Monday, September 1, 2014


".......................  বেলা তখন ৮টা বেজেছে। চমৎকার মিষ্টি রোদে হাঁটতে ভালই লাগছে। দূরে দূরে জনবসতিপূর্ণ শস্যশ্যামল গ্রাম দেখতে দেখতে মনের আনন্দে  হেঁটে চলেছি; আনন্দের কারণ আজ হরিধামে পৌঁছে যাব। আজ না নৌকা পেলেও কাল নিশ্চয়ই নৌকা পেয়ে যাব। মহাত্মা পূষণ গিরিজীর ছাড়পত্র অর্থাৎ নৌকার চিঠি ত কাছেই আছে, ভাবনা কি। প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা হাঁটার পর সামনে জঙ্গল দেখে থমকে দাঁড়ালাম। বুকটা ধ্‌ক করে উঠল। ভূতনাথের জঙ্গল।


ভূতনাথের জঙ্গল যেখানে জনশ্রুতি রুদ্রপিশাচের বাস। রুদ্রপিশাচ থাকুন না থাকুন, সকলের মুখে শুনে আসছি এটি ভয়ঙ্কর স্থান! গতবার মোহান্তজীর সঙ্গে নিজেই ত দেখে গেছি, ভূতনাথের মন্দিরে পৌঁছতে কত ঘুরপাক খেতে হয়েছে। সোজা জঙ্গল অতিক্রম করে যাওয়ার উপায় নেই। নিরাপদে সমুদ্র পেরোতে হলে প্রত্যেক পরিক্রমাবাসীকে ভূতনাথের মন্দিরে প্রণাম ঠুকে যেতেই হবে। তা না হলে সমুদ্রে নৌকাডুবি হয়ে যায়। আমি ঝোলা গাঁঠরী পথের উপর রেখে বাবা এবং মা নর্মদার উদ্দেশ্যে প্রণাম জানালাম। জঙ্গলে ত কোন জন্তু জানোয়ারের ভয় নেই, ভয় কেবল বনের গোলক ধাঁধাকে। যা হবার হবে। হর নর্মদে বলতে বলতে ঢুকে পড়লাম বনের ভিতরে।


আমার খুব ভাল করেই মনে আছে, সেবারে একটা অশ্বত্থ ও পরপর তিনটে শিমূল গাছ অতিক্রম করে একটা বড় বেলগাছ এবং আমলকী গাছের আড়ালে কালচে রং এর প্রাচীন মন্দিরটি চোখে পড়েছিল। আমি বনের মধ্যে বেল ও শিমূল গাছের চূড়া লক্ষ্য করে নানারকম লতাপাতা ঠেলে ঠেলে হাঁটতে লাগলাম। কোথাও কোন পথের চিহ্ন খুঁজে পাচ্ছি না। মিনিট পনেরো হাঁটার পর একটা শিমূল গাছের চূড়া দেখতে পেয়ে সেইদিকে দৃষ্টি রেখে হাঁটতে লাগলাম। কাছাকাছি এসে দেখি প্রায় ১০ ফুট ব্যাস যুক্ত গুঁড়িওয়ালা শিমূলগাছ। তার পিছনে অসংখ্য বনপাদপ, নটরাজের মত তাণ্ডব নৃত্যের ভঙ্গীতে শাখা বাহু ছড়িয়ে বনের শোভা বাড়িয়ে দিয়েছে। শোভা দেখার মন এখন নেই। নিরাশ হলাম! কারণ ভূতনাথের মন্দিরের কাছে এত বড় গাছ ছিল না। সেখানে আছে পরপর তিনটি শিমূল গাছ, বেলগাছ ও আমলকী গাছ। যা এখানে ধারে কাছে দেখছি না।


সে পথ ছেড়ে জঙ্গলের অন্য পথ ধরলাম। শিশিরসিক্ত নিস্তদ্ধ বনস্থলীতে কত রকমের বন্য বিহঙ্গের অদ্ভুত সব কূজন শুনতে পাচ্ছি। একটা পথের চিহ্ন দেখতে পেয়ে আশায় বুক দুলে উঠল। এই পথ নিশ্চয়ই ভূতনাথের মন্দিরে পৌঁচেছে। সেই পথের নিশানা ধরে হাঁটতে লাগলাম। হায় ভগবান, এ যে পৌঁছে গেলাম এমন এক জায়গায় যেখানে অনেকখানি অনাবৃত পাথর বেরিয়ে আছে। পাথরের পাশ দিয়ে হেঁটে মিনিট দশেক পরে পৌঁছলাম বনের এমন একপ্রান্তে যেখানে বন ঢালু হয়ে নিচের দিকে নেমে গেছে, সেখানে এখনও কুয়াশা জড়িয়ে আছে গাছপালায়। মনে হচ্ছে ঢালