কামরূপে মঠে স্বামী কেবলানন্দ নামে এক সন্ন্যাসী থাকতেন।কন্দর্পকান্তি দেহ, শালপ্রাংশু মহাভুজ, বয়স ৩০/৩২ এর বেশী হবে না।সবসময় ধ্যানানন্দে বিভোর থাকতেন।রাত্রি ৩টে স্বামীজীর সঙ্গে গঙ্গাস্নানে,বেলা ১২টা,১টার সময় মাধুকরী করতে যাওয়া ছাড়া তিনি গুম্ফার বাইরে বেরুতেন না।ব্রহ্মচারী মহেশ চৈতন্য নামে মঠের একজন ব্রহ্মচারী একবার স্বামীজীর কাছে এসে অভিযোগ করলো -'স্বামীজী,কেবলানন্দজী মাধুকরী করতে বেরিয়ে নারদ ঘাটের এক শেঠানীর বাড়ীতে গিয়ে রোজ মাধুকরী করে।খোঁজ নিয়েছি ঐ বাড়ীতে ৪৫/৪৬ উমরকা এক বিধবা শেঠানী থাকে আর কেউ থাকে না। হমারা ডর হ্যায়, 'ইসমে মঠকা কৌঈ বদনামী না হো'।
মহেশ চৈতন্যের এই অভিযোগ শুনে স্বামীজী সঙ্গে সঙ্গে কেবলানন্দজীকে উপরে ডেকে পাঠালেন। মহেশ চৈতন্যের অভিযোগ সত্য কিনা জিঞ্জেস করলেন।
কেবলানন্দজী অবিচল কণ্ঠে বললেন - সিকায়ৎ সচ হ্যায়।উনোনে হামারা বড়া বহিন হ্যায়।স্বামীজী ছোটবেলা আমি মা বাপকে হারিয়েছি।ঐ বহিনজীই আমাকে মানুষ করেছিলেন। আমি সংসার ত্যাগের পর বহিনজীও কাশীতে এসে বাস করছেন, জপ পূজার মধ্যেই সময় কাটান। আমি যে কাশীতে থাকি তা তিনি জানতেন না। আজও জানেন না আমি এই মঠে আপনার চরণাশ্রয়ে থাকি।
একদিন মাধুকরী করতে গিয়ে হঠাৎ বিশ্বনাথের গলিতে দেখা হয়ে যায়। তিনি বিশ্বনাথের পূজা করে ফিরেছিলেন। ভীষণ কান্নাকাটি করেন। রাস্তার মধ্যেই তিনি মূর্চ্ছা যান। সংঞ্জা ফিরে পেয়ে বলেন -তোকে কোথাও না কোথাও তো মাধুকরী করতেই হয়। তুই আমার কাছে মাধুকরী করবি বলে গঙ্গাজল, বিশ্বনাথের নির্মাল্য নিয়ে শপথ করান।
স্বামীজী আমি অপরাধী, মায়া মমতার ডোর আমার মধ্যে সুপ্ত ছিল।আমার গোস্তাকী হয়েছে, আপনাকে সব নিবেদন করা উচিত ছিল।মহেশ চৈতন্যকে সঙ্গে দিয়ে স্বামীজী আর এক ব্রহ্মচারীকে সব বৃত্তান্তের খোঁজ নিতে পাঠালেন। সেই ব্রহ্মচারী সব খোঁজ নিয়ে এসে স্বামীজীকে বললেন, কেবলানন্দজীর কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্য।
স্বামীজী কেবলানন্দজীকে বললেন - ভগবন্! কলিতে সন্ন্যাস ধর্মকে বড় কঠিনতম ব্রত বলে। বিরজা হোমের সময় বাইরের জগৎ আর তার হাতছানি রূপ, রস, গন্ধ, শব্দ, স্পর্শকেও যেমন ন্যাস করতে হয় তেমনি অন্তর জগতের যোগজ শক্তি বিভূতি ইত্যাদিকেও ন্যাস করতে হয়। পূর্বাশ্রমকে ভুলতে হয়, এমনভাবে ভুলতে হয় যে, যেন নিথর রহস্য ঢাকা পড়ে যায়। নিজেকে মৃতঞ্জানে সন্ন্যাসী নিজেরই শ্রাদ্ধ করেন গৈরিক বস্ত্র গ্রহণের পূর্বে। এটা অনুমান করলে চলবে না, সত্যি সেইরকম জীবন্ত বোধটি হওয়া চাই।
