Monday, November 11, 2013


........... বিকেল  তখন  সাড়ে  তিনটে  চারটে  বাজে। হঠাৎ  নজর গেল  মন্দিরের  বাঁদিকে  প্রায়  দেড়  মানুষ  সমান  উঁচু  পাঁশুটে  রঙা ঘাসের  মধ্যে  সোনালী  চমক। আমি সেদিকে  সকলের  দৃষ্টি  আকর্ষণ করে  সকলকে  নিয়ে  মন্দিরের  দরজা  ধাক্কা  দিয়ে  খুলে  ভিতরে ঢুকে  দরজা  বন্ধ  করে  দিলাম।  শিবমন্দিরের  বাঁদিকের  জানলা খুলে  দেখি  ঘাসের  জঙ্গল  ভেদ  করে  দেখা  যাচ্ছে  না  কিছুই। বুক ঢিপঢিপ  করছে।


হরানন্দজী  ফিস্‌ফিস্‌  করে  বললেন --- চিতা! দেখুন একটা  নয় একসঙ্গে  চারটে। মা  এবং  প্রায়  সাবালক  তিনটি  শাবক। ঘাসের মধ্যে  গা  ডুবিয়ে  সর্তক  ভঙ্গীতে  এগোচ্ছে  শিকারের  সন্ধানে। শাবকগুলি  একইভাবে  মাকে  অনুসরণ  করছে। এবার  একটা  বড় পাথরের  উপর  এসে  উঠে  দাঁড়াল  মা চিতা। বাচ্চাগুলিও  মায়ের গা  ঘেঁসে  পাথরের  উপর  উঠে  দাঁড়াল। সোনালী  চামড়ার  উপর কালো  বুটি। তার  সবল  পেশীতে  ফুটে  উঠছে  যেন  নৃত্যের সুষমা। চিতাগুলির  দাঁড়াবার  ভঙ্গী  দেখে  মনে  হল  চিতার  লক্ষ্য  চিতল হরিণ। কিন্তু  না!  মা  চিতা  হঠাৎ  দিক  পরিবর্তন  করে  গা ডাকা দিয়ে  গুঁড়ি  মেরে  এগোতে  আরম্ভ  করল  বাইসনগুলির দিকে।

হরিণের  গতি  ও  চিতার  গতি  ঘণ্টায়  ৫০ মাইল  হলেও  হরিণ একটানা  দৌড়াতে  পারে  কিন্তু  চিতার  অতক্ষণ  দৌড়াবার  ক্ষমতা নেই।  পাছে  শিকার  ফস্কে  যায়  তাই  সুচতুর  চিতা  লক্ষ্য  পরিবর্তন করে  ঘাসের  মধ্যে  গা  ঢাকা  দিয়ে  গুঁড়ি  মেরে  এগোতে  আরম্ভ করেছে। চিতা এগিয়ে  চলেছে  সন্তর্পণে।  হঠাৎ  চিতাটি  লাফিয়ে গিয়ে  পড়ল  বাইসনদের  মধ্যে।


যে  বাইসনটি  লক্ষ্য  করে  চিতা  ছুটছে, সেই  পালাচ্ছে  প্রাণভয়ে। মনে  হচ্ছে  চিতাটি  বাতাসে ভর  করে  উড়ে  যাচ্ছে। মাটি  স্পর্শ করছে  না  তার  পা। হঠাৎ  বাইসনটি  তার  শিং  বাগয়ে  ঘুরে দাঁড়াল। কিন্তু  চিতাটি  তার  বেগ  সামলাতে  না  পেরে  কিছুটা  এ গিয়ে  গেল।


তারপর  চিতাটি  ফিরে  আসতেই  আমরা  দেখলাম  এক  লোমহর্ষক বাইসন  ও  চিতার  লড়াই।দুজনেই  রক্তাক্ত  হয়ে  উঠেছে। হঠাৎ বাইসনটি  তার  সরু  সূচালো  শিঙটা  ঢুকিয়ে  দিল  চিতার  পেটে। কিন্তু  তাতেও  সে  থামবে  না। বীভৎস! বীভৎস! এদৃশ্য! আস্তে  আস্তে থেমে এল  অসম  লড়াই। তারপর  দেখলাম  দুজনেই  দুদিকে  ছিটকে পড়ল।


বাইসনটা  কয়েকবার  উঠবার  চেষ্টা  করল। কয়েকবার  ঘড়ঘড়ে আওয়াজে  ডেকে  উঠল। কিন্তু চিতার  দেহ  নিথর, নিষ্পন্দ। তারপর সব  চুপচাপ। এবার  যে  পাথরের  উপর  বাচ্চা  চিতাগুলি  দাঁড়িয়ে ছিল  সেদিকে  তাকিয়ে দেখি  তারাও  উধাও।


আমাদের  হাঁফ  ছাড়ল। আমরা  সবাই  ঘেমে  নেয়ে  গেছি। শরীর, হাত, পা  সবই  অবশ। ঘটনার  বীভৎসতা  ও  প্রচণ্ডতা  আমাদের বিহ্বল  করে  তুলেছে।  পিপাসায়  গলা  শুকিয়ে  গেছে। জল খাওয়ার জন্য  কমণ্ডলুর  দিকে  যেতে  গিয়ে  পা  দুটো  থরথর করে  কেঁপে উঠল। কিছুক্ষণ  পরে  কতকটা  সামলে  নিয়ে  কমণ্ডলুর  সমস্ত জলটা  ঢকঢক  করে  গিলে  ফেললাম। যেন  ধড়ে  প্রাণ  ফিরে  এল। আমার  সঙ্গীদের  কোন  সাড়া  পাচ্ছি  না। সকলের  অবস্থা  তথৈবচ। সবাইকে  কমণ্ডলুর  জল  পান  করালাম। কিছুক্ষণ  পরে  হরানন্দজী কাঁপাকাঁপা  গলায়  রব তুললেন--- হর  নর্মদে, হর  নর্মদে, হর  নর্মদে।


আজ  আর  জপে  মন  নেই। কোনক্রমে  নিজেদের  গাঁঠরী  খুলে বিছানা  পেতে  শুয়ে  পড়লাম। রাত্রি বাড়ছে। গভীর  রাত্রে  অরণ্যের ভাষা  মুখর  হয়ে  ওঠে। মাঝে  মাঝেই  নানা  শব্দ  কানে  ভেসে আসতে  থাকল। রাত্রিচর  কোন  পাখীর  ডাক  শুনতে  পেলাম। মিষ্টি সুর। আশ্চর্য, সারাদিন  দেহমনে  এত  পরিশ্রম  হয়েছে  কিন্তু  ঘুম আসছে  না  কেন? চোখ  খোলা  রেখেই  আমি  ধ্যানে  ডুববার  চেষ্টা করছি। মনে  হচ্ছে  নিরবিচ্ছিন্ন  একটা  সুরেলা  ধ্বনি  বা  তান গমকে  গমকে  যেন  ঊর্ধ্বের  দিকে  উঠে  যাচ্ছে। একটা  অস্বাভাবিক আনন্দ  আমাকে  পেয়ে  বসল।


সকালে  জেগে  উঠলাম। মন্দিরের  বারান্দায়  বসে  বসে  দেখলাম ভুবন  প্রকাশক  উদিত  হচ্ছেন, সাতপুরার  শীর্যদেশে; তাঁর রশ্মিছটায়  আলোয়  আলোয়  সব  কিছুকে  ফুটিয়ে  তুলছেন, প্রকাশ করছেন। দূরে  চিতা ও বাইসনের  দেহকে  ঘিরে  ধরেছে শকুনির দল।


প্রায় ৮ টা নাগাদ  যাত্রা  শুরু  করলাম।  প্রায়  আরো  দুমাইল  হাঁটার পর  উৎরাই-এর  মুখে  এসে  পৌঁছলাম। সাবধানে  পা  ফেলে  ফেলে নামতে  লাগলাম  ঢালুতে। একটু  অসাবধান  হলে  গড়িয়ে  পড়তে হবে খাদের  মুখে। বনের  প্রকৃতি  ক্রমশ  বদলে  যাচ্ছে। চারদিকে শুধু পাথর পাথর  আর  পাথর  কিন্তু  বড়  বড়  বনস্পতির  আর  দেখা মিলছে  না।


