".......... ঠিক, ঠিক এইসময় মাণ্ডবগড় কেল্লার পাশ থেকে আমরা সবাই কারও কণ্ঠস্বর শুনে উৎকর্ণ হয়ে উঠলাম। কেউ যেন গান গাইতে গাইতে আসছেন। তাঁর গলার স্বর গানের সুরে ভেসে আসছে---
ঘন ডম্বরু বাজে ভীম রুদ্র সাজে
জাগে ভৈরব জাগে মৃত্যু করাল।
তাথৈ! তাথৈ! তা তা থৈ, তা তা থৈ!
জাগে ভৈরব জাগে মৃত্যু করাল।
মরণ-আঁধার কোলে, জীবন আলোকে জ্বলে
শংকর শিব সাজে সাজিয়ে দয়াল।
মাভৈঃ! মাভৈঃ! মাভৈঃ! মাভৈ!
কণ্ঠস্বর যতই এগিয়ে আসছে, ততই আমার মহাত্মা সোমানন্দেরই কণ্ঠস্বর বলেই মনে হচ্ছে ! কিন্তু তা কি করে সম্ভব। তিনি ত এখন চব্বিশ অবতারে কিংবা সেই সীতামায়ীর বনে বসে আছেন। এখানে বসে তাঁর গলা শুনব কি করে? যাঁর কণ্ঠস্বর শুনলাম তাঁকে এখনও চোখে দেখতে পাচ্ছি না। আবার কণ্ঠস্বর ভেসে এল, এবারে আরও স্পষ্ট ---
গরজ়ে গম্ভীর গগনে কম্ভু! নাচিছে সুন্দর নাচে স্বয়ম্ভূ।
সে নাচ হিল্লোলে জটা আবর্তনে সাগর ছুটে আসে গগন-প্রাঙ্গনে!
আকাশে শূলহানি, শোনাও কৃপাবাণী, তরাসে কাঁপে প্রাণী, প্রসীদ শম্ভু।।
পাহাড় বেয়ে দুটো ঝাঁকড়া আবলুষ গাছের পাশ দিয়ে আমাদের সামনে উঠে আসতেই মোহান্তজী এবং লক্ষ্মণভারতীজী আনন্দে ফিস্ ফিস্ করে বলে উঠলেন ---- সীতা বনকী মহাপুরুষ ইধর ক্যায় সে পধারেঁ ? আমি ত তাঁকে দেখে আনন্দে আত্মহারা! 'বন্দে মহাপুরুষ্য চরণারবিন্দম্, ,বন্দে মহাপুরুস্য চরণারবিন্দম্, নমো নারায়ণায়' বলে সবাই কৃতাঞ্জলিপুটে তাঁকে আমরা প্রণাম করলাম দূর থেকে। তাঁর আমাদের দিকে নজর পড়ল বলে মনে হল না। তাঁর পূর্বের মতই শতচ্ছিন্ন পোষাক, ঝাঁপড় ঝাঁপড় চুল এবং ছোট ছোট জটা দুলাতে দুলাতে তিনি টলতে টলতে গান গাইতে গাইতে এগিয়ে আসছেন-----
ললাট-শশী টলি জটায় পড়ে ঢলি,
সে শশী-চমকে গো বিজুলি ওঠে ঝলি,
ঝাঁপে নীলাঞ্চলে মুখ দিগঙ্গনা,
মূরছে ভয়ভীতা নিশি নিরঞ্জনা
আঁধারে পথ-হারা ভকত কেঁদে সারা,
যাচিছে কৃপাধারা প্রসীদ শম্ভু!
নাচতে নাচতে পাথরের উপর পায়ের তাল ঠুকতে বলতে থাকলেন---
তাথৈ, তাথৈ, তা-তা-থৈ, তা-তা-থৈ,
মাভৈঃ! মাভৈঃ! প্রসীদ শম্ভু ! প্রসীদ শম্ভু !
