ব্রহ্ম-বৈবর্ত পুরাণে আছে, সৃষ্টিকালে প্রধানা শক্তি ঈশ্বরের ইচ্ছায় পাঁচভাগে বিভক্ত হন --- রাধা, পদ্মা, সাবিত্রী, দুর্গা ও সরস্বতী। সরস্বতী কৃষ্ণ কণ্ঠ হতে উদ্ভুতা। শ্রীকৃষ্ণ এই দেবীকে প্রথমে পূজা করেন। তখন থেকেই এই দেবীর পূজা প্রচলিত হয়। দেবী শ্রীকৃষ্ণ হতে উদ্ভুতা হয়ে শ্রীকৃষ্ণকেই কামনা করেন। তখন শ্রীকৃষ্ণ সরস্বতীকে নারায়ণ ভজনা করতে বলেন। লক্ষ্মী এবং সরস্বতী দুজনেই নারায়ণের স্ত্রী। ভাগবত মতে সরস্বতী ব্রহ্মার স্ত্রী।
পুরাণকারদের মতে, পরমাত্মার মুখ হতে এই দেবীর আবির্ভাব হয়। এই দেবী শুক্লবর্ণা, বীণাধারিণী এবং চন্দ্রে শোভাযুক্তা, ইনি শ্রুতি ও শাস্ত্রের মধ্যে শ্রেষ্ঠা, কবি এবং বিদ্বানদের ইষ্টদেবতা, এইজন্য এঁর নাম সরস্বতী।
সরস্বতী জ্যোতিঃ (প্রঞ্জাজ্যোতিঃ) এবং রসের অধিষ্ঠাত্রী দেবী।
সরস্বতী স, রসবতী। "রসো বৈ সঃ" অর্থাৎ রসস্বরূপ পরব্রহ্মের তিনি পরম প্রকাশ।
ঋগ্বেদেরই ১৪২ সূক্তে ঋষি দীর্ঘতমা দৃষ্ট ৯ নম্বর মন্ত্রে দেবী সরস্বতীকে ইলা এবং ভারতী নামে অভিহিত করা হয়েছে।
"শুচির্দেবেষ্বপিতা হোত্রা মরুৎসু ভারতী।
ইলা সরস্বতী মহী বর্হিঃ সীদন্তু যঞ্জিয়াঃ।"
এই মন্ত্রে ইলা, সরস্বতী, ভারতীকে অগ্নির ত্রিমূর্তি হিসাবে বন্দনা করা হয়েছে। ভারতী স্বর্গস্থ বাক্দেবতা, ইলা পৃথিবীস্থ বাক্দেবতা এবং সরস্বতী অন্তরীক্ষস্থ বাক্দেবতা।
সরঃ শব্দের অর্থ হল জল; সরস্বতীর প্রথম অর্থ নদী। আর্যাবর্তে সরস্বতী নামে যে নদী ছিল (এখন লুপ্তপ্রায়) তাই প্রথমে সরস্বতী দেবী বলে পূজিত হয়েছিলেন।এই নদীতটেই বৈদিক ঋষিদের আবাসস্থল ছিল। সারা বৎসর ধরে এই নদী তীরে নানাবিধ যঞ্জ সম্পাদন করা হত এবং বেদধ্বনি হত বলে কালক্রমে সরস্বতী নদী পবিত্রমন্ত্রে দেবী বাক্দেবীরূপে রূপান্তরিত হলেন। বেদমন্ত্রে সরস্বতীর এই ভাবে মহিমা প্রকাশ পেয়েছে।
বাক্দেবীরূপে এঁর মহিমা ঋষিরা এইভাবে প্রকাশ করেছেন --- মানুষের হৃদয়কে পবিত্র ও নির্মল করেন, যিনি যঞ্জশালিনী এবং অন্নদাত্রী সেই সরস্বতী আমাদের যঞ্জ কামনা করেন। ইনি সুন্দর ও সত্যবাক্যের প্রেরণকর্ত্রী, ইনি মহাসমুদ্রের ন্যায় অসীম পরমাত্মাকে চিহ্নের দ্বারা প্রকাশ করেন। ইনি সমুদয় নরনারীর হৃদয়ে জ্যোতিঃ সঞ্চারিত করেন।
