাণায়াম বলে না।"প্রাণায়াম" শব্দটির  অর্থ --- প্রাণের  অয়মন  বা  বিস্তার। সত্যকার প্রাণায়াম  প্রাণঘাতী  নয়। প্রাণায়ামকে  শ্রেষ্ঠ  তপস্যা বলে বর্ণনা করা  হয়েছে। প্রাণায়ামে  সত্য সত্যই  চিত্তবৃত্তির  বিরাম ঘটে।

ভগবান  পতঞ্জলির  মতে  প্রাণায়াম  রূপ  যোগাঙ্গের  অনুষ্ঠানে অশুদ্ধি  ক্ষয়  হয়, অশুদ্ধি  ক্ষয়  হলে  বিবেকখ্যাতি পর্য্যন্ত  ঞ্জানদীপ্তি হয়ে  থাকে।


ভগবান  মনু  বলেছেন  অগ্নিতে  দগ্ধ  করলে  যেমন  সুবর্ণাদি ধাতুর 
মল  নষ্ট  হওয়ায়  তা  শুদ্ধ ও উজ্জ্বলতর  হয়, তেমনি প্রাণায়াম করলে  মন  প্রভৃতি  ইন্দ্রিয়কৃত  দোষ  নষ্ট  হয়।

বেদ এবং পাণিনি  মতে প্রকৃত প্রাণায়াম  হল 'বিচ্ছর্দনাভ্যাম্‌' এ এক রকমের  বমন  ক্রিয়া ---  উদ্ধৃত্ত  কফ-বায়ুপিণ্ডের  বমন, তমোগুণের বমন, বিষয়লিপ্সার  বমন,  কামনার  বমন  এবং যুগপৎ ব্রাহ্মীস্থিতি। এই  গুপ্ত  পদ্ধতি  গুরুমুখগম্য।

পরিণাম:--- ১৯৪৭  সালে  পূজার  ছুটিতে  এলাহাবাদ  গিয়েছিলাম। ত্রিবেণী  তটস্থ  বাঁধের  পূর্বদিকে  হাড়োয়া  বাবা  নামে এক হঠযোগী বাস  করতেন। বাঁধের  পশ্চিম  দিকে  থাকতেন  সুদত পুরী  নামে আর  এক  সাধু, তিনিও  হঠযোগী। সকাল  ও  সন্ধ্যায় দলে  দলে লোকে  আসতেন  তাঁদের  আশ্রমে।

সুদত  পুরীকে  সবাই  বলতেন 'আসন  সিদ্ধ', হাড়োয়া  বাবাকে বলতেন --- 'প্রাণায়াম সিদ্ধ'। সুদত  পুরীর  শিষ্যরা  প্রচার  করতেন যে  আকাশগমনাদি  ব্যাপার  তাঁদের  গুরুর  কাছে  নিতান্ত ছেলেখেলা  বিশেষ। যদি  কাউকে  জিঞ্জেস  করতাম, 'আপনি  কি নিজের  চোখে  এ  সব  দেখেছেন?' উত্তর  পেতাম --- ' অমুকের কাছে শুনেছি, উনোনে  বোলা...'। সেই  'অমুককে' খুঁজে  জিঞ্জেস করলে তিনি  জবাব  দিতেন --- 'তমুকের  কাছে  শুনেছি, তমুক  খুদ্‌ আঁখসে দেখা  হ্যায়।' এই  অমুক  তমুকরা  ধর্মজগতে  সাধুবাবাদের আদি  ও অকৃত্রিম  প্রচারক। তাঁদের  কথা  সকলের কানে  ভেসে আসে, তাঁদের কেউ  দেখা  পায়  না, আমিও পাই  নি।

দুই  সাধু  বাবারই খ্যাতি  তখন  তুঙ্গে। যোগাভ্যাসীদের 'জয় বজরংবলী'  ধ্বনিতে  উভয়ের  আশ্রম  মুখর থাকত। যে কোন ভাবে হোক, আমার  উপর  হাড়োয়া  বাবার বিশেষ কৃপাদৃষ্টি পড়েছিল। তিনি  তাঁর  আশ্রমের  একটি  কুটিরেই আমাকে থাকতে দিয়েছিলেন। যখনই  এলাহাবাদ  যেতাম, তাঁর কুটীরেই থাকতাম।

দেখতাম  যোগাভ্যাসীরা  সুদত  পুরীজীর  আশ্রমে  ব্রজাসন,ময়ূরাসন, কাকাসন, পরশুরামাসন, মৎস্যেন্দ্রাসন, শাম্ভবী, যোনিমুদ্রা, জালবন্ধমুদ্রা, মহামুদ্রা  প্রভৃতি  অভ্যাস  করতেন। তাঁরাই  আবার হাড়োয়া  বাবার  আশ্রমে  এসে  অভ্যাস  করতেন উজ্জায়ী, ভস্ত্রায়ী, কেবলী  প্রভৃতি  প্রাণায়ামবিধি। অনেকে  আবার খেচরী  সিদ্ধ হওয়ার বাসনায়  জিহ্বার  ছেদন  দোহনাদি  ক্রিয়া একনিষ্ঠভাবে অভ্যাস করতেন।

