Friday, May 25, 2012

উত্তরা সুষুম্নাই উত্তরাপথ; উত্তরায়ণের পথ; সাক্ষাৎ ব্রহ্মমার্গ:-

Cont...... (4)


ঋষিদের মত আজকাল বৈঞ্জানিকরাও স্বীকার করছেন যে সৃষ্টির মূলে স্পন্দন--Vibration, Sound বা শব্দ। স্পন্দনের মাত্রা (Wave-length) এবং ঘনত্বের (Pitch) তারতম্যানুসারে জগতের বিভিন্ন পদার্থের সৃষ্টি। সৃষ্টির মূল কারণীভূত স্পন্দনের মাত্রা ও ঘনত্বের অন্তর্নিহিত জীবনী বা তেজশক্তিই এক একজন দেবতা।


বেদঞ্জানবিরহিত তথাকথিত সাধু যোগী তান্ত্রিক ও পুরাণের বর্ণনানুসারে দেবতারা বর্তমানে ভক্তদের কাছে মানবাকৃতি হয়ে পড়লেও উপরের গূঢ় রহস্য মনে রেখে ঋগ্বেদে দেবতার অন্য নাম দেওয়া হয়েছে---স্পন্দ্রা। স্পন্দ্রা মানে স্পন্দনের অন্তর্নিহিত অগ্নি তেজ বা প্রাণশক্তির "র" অর্থাৎ প্রকাশ বা বিস্তৃতি।


জীবনীশক্তির (Energy) ক্রিয়ায় সর্বদাই দুটি রূপ অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত থাকে--- পুরুষ (Static) ও প্রকৃতি (Dynamic), সুতরাং দেবতারা বেদের ভাষায়---'সযোষা', যোষিৎ বা স্ত্রী সহ; সেই জন্যই শক্তি সহ শিব, মাতাসহ পিতা, অঙ্গাঙ্গীভাবে অর্ধনারীশ্বর। মাতাপিতাকে অর্ধনারীশ্বর, একত্রে শিব শিবানী বলে বর্ণনা করা হয়েছে। মাতাপিতার প্রত্যক্ষ সেবা পরিচর্যা দ্বারা দেহমল, মনমল, চিত্তমল শোধন হয়, সেই সঙ্গে তাঁদেরকে জীবন্ত ঈশ্বর-ঈশ্বরী ঞ্জানে প্রকৃত আঞ্জাচক্রে ধ্যান জপ করলে চিতিশক্তির জাগরণ অবশ্যম্ভাবী।


বিশ্ব সৃষ্টির আদি কারণ ঐ বিদ্যুৎরূপা শক্তির লহর বা ঢলের উত্তরণ ও অবরোহন কিভাবে প্রতি বস্তুতে ছন্দায়িত হয়ে উঠছে, তার কতকটা সাদৃশ্য সমুদ্রের ঊর্মিমুখর ঢেউ দেখলে অনুমান করা যায়। সমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করলেই দেখতে পাবেন অজস্র ঢেউ অনবরত উঠানামা করছে, তটভূমিতে এসে আছড়ে পড়ছে।ঐ বিদ্যুৎরূপা মহাশক্তির সৃষ্টিবিক্রিয়ারও বিরাম নাই।


সমুদ্রের তরঙ্গ প্রথমতঃ হাতের কনুই ভাঙার মত ঊর্ধ্বে উত্থিত হয়ে নিম্নে পতিত হয় অর্থাৎ তার গতি ভঙ্গিমাটি ভুজের মত গমন করে অর্থাৎ ভুজগ; তর্‌তর্‌ করে গড়িয়ে স ংস্কৃত ভাষায় সুপ্‌ করে অগ্রসর হয়, তাই এর এক নাম সর্প (সুপ ধাতু হ'তে নিষ্পন্ন, বিদ্যুৎরূপা ঐ মহাতেজের লহর  সুপ্‌ধর্মী)।


সমুদ্রের ঢেউ গর্জে উঠে অগ্রসর হওয়ার সময় কুণ্ডলী পাকায়, ঐ দিব্যশক্তির খেলাও তদ্রূপ, সেইজন্য তার নাম দেওয়া হয়েছে কুণ্ডলিনী বা হ্বার। সমুদ্রের  জলে যেমন কুণ্ডলী পাকিয়ে স্প্রিং এর মত সহসা তড়াক্‌ করে লাফিয়ে উঠে সেইরকম ঐ আদ্যাশক্তির চিদ্‌ধারাও কুণ্ডলী পাকিয়ে স্প্রিং এর ঊর্ধ্বে নর্তনশীলা হয়ে স্থুল সুক্ষ্ম কারণ জগতের সমূহ বস্তু সৃষ্টিও নিয়মন করে চলেছে। সেইজন্য এর অপর নাম----পৃদাকু।


দূর প্রান্তের পরিধি পর্যন্ত সমুদ্রের ঢেউ এগিয়ে যায় সত্য কিন্তু জল যেখানে ছিল সেইখানেই থাকে, জল এ গিয়ে যায় না।আদ্যাশক্তির ধারাও সৃষ্টির স্তরে স্তরে উছল হয়ে উঠলেও তা কোন মতেই সৃষ্টির যে ঋতম্‌, বা ছন্দ তা লঙ্ঘন করে না, অতিক্রম করে না, এগিয়ে যায় না--ন+আগ=নাগ।