প্রায়  আধঘণ্টা  উৎরাই-এর  পথে  হাঁটার  পরে  আমরা  মোটামুটি সমতল  প্রান্তরে  নেমে  এলাম। সামনেই  মা  নর্মদাকে  দেখা  যাচ্ছে।যতক্ষণ  দুর্গম  বনপথে  হাঁটছিলাম  তখন  ডানদিকেই  তাঁর জলধারা  দেখতে  পাচ্ছিলাম। এখন  সামনে  বাঁদিকে  তাকিয়ে দেখছি  নর্মদা  বন  পাহাড়  ভেদ  করে  বক্রযান  গতিতে  সামনে এসে উপস্থিত  হয়েছেন।এ  অঞ্চলে  দেখছি, পাহাড়  ফাটিয়ে  তার  খাঁজে খাঁজে  বহু  চাষযোগ্য  জমি  বের  করা  হয়েছে, তাতে চাষবাস হচ্ছে। কোন  কোন  জমিতে  গম  জোয়ার  ভুট্টার  গাছ  দেখা  যাচ্ছে। ধীরে ধীরে  আমরা  নর্মদার  কিনারে  এসে  পৌঁছলাম।


নর্মদার  পবিত্রধারাকে  স্পর্শ  ও প্রণাম  করে  আমরা  পূর্বদিকে  বাঁক নিতেই  দূরে  একটা মন্দিরের  চূড়া  দেখতে  পেলাম। শিবমন্দিরটি পাথরের  তৈরী, পোতার  উপর  একটা  বড়  হলঘর। হলটা  দেখলেই বুঝা  যায়  বেশ  পুরাতন। দরজা  জানলাও  নেই।  থাকলেও তা খসে পড়ে  জীর্ণ  হয়ে  নষ্ট  হয়ে  গেছে।


আমরা  আমাদের  ঝোলা  গাঁঠরী  একস্থানে  রেখে  সবাই  মিলে  ঘাটে স্নান  তর্পণাদি  করতে  বসলাম। আজ  আমরা  তিন দিন  অভুক্ত। নর্মদার  জল  ছাড়া  কিছুই  জোটে  নি।  তা  বলে  আমাদের  ক্ষিদেও নেই, শরীরে  ক্লান্তিও  নেই। বসে  বসে  ভাবতে  লাগলাম, বিচার করতে  লাগলাম --- এই  পরিক্রমা পথে  পরিক্রমা বাসীদের তপ  জপ ও  বিভিন্ন  সাধুসঙ্গ ও নূতন  নূতন  ঞ্জান লাভ  ছাড়াও  যে  বিরুদ্ধ পরিবেশের  মধ্যে  পড়ে  স্বতঃই  যে  শম দম  ত্যাগ  তিতিক্ষা  হিংস্র শ্বাপদসঙ্কুল  দুর্গম  অরণ্যের  মধ্যে  ঘুরতে  ঘুরতে  প্রতিপদে  যে  ঈশ্বর নির্ভরতা  বাড়ছে, সঙ্কটকালে  যখন  দিশেহারা  হয়ে  পড়েছি, নিজেকে  একান্ত  অসহায়  ভাবছি, তখন  যেভাবে  আচম্বিতে অভাবনীয়ভাবে  রক্ষা  পাচ্ছি, হঠাৎ  হঠাৎ  যেভাবে  দরদী  সঙ্গী ও সাথীরা  জুটে  যাচ্ছেন  তাতে  স্পষ্টতই  মনে  হচ্ছে  কেউ  যেন আড়ালে  থেকে  রক্ষা  করছেন। কেবলেই  মনে  হচ্ছে  নর্মদা  মাতা রক্ষা  করছেন, নর্মদেশ্বর  শিব  রক্ষা  করছেন।  এই  শরণাগতির ভাবটাই  এই পরিক্রমার  সর্বশ্রেষ্ঠ  প্রাপ্তি।




https://www.facebook.com/pages/tapobhuminarmada/454528151310191

No comments:

Post a Comment