হাড়োয়া  বাবার  এক  শিষ্য, বিষ্ণুদেবানন্দ  পুরী  বাঁধের  নীচে  এক বিরাট  গর্ত  করে  তার  মধ্যে  থেকে 'গুহাসাধনা  করতেন। জমজমাট  ব্যাপার, চারদিকে  শুধু  'যোগীপুরুষের' ভীড়!  সুদত পুরী একদিন  গুহ্যদ্বার  দিয়ে  নাড়ীভুঁড়ি  বের  করে দেখিয়েছিলেন। একদিন  হুঙ্কার  দিয়ে  শাল প্রাংশু  মহাভুজ  হাড়োয়া  বাবা যোগাসনে বসলেন ---  সঙ্গে  সঙ্গে  শিবনেত্র। দৃষ্টি  স্থির। আধঘণ্টা পরে  ডাক্তার স্টেথোস্কোপ  দিয়ে  পরীক্ষা  করে  বললেন, বুকের মধ্যে  কোন স্পন্দন  নেই, নাড়ীর  গতিও  রুদ্ধ। তাঁর  বুকে  হাত দিয়ে দেখেছিলাম  হৃদপিণ্ডে  সত্যই  কোন  স্পন্দন  ছিল  না। দু'ঘণ্টা  পরে হাড়োয়া  বাবা  চোখে  মেলে  তাকালেন।

যোগের  নামে  নানাবিধ  কসরৎ ও ভোজবাজীতে  সিদ্ধপীর  এই যোগীবরের  প্রাত্যহিক  জীবনচর্চা  আমার  চোখে  মহাপুরুষোচিত বলে  মনে  হয়  নি। "ঐ  সকল  আসন  ও  প্রাণায়ামে  কি চিত্তবৃত্তির নাশ  হয়? আসন ও প্রাণায়ামে  এত  নৈপুণ্য  সত্ত্বেও  জীবনধারাতে ইন্দ্রিয়  জয়ের  চিহ্ন  কেন  পরিলক্ষিত  হয়  না? যে সব  যোগ প্রণালীতে  প্রঞ্জা  স্ফুরণের  কোন  লক্ষণ  দেখা  যায়  না, তা  কি যোগ পদবাচ্য?"------ এবম্বিধ  প্রশ্নজালে  জর্জরিত  হয়ে  হাড়োয়া বাবা আমার  উপর  বিষম  ক্রুদ্ধ  হন।

কয়েক  বৎসর  পরে  কুম্ভমেলাতে  গিয়ে  শুনলাম, 'গুহাসাধনার ফলে বিষ্ণুদেবানন্দ  বদ্ধ  উন্মাদ  হয়ে  যায়, সংবাদ  পেয়ে  তার আত্মীয় স্বজন  এসে  তাকে  রাঁচির  পাগলা  গারদে  রেখে  এসেছেন।গুহ্যদ্বারের  পথে  নাড়ীভুঁড়ি  নিষ্কাশনের  কসরৎ  দেখাতে  গিয়ে আন্ত্রিক রক্তক্ষরণের ফলে  সুদত পুরীজী  কালগ্রাসে পতিত হয়েছেন। 
হাড়োয়া  বাবার  আশ্রমে  গিয়ে  দেখলাম  তাঁর  অন্তিম  দশা আগত প্রায়। হায়? তাঁর  সেই  বিশাল  'যোগসিদ্ধ' দেহের এ কী অবস্থা! উৎকট  হাঁপানী  রোগে  তাঁর  দেহ  কঙ্কালসার। হাঁফের  টানে  এক একবার  মনে  হতে  লাগল  তাঁর  চোখ  দুটো  যেন  ঠিকরে  বেরিয়ে আসবে! দমকে  দমকে  কাশি, কাশির  টান  কমলেই  ক্ষীণকণ্ঠে বলে চলেছেন  'হাঃ  প্রাণায়াম!  প্রাণ  গয়া  রাম!' কোথায়  গেল  সেই 'জয় বজরংবলী'  হুঙ্কার আর  অট্টনাদ। একী  শোচনীয়  দশা! ইঙ্গিতে  কাছে ডেকে  আমাকে বললেন --- 'সচ  কহু, ইস  প্রাণায়াম বেগারমেঁ  ঞ্জান কা  প্রাপ্তি  নাহি  হোতি। হাঃ  প্রাণায়াম। প্রাণ  গয়া রাম। হাড়োয়া বাবা  সাধুপুরুষ  সন্দেহ নাই।

কলিকাতায়  ফিরে  আসার  কিছুদিন  পরেই  হাড়োয়া  বাবার মৃত্যুসংবাদ  পাই।



https://www.facebook.com/pages/tapobhuminarmada/454528151310191