শৈবাগমতন্ত্রে যাঁকে সিদ্ধবিদ্যা ষোড়শী বিদ্যা বলা হয় সেই ষোড়শী বিদ্যার দেবীকেই সরস্বতী বলা হয়। শৈবাগম সাধকদের নিকট সাধারণভাবে ইনি বাণী, বীণাপানি, বাক্দেবী, শুভ্রা, হংসবাহনা প্রভৃতি নামে পরিচিত।
পৌরাণিক সরস্বতী এবং বৈদিক সরস্বতীর সঙ্গে এঁর সাদৃশ্য থাকলেও ধ্যান ও মন্ত্ররহস্য সম্পূর্ণ পৃথক। এই দেবী নানা স্থানে নানাভাবে পূজিত হয়ে থাকেন। দেবীর বহুরূপ, বহুবাহন ও বহুলীলা।
দেবী কখনও দ্বিভূজা, কখনো চতুর্ভুজা আবার প্রয়োজনবোধে কখনো বা ষোড়শভূজা। প্রত্যেক রূপেই মন্ত্র যন্ত্র পৃথক পৃথক। ষোড়শী বিদ্যাদেবীর ষোলটি নাম, ষোল রকমের রূপ। সকলেরই মাথার উপর মন্দিরের মত উঁচু মুকুট। সকলেই ললিত মুদ্রাসনে আসীনা, একটি পা নীচু করে রেখেছেন, একটি পা আসনের দিকে গুটানো। সকলেরই দক্ষিণ হস্ত বক্ষোপরি বরমুদ্রায় স্থাপিত, বামহস্ত মোড়া এবং উঁচুতে তোলা। প্রত্যেকটি অঙ্গভঙ্গীই গভীর ভাবের দ্যোতক, বিভিন্ন যোগরহস্যের সঙ্কেত-সূচক।
সরস্বতীর ষোড়শ নামের:---
1. রোহিনী --- দেবীর বাহন জলচৌকি। দেবী চতুর্ভুজা। দক্ষিণ ও বাম উভয় হস্তেই চক্র। দেবীর অপর নাম ---"অজিতবালা"।
2. প্রঞ্জপ্তী --- দেবীর বাহন হংস। দেবী ষষ্ঠভুজা। তাঁর হাতে অসি, কুঠার, চন্দ্রহাস ও দর্পণ। দেবীর অপর নাম --- "দুরিতারী"।
3. বজ্রশৃঙ্খলা --- দেবীর বাহন হংস। দেবী চতুর্ভুজা। হাতে পারিখ ও বৈষ্ণবাস্ত্র।
4. কুলিশাঙ্কুশা --- দেবীর বাহন অশ্ব। দেবী চতুর্ভুজা। তাঁর ডান হাতে অসি এবং বাম হাতে ভূষণ্ডী। দেবীর অন্যান্য নাম যথাক্রমে "মনোবেগা", "মনোগুপ্তি", "শ্যামা"।
5. চক্রেশ্বরী --- দেবীর বাহন গরুড়। দেবী ষোড়শভূজা। উপরের দক্ষিণ ও বাম হস্তে শতঘ্নী এবং ১০ হাত মুষ্টিবদ্ধ। দুই হাত কোলে স্থিরভাবে পতিত এবং বাকী দুই হাতে বরদানের মুদ্রা।
6. পুরুষদত্তা ভারতী --- দেবীর বাহন হস্তী। দেবীর দক্ষিণ হস্তে চক্র এবং বাম হস্তে শতঘ্নী। এঁর মুখমণ্ডল চতুস্কোণ বিশিষ্ট, পুরুষাকৃতি। দেহের গঠন সুদৃঢ় ও বলিষ্ঠ, কোমর সিংহের মত সরু।
7. কালী --- এই কালী দশমহাবিদ্যার কালী নন। বাহন বৃষ। দেবী চতুর্ভূজা। দক্ষিণ হস্তে ত্রিশূল ও বাম হস্তে শতঘ্নী। দেবীর অপর নাম "শান্তি"।
