Tuesday, May 15, 2012

উত্তরা সুষুম্নাই উত্তরাপথ; উত্তরায়ণের পথ; সাক্ষাৎ ব্রহ্মমার্গ:-



বেদের নির্দেশ পিতাকে ঈশ্বরঞ্জান।পিতৃমেধ, পিতৃযঞ্জ, মহাপিতৃযঞ্জ, পিণ্ডপিতৃযঞ্জ, পিতৃঅর্চনা প্রভৃতি বৈদিকযঞ্জ পিতৃপূজারই নামান্তর।বৃহদারণ্যক উপনিষদে মনুষ্যলোক, ধ্যান ধারণা ও তপস্যাদি দ্বারা পিতৃলোক এবং বিদ্যাদ্বারা দেব-লোককে জয় করা যায়---


সোহয়ং মনুষ্যলোকঃ পুত্রেণৈব জয্যো নান্যেন কর্মণা, কর্মণা পিতৃলোকঃ, বিদ্যয়া দেবলোকঃ।


এখানে জয়ের অর্থ তৎ তৎ লোকের কর্তব্যকর্ম সাধনার দ্বারা পরিপূর্ণ ও সার্থক করে তোলা।উক্ত শ্রুতিমন্ত্রের ভাষ্য করতে গিয়ে ঞ্জান-ভাস্কর শংকরাচার্য বলেছেন---


তেষাং সোহয়ং মনুষ্যলোকঃ পুত্রেণৈব সাধনেন জয্যঃ জেতব্যঃ সাধ্যঃ।


এই ঋষিবাক্যের উদ্দেশ্যে ও আশয় হল ঘটনাক্রমে যদি পিতার কোন কর্তব্য কর্ম যথা দান, তপস্যা, অধ্যয়ন, সমাজঋণ, দেবঋণ, ঋষিঋণ প্রভৃতি বাকী থাকে, তাহলে তা পূরণ করে পিতাকে ঋণ মুক্ত করা পুত্রের অবশ্য পালনীয় কর্তব্য। সেই সঙ্গে নিজেও পিতৃচিন্তায় বিভোর হয়ে কৃতকৃত্য হতে পারলে তবেই সন্তান 'পুত্র' নামের যোগ্য।


তস্মাৎ---পূরণেন ত্রায়তে স পিতরম্‌ যস্মাৎ তস্মাৎ পুত্র নাম।


পুত্র কেবল সারা জীবন ধরে একতরফাভাবে মাতাপিতার প্রাণঢালা ভালবাসা আদরযত্ন এবং তাঁদের পরিত্যক্ত বিষয় সম্পত্তির উত্তরাধিকার ভোগ করবে, যথেচ্ছভাবে তাঁদের নিঃস্বার্থ ভালবাসার সুযোগ নেবে এমন কোন সার্বভৌম জন্মসত্ত্ব নিয়ে পুত্রকন্যা পৃথিবীতে আসে নি। মাতাপিতার প্রতিও পুত্রকন্যার তীব্র সাধন-সাপেক্ষ কিছু কর্তব্য আছে। পিতার যে সব ছিদ্র অর্থাৎ অপূর্ণতা থাকে তা পরিপূরণ করতে পারলে তবেই পুত্রের পুত্রত্ব----


ইদং তৎ পুত্রস্য পুত্রত্বম্‌, যৎ পিতুশ্ছিদ্রং পূরয়িত্বা ত্রায়তে।


সত্যদ্রষ্টা ঋষিরা বলেছেন মৃত্যুর পর পিতাতে হিরণ্যগর্ভের সমুদয় অমরপ্রাণ প্রবেশ করে অর্থাৎ তখন তাঁর মর্ত্ত্যভাব চলে যায়; তাঁর প্রাণরশ্মি মৃত্যুর পরে হিরণ্য-গর্ভলোকে বিরাজমান থাকে।তাই বৈদিক পিণ্ডপিতৃযঞ্জে পিতার উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভোজ্য বস্তুকে পৃথিবীরূপে এবং পিতাকে তার অধিষ্ঠাতৃদেবতা অগ্নিরূপে ধ্যান করার বিধান আছে।পিতার প্রতি পুত্রের কেবল ঐহিক কর্তব্য নয়, নিজের পূর্ণতার জন্যই পিতাকে কেন্দ্র করে কিভাবে সিদ্ধ সাধনায় ব্রতী হওয়া যায়, বেদ উপনিষদ ঘোষিত সেই পিতৃলোক কোথায়, কিভাবেই বা পিতাকে ধরেই জীব মুক্তি-সরণীতে পদক্ষেপ করতে পারে।


বর্তমানে হিন্দুসমাজে স্মৃতিশাস্ত্র ও পুরাণের (বায়ুপুরাণ, গরুড়-পুরাণ প্রভৃতি) বিধান অনুসারে মাতৃপিতৃশ্রাদ্ধ কালে পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে কুশের উপর পিণ্ডদানাদির যেমন ঘটা দেখা যায়, বৈদিক ধারণায় এই সব আচার অনুষ্ঠানের বিধি বিধান ছিল না।


পালি সাহিত্যে স ংস্কৃত শ্রাদ্ধ কথাটির অনুরূপ শব্দ পাই 'সদ্ধ'।


এই সদ্ধ শব্দটির অর্থ বৌদ্ধ ধারণায় মৃত আত্মীয়ের উদ্দেশ্যে ব্রাহ্মণ গণকে খাদ্য ও অন্যান্য বস্তুদান রূপ প্রেতকৃত্য।