আমার আর তর সইলো না। তাঁর সেই অবস্থাতেই আমি নিভন্ত দুটো ধুনির মাঝখান দিয়ে কোনমতে পেরিয়ে তাঁর কাছাকাছি গিয়ে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে ত্র্যস্ত ব্যস্ত হয়ে বলতে লাগলাম, সামনের দিকে তাকিয়ে দেখুন চোদ্দটা কালো চিতা আমাদেরকে আক্রামণ করার জন্য বসে আছে, আমাদেরকে বাচাঁন!' আমার কথায় চমকে উঠেই সেইখানেই একটা পাথরের উপর বসে পড়লেন। সঙ্গে সঙ্গে অট্টহাসি। সে কি হাসি! হাসির দমকে দমকে তিনি দুলতে দুলতেই বলতে থাকলেন ---
'চোখ মেললে সকলই পাই, চোখ মুদলে কিছুই নাই। দিনে সৃষ্টি, রেতে লয়, নিরন্তর ত এই-ই হয়।'
'যম বেটা হায় দুমুখো থলি, তাই বেটার আঁৎ খালি। বেটা কেবল খাচ্ছে, খাচ্ছে, খাচ্ছে, ওর পেটে কি কিছু থাকছে! হাঁ, হাঁ কিছু থাকছে!'
'বলি ও বামুন ছানা! তুই এখানে এলি কি করে? রাঁধুনী নাই ত রাঁধালে কে, রান্না নেই ত সবাই খাচ্ছেন কি? আরে বুঝিস না কেন, যে রাঁধলে সেই ত খেলে এই ত দুনিয়ার ভেল্কি।'
এইভাবে কথা বলতে বলতেই তিনি মোহান্তজীর দিকে তাকিয়ে আমাকে বলতে লাগলেন --- 'ওহো তুই ঐ রাত ভিখারীটার দলে ভিড়ে এখানে পৌঁছে গেছিস! ভাল, ভাল
* রাত ভিখারির ধামাধরা থাকে একজন
হরিনাম বলে না মুখে, চাল কড়ি কুড়াতে তার মন!
এই বলেই তিনি আবার হেসে লুটোপুটি! 'ওহে রাত ভিখারি বাবু!
রাত ভোর ত গুরুর কাছে মাথা ঠুকলি আর ভিখ চাইলি, সকাল হতেই "হর নর্মদে"! আরে গুরুশক্তি আবার পারে না কি? আরে বেটা! যেই হর, সেই গুরু, সেই নর্মদা। সঙ্কটকালে তোর মন তিনদিকে ছুটবে কেন? গুরুকে ধরে সকলেই জয়, নয়ত সব লয়! ঐ যে কথায় আছে না?
দেবতা থাকুক শত শত গুরু করব সার,
গুরুর মধ্যেই কৃপার প্রকাশ দেবী আর দেবার।
'তাই বলি মাঝি! গুরুর শরণ লও, কেন তুফান পানে চাও, হাল ধরে আছেন গুরু নিরঞ্জন! ফড়্যা যারা, মজবে তারা, বাটখারা যাদের কম, ধরে তসিল করবে যম আর গদিয়ান জহুরী যারা, দেখ গে তারা বসে বসে ব্যাপার করছে গুরুর প্রেম রতন।'
'আমি বাপু স্বরূপের বাজারে থাকি। শোনরে খেপা, বেড়াস একা, চিন্তে নারলে ধরবি কি? কালার সঙ্গে বোবার কথা হয়, কালা গিয়ে শরণ মাগে কে পাবে নির্ণয়! আর অন্ধ যেয়ে রূপ নেহারে তার মর্মকথা বলব কি! মড়ার সঙ্গে মড়া ভেসে যায়,জীয়ান্ত ধরতে গেলে হাবুডুবু খায়। ওরে, সে মড়া নয়কো রসের গোড়া, তার রূপেতে দিয়ে আঁখি, আমি এখন রূপ দেখি!'