এই মঠের আচার্যরা এইভাবে কঠোরতম তপস্যা ও কৃচ্ছসাধনের দ্বারা পবিত্রতম সন্ন্যাস ধর্মের জ্যোতিকে জ্বালিয়ে রেখে গেছেন। আমার মত অপদার্থ এর আগে কেউ এই মহান মঠে বসেনি। কিন্তু আমার বল বুদ্ধি ভরসা তো তোমরা। তোমাদের মুখ চেয়েই সেই ব্রহ্মবিদ্বরিষ্ঠ আচার্যদের ব্রত পালনের ভার নিয়েছি। তোমারা যদি সাহায্য না কর, সহয়তা না কর তাহলে সন্ন্যাস ধর্ম কি করে থাকবে ভগবান? তুমি বলে দাও বাছা, তোমার ঐ কাজ সন্ন্যাস ধর্মের অনুকূল কিনা? আমি তো মুখ্যু সুখ্যু মানুষ বাবা।
কেবলানন্দজী দণ্ড,কমণ্ডলু এবং তাঁর গৈরিক উত্তরীয়খানি স্বামীজীর পদতলে রেখে বললেন -- এই শরীরের পাতিত্য দোষ ঘটেছে প্রভু!পূর্বাশ্রমের সঙ্গে কোন সংস্পর্শ রাখা কোন সন্ন্যাসীর উচিত নয়। আমি সন্ন্যাস ধর্মের অমর্যাদা করেছি। তাই ভাবছি--এখন উত্তরায়ণ চলছে,আগামীকাল সকাল ৮টায় এই অশুদ্ধ দেহটা ফেলে দেব।উপস্থিত সকলেই হতচকিত। কিন্তু ভোলানন্দজী নির্বিকার।
ভোলানন্দজী ধীর স্থির ভাবে তখনই কামরূপ মঠের স্বীকৃত ৫ জন সাগ্নিক ব্রাহ্মণকে পরদিন প্রাত:কালে উপস্থিত হওয়ার অনুরোধ জানিয়ে এক সাধুকে পাঠালেন আর এরপরই বজ্রগম্ভীর কণ্ঠে ব্রহ্মচারী মহেশকে মঠ ছেড়ে যাবার নির্দেশ দিলেন।
ভোর ৪টে কামরূপ মঠে উপস্থিত হলেন একে একে পাঁচজন সাগ্নিক ব্রাহ্মণ -- গোপীনাথ কবিরাজ,মঙ্গলদেব শাস্ত্রী,পণ্ডিত তারাকিশোর, ব্রহ্মদত্ত জিঞ্জাসু এবং ছোট বামাচরণ।
কেবলানন্দজী নিজে হোমকুণ্ড সাজাচ্ছেন। পাঁচজন ব্রাহ্মণের জন্য পাঁচটি আসন পাতা আছে। কেবলানন্দজী তাঁদের "নম নারায়ণায়" জানিয়ে আসন গ্রহণের অনুরোধ জানালেন। যথাসময়ে যথালগ্নে শুরু হল বিরজা হোম। পাঁচজনে একত্রে উচ্চারণ করতে লাগলেন অগ্নি প্রজ্জ্বলনের মন্ত্র --- কেবলানন্দজী ধ্যানস্থ - নিথর নিস্পন্দ দেহ।
"হরি ওঁ তৎসৎ, হরি ওঁ তৎসৎ" উচ্চারণ করতে করতে ভোলানন্দজী নেমে এলেন। কেবলানন্দজীর মাথায় দণ্ড স্পর্শ করে মন্ত্র উচ্চারণ করতে লাগলেন।
বদ্ধ পদ্মাসনে ঋজু আয়তদেহে উন্নত মেরুদণ্ডে উপবিষ্ট সিদ্ধতাপস কেবলানন্দজীর ব্রহ্মরন্ধ্র দিয়ে একটি উজ্জ্বল শিখা উর্ধাকাশে গিয়ে মিলিয়ে গেল। হোমকুণ্ডের সামনে পড়ে রইল "পাতিত্য দোষে দুষ্ট" কেবলানন্দজীর অশুদ্ধ দেহ!
www.ananda-tapobhuminarmada.blogspot.com
No comments:
Post a Comment