বর্তমান হিন্দুসমাজে প্রচলিত শ্রাদ্ধ-ব্যবস্থায় তার ছায়া পড়েছে।মৃত মাতাপিতার উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা নিবেদনের একটি উপায় হিসাবে দেখলে এতে কোন আপত্তি করার কারণ দেখি না।


কিন্তু নিজের তথাকথিত Status বজায় রাখা এবং নিজ অহ ং-এর স্ফুর্ত্তি ও পূর্ত্তি সাধারণতঃ ঐ সব অনুষ্ঠানের প্রধান অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে আজকাল।


মাতা-পিতার জীবদ্দশায় যে নারকীপুত্র শ্রদ্ধা ও প্রেমবশতঃ তাঁদের সেবাপূজা করল না,তাঁদের দেহান্তের পরেই দেখি তারা শ্রাদ্ধের ঘটা করতে কুণ্ঠিত হয় না। একে প্রহসন ছাড়া আর কি বলা যায়?
বেদে সরাসরি শ্রাদ্ধ শব্দটি না থাকলেও বৈদিকযুগে এমন কি বৌদ্ধযুগের অব্যবহিত পূর্ব পর্যন্ত মাতাপিতার সেবাপূজাকেই পবিত্রতম যঞ্জ এবং পুত্রের অবশ্য প্রতিপাল্য কর্তব্য এবং সাধনার শ্রেষ্ঠ অঙ্গ হিসাবে বিবেচনা করা হত।


অনেক পণ্ডিতের মতে মহর্ষি পাণিনির আবির্ভাব বৌদ্ধ-পূর্ব-যুগে।
তিনি তাঁর বিখ্যাত অষ্টাধ্যায়ী সূত্রে শ্রাদ্ধ শব্দ ব্যবহার করেছেন। সূত্রটি হল-----


'শ্রাদ্ধম্‌ অনেন ভুক্তম্‌ ইণি ঠনৌ'।

এর অর্থ 'অনেন ভূক্তম্‌' এই অর্থে শ্রাদ্ধ শব্দের উত্তরে ইণি ও ঠন্‌ প্রত্যয় হয়। অনেন ভূক্তম্‌ মানে পিতার দ্বারা ভূক্তম্‌ অর্থাৎ মাতাপিতার ভোজন ক্রিয়া; সযত্নে জীবিত মাতাপিতাকে ভোজন করাতে হবে, নিজ হাতে সেবা পরিচর্যা করতে হবে।

পাণিনিরও পূর্ববর্তী মহাকবি ভাসের প্রতিমা নাটকের পঞ্চম অঙ্কে শ্রাদ্ধ শব্দটির প্রয়োগ আছে--- শ্রদ্ধয়া দত্তম্‌ শ্রাদ্ধম্‌। প্রচেতা রচিত শ্রাদ্ধকল্প নামক গ্রন্থের নামও এই নাটকে দেখতে পাওয়া যায় অর্থাৎ মহর্ষি প্রচেতার যুগেও মাতাপিতাকে ভক্তি ভরে সেবা পূজা, তাঁদের সর্ববিধ ইচ্ছার পূরণ, সর্বতোভাবে তাঁদেরকে সুখী ও তৃপ্ত করাকেই শ্রাদ্ধ হিসাবে গণ্য করা হত।

"জ্যান্তে দিল না ভাত কাপড়, মরলে করবে দান-সাগর"----

এ ধরণের জঘন্য রীতিকে শ্রাদ্ধ হিসাবে বৈদিক যুগে গণ্য করা হত না।
জীবিত মাতাপিতার সেবাপূজার পরিবর্তে তাঁরা মারা গেলে যে তথাকথিত শ্রাদ্ধপর্ব তার কোন মূল্য নেই।

কোন ব্যক্তি জীবিত না থাকলে তাঁর সেবা পূজা সম্ভব হয় না। সেব্য ও সেবক মিলিত হলেও তবেই সেবকের পক্ষে সেবা করা সম্ভব হয়। স্বামী দয়ানন্দ তাঁর ঋগ্বেদের ভাষ্য ভূমিকাতে বলেছেন---

"সেব্যসেবকসন্নিকর্ষাৎ সর্বমেতৎ কর্ত্তুং শক্যতে ইতি"।।

সারকথা জীবিত মাতাপিতার প্রত্যক্ষ সেবাপূজা করাই মুখ্য সাধনা।
জীবিত মাতাপিতার সেবা পরিচর্যা ছাড়া তাঁদের জীব্দদশাই এবং তাঁরা গত হলেও এমন একটি সিদ্ধ উপাসনা পদ্ধতি আছে, এমন এক সিদ্ধ মাতৃপিতৃবীজমন্ত্র আছে, যা সাধনা করলে ইষ্ট সাক্ষাৎকার হয়ে থাকে।

মাতাপিতার জীবিত থাকাকালে তাঁদেরকে উপেক্ষা করে তাঁদের মৃত্যুর পর শ্রাদ্ধের ঘটা করা যেমন ভাবের ব্যাভিচার, তেমনি প্রত্যক্ষ সেবা পরিচর্যার পরিবর্তে অত্র প্রদর্শিত পন্থায় কেবল ধ্যানাসনে বসে ধ্যান জপ করলে তা বন্ধ্যা প্রহসনে পর্যবসিত হতে বাধ্য।

To  be  Continued........

No comments:

Post a Comment