এই বলে পাগলা সাধু চুপ করে বসে চোখ বন্ধ করে দুলতে থাকলেন। তাঁর দুলুনি আর থামতে চায় না। আমরা পড়লাম মহা ফাঁপরে। রাতভর আমরা ভয়ে ভয়ে কাটিয়েছি, আগুনের তাপে জর্জরিত হয়েছি। এখন দেখতে পাচ্ছি কালো চিতা গুলো মুখ ব্যাদন করে সবাই খাড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। মনে হচ্ছে এবারে আক্রমণের উদ্যোগ করছে, এবারে নির্ঘাৎ ঝাঁপিয়ে পড়বে। অমিত শক্তিধর এই মহাপুরুষকে দেখে আমাদের বুকে আশা ভরসা জেগেছিল কিন্তু ইনি ত প্রথম থেকেই ভাবের রাজ্যে বিচরণ করছেন। এখন ত একেবারে মস্ত।
সবচেয়ে বিপদের কথা, এর ভাবের খেলা এতক্ষণ তন্ময় হয়ে আমরা দেখছিলাম, মশাল গুলোর দিকে লক্ষ্য করি নি সেগুলো সব নিভতে বসেছে। আমি মরিয়া হয়ে তাঁর কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে চেচিয়ে বললাম মা রেবার দোহাই, সীতামায়ীর দোহাই আপনি আমাদের দিকে একটু নজর দিন, কালো চিতার দল আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল বলে। আমার চিৎকারে তিনি চমকে উঠেই কালো চিতাগুলোর দিকে ক্রুব্ধ দৃষ্টিতে তাকালেন।
তাকিয়ে তাকিয়ে বলতে লাগলেন --- ওকারের বুড়ো যে অগস্ত্যি গুহায় তোকে যে বেদ মন্ত্রটা শিখালো সেটা একবার আউড়িয়ে দেখ না। এখনই বেটাদের নড়ন চড়ন থাকবে না।
---- আমি তা আওড়াবার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু কিছুতেই বেদ মন্ত্র স্মরণে আনতে পারি নি।
---- তা হলে ত তোর বেটা রাবণের দশা! রাবণ বেটাও মরণকালে সব অস্ত্র ভুলে গেছিল। অতবড় মহাবীর কর্ণ সে বেটারও মৃত্যুকালে রথচক্র মেদিনী গ্রাস করল। পরশুরামের দেওয়া ব্রহ্মাস্ত্রও ভুলে গেল। বুঝলি রে, এসবই সেই নিয়তি হারামজাদীর খেল!
আমার আর ধৈর্য রইল না, যে কাজ কখনও করিনি, তাঁর এতসব আদিখ্যেতায় অধীর হয়ে সেই কাজই করে বসলাম। তাঁর দুই কাঁধ স্পর্শ করে ঝাঁকিয়ে দিতে দিতে বললাম ,'তবে এই নিয়তির মুখে আপনাকেই ছুঁড়ে ফেলে দেব।'
এত বড় উচ্চকোটি মহাপুরুষের সঙ্গে আমাকে এইরকম বেয়াদপি করতে দেখে সকলেই হকচকিয়ে গেছেন। মোহান্তজী চুপি চুপি কণ্ঠে আমাকে ধমকে উঠলেন --- 'ক্যা পাগলপন কর রহে হো।'
কিন্তু সেদিকে কান দেওয়ার সময় নেই। মহাপুরুষ সবেগে উঠে দাঁড়িয়ে দুই হাতের বদ্ধমুষ্ঠি আস্ফালন করতে করতে কালো চিতাদের দিকে এগোতে এগোতে বললেন ---"কী তোদের কে আমি বলে দিয়েছি না,বামুনের মাংস তিতা হয়। সাধুদের মাংস বিষ !বিষ! চাবল মারবি কি সঙ্গে সঙ্গে অক্কা! দেখছিস না, তোদেরই এক বড় কুটুম ইমলি গাছের তলায় কেমন চিৎপটাং হয়ে পড়ে আছে। পালা পালা নয়ত সকলেই চিৎপটাং হবি!"
জানোয়ারগুলো কি বুঝল জানি না, আমরা অবাক হয়ে দেখলাম, মহাপুরুষ যতই এগোচ্ছেন, তারা ততই পিছিয়ে যাচ্ছে। তারপর তারা দুড়দাড় শব্দে বন বাদাড় ভেদ করে দৌড়ে পালাল। মহাপুরুষ কিন্তু থামলেন না, তিনি এগিয়ে চললেন। আমরা সকলেই তাঁর পিছন পিছন হাঁটতে লাগলাম।"