8. মহাকালী --- ইনিও তন্ত্রোক্ত দশমহাবিদ্যার মহাকালী নন। দেবীর কোন বাহন নেই। দেবী চতুর্ভুজা। ডান হাতে ষষ্ঠি এবং বাম হাতে শতঘ্নী। দেবীর অপর নাম "অজিতা" এবং "সুরতারকা"।
9. গৌরী --- দেবীর বাহন বৃষ। দেবী চতুর্ভূজা। এঁর দক্ষিণ হস্তে মঙ্গলঘট এবং বাম হস্তে ষষ্ঠি। দেবীর মস্তকের মন্দিরাকৃতি মুকুটের বাম পার্শ্বে "চন্দ্র"। দেবীর অপর নাম "মানসী"ও "অশোকা"।
10. গান্ধারী --- দেবী চতুর্ভূজা, কোন বাহন নেই। এঁর ডান হাতে পরিখ অর্থাৎ লৌহকণ্টকযুক্ত মুদগর আর বাম হাতে সীর(লাঙ্গলাস্ত্র); এর দুই স্থান বাঁকা। মুখ ও মূলাংশ লৌহবদ্ধ, সাধ্য ত্রিহস্ত পরিমিত দীর্ঘ। এই মন্ত্রের কাজ আকর্ষণ ও নিপাতন। এই দেবীর অপর নাম "চণ্ডা"।
11. সর্বাস্ত্রমহাজ্বালা --- দেবী অষ্টভূজা। এঁর বাহন বৃষ। দক্ষিণহস্তে অসি, ত্রিশূল, ভল্ল (বর্শা বিশেষ)। কার্য--- নিক্ষেপে ছেদন, নিপাতন ও শায়িত করণ। বৈষ্ণবাস্ত্র এবং বাম হস্তে ব্রহ্মশির অস্ত্র, তীর ও পাশ। মস্তকে মন্দিরাকৃতি বিরাট মুকুট। মুকুটের চতুর্দিকে অরণ্য। দেবীর অপর নাম "জ্বালামালিনী","ভৃকুটি"।
12. মানবী --- দেবী চতুর্ভূজা।এঁর বাহন সাপ। দেবীর দু'হস্তে দর্পণ, এক হাতে ষষ্ঠি, অপর হাত বরমুদ্রায় স্থাপিত। দেবীর অপর নাম "অশোকা"।
13. বৈরাট্যা --- দেবী চতুর্ভূজা।এঁর বাহন সাপ।এঁর দু'হস্তে বৈষ্ণবাস্ত্র ও ভল্ল। দেবীর অপর নাম "বৈরোটি"।
14. অচ্ছুপ্তা --- দেবী চতুর্ভূজা। এঁর বাহন হংস। দক্ষিণ হস্তে ভল্ল এবং বাম হস্তে বিজয়ধনু। দেবীর অপর নাম "অনন্তবতী","অঙ্কশা"।
15. মানসী --- দেবী চতুর্ভূজা। এঁর বাহন সিংহ। দক্ষিণ হস্তে ভল্ল ও কুঠার এবং বাম হস্তে দর্পণ ও বিজয়ধনু। দেবীর অপর নাম "কন্দর্পা"।
16. মহামানবী --- দেবী চতুর্ভূজা। এঁর বাহন ময়ূর। দক্ষিণ হস্তে ভল্ল ও বাম হস্তে চক্র। দেবীর অপর নাম "নির্বাসী"।
ষোড়শী বিদ্যা সরস্বতীর এই ষোল রকমের দিব্যমূর্তি নিয়ে ভক্তের কাছে প্রকাট হন। তাই তাঁর ষোড়শী রূপই আমাদের ধ্যানের ধন। তাঁর প্রত্যেকটি রূপেরই মন্ত্র যন্ত্র পৃথক পৃথক থাকলেও সব মিলিয়ে তাঁর যে দিব্যস্বরূপ, সরস্বতী বলতে আমরা তাঁকেই বুঝি।
https://www.facebook.com/pages/tapobhuminarmada/454528151310191
No comments:
Post a Comment