বাস্তব জগতে সর্প নামক জীবের  চলন-গমনে এই সমস্ত ধর্ম দেখা যায়, তাই ঐ মহাচৈতন্যের ধারাকে ভুজগা, নাগ, কুণ্ডলিনী প্রভৃতি আখ্যা দেওয়া হয়েছে; অননুভবী ও মূর্খদের কল্পিত ধারানুযায়ী সত্য সত্যই মানুষের Spinal Cord এর মধ্যে লিঙ্গমূলে ঐ রকম কোন সর্পাকৃতি বস্তু সুপ্তাবস্থায় পড়ে নাই।


যাঁরা বৈদিক মহাযোগে সিদ্ধকাম কিংবা যাঁরা বেদাধ্যায়ী তাঁরাই সবাই জানেন, আদ্যাশক্তি বা ত্রিজগৎব্যাপ্ত ঐ মহাচিতিশক্তির  খেলা অন্তদৃষ্টিতে লক্ষ্য করেই ঋগ্বেদের ঋষি সূর্য রশ্মির অন্তর্নিহিত তড়িৎশক্তিকে 'সসর্পরী বাক্‌' বলে বন্দনা করেছেন। অর্থববেদেও অগ্নি, ওষধি, জল ও বিদ্যুৎজাত সৃপধর্মী তেজ বা তড়িৎকণার মহিমা প্রকাশ করতে গিয়ে বলা হয়েছে,


সসর্পরী  বহুধা  মহান্তি
মর্ত্ত্য  অমর্ত্ত্যেন  স  যোনিঃ।।

----ঐ সৃপধর্মী দিব্যতড়িৎ কণাই মর্ত্ত্য ও অমর্ত্ত্যলোকের মূল সৃজনীধারা, তার দ্বারাই সৃষ্টি ঐশ্বর্য বহুধা বিকশিত হয়।

ঋষিরা তাঁদের দিব্য অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে যে সব রহস্যময় পারিভাষিক শব্দ ব্যবহার করেছেন তার নিগূঢ় অর্থবোধও হওয়া চাই।আঞ্জাচক্র হতে সহস্রারের মধ্যেই এই মহাপিতৃযাগ বা পিতৃসাধনার সুরু এবং শেষ।


মহাত্মা গোরক্ষনাথ প্রণীত অমনস্কযোগ, গোরক্ষসিদ্ধপদ্ধতি, শিবযোগ, যোগি-যাঞ্জবল্ক্যম্‌ ধ্যান বিন্দু ও নাদবিন্দু উপনিষদ্‌ এবং আরও বহুতর বেদ মন্ত্রে যে সব তত্ত্বের ইঙ্গিত আছে তা স্বাধ্যায় করলে জানা যায়, মেরুদণ্ডের মজ্জার সঙ্গে যে স্থানে মস্তিষ্কের মজ্জার স ংযোগ আছে সেই স্থানের নামই প্রকৃত আঞ্জাচক্র (ছবিতে চিহ্নিত)।


মস্তিষ্ক মধ্যস্থ ব্রহ্মরন্ধ্র হ'তে নিঃসৃত প্রাণাত্মার চিদাত্মক ঞ্জানশক্তি এই কেন্দ্র হতে নিয়মিত (Controlled & regulated) হয়ে স্থূল শরীরে আসে বলেই ঐ কেন্দ্রের নাম আঞ্জাচক্র। সুষুম্না এই স্থান হতে দুভাগ হয়ে ব্রহ্মরন্ধ্রে গিয়েছে।


আঞ্জাচক্র হতে সম্মুখস্থ ললাট প্রদেশের অভ্যন্তর পথে অর্ধবৃত্তকারে বেঁকে ব্রহ্মরন্ধ্রের কাছে তার একটি মুখ, অপর মুখটিও অর্ধবৃত্তাকারে বেঁকে ব্রহ্মরন্ধ্রের অপর পাশে গিয়ে ঠেকেছে বটে তবে সেটি গিয়েছে আঞ্জাচক্রের পেছন দিক দিয়ে।এই উভয় পথই শূণ্য-নালী অর্থাৎ আকাশময়।


ব্রহ্মতালুদেশে সুষুম্নার ঐ দুইমুখের মধ্যস্থলে ব্রহ্মরন্ধ্র। ব্রহ্মরন্ধ্রের অর্থ, যে রন্ধ্র বা ছিদ্র দিয়ে ব্রহ্মমার্গে জীবাত্মার উৎক্রমণ ঘটে, কিংবা যে রন্ধ্র দিয়ে পরমাত্মা শরীরস্থ সীমায়িত স্থানে এসে জীবাত্মারূপে প্রকট হন।


ঐতরেয় উপনিষদে এই তত্ত্ব বিশদীকৃত করতে গিয়ে বলা হয়েছে, সৃষ্টিকর্তা মাতৃগর্ভস্থ  শিশুর তালু ভঞ্জ্‌ বা বিদীর্ণ করে তন্মধ্যে প্রবিষ্ট হ'য়ে জীব রূপে প্রতিভাত হন। ব্রহ্মরন্ধ্রের সূক্ষ্মস্থানে এই বিদারণ ক্রিয়া হয়, তাই তার নাম বিদৃতিদ্বার। ভঞ্জ করে আসেন বলে তাঁর নাম---ভগ। ঋগ্বেদে তাই প্রাচীন আদি দেবতার নাম ভগ, এখন বলা হয় ভগবান।


To  be  Continued.........

No comments:

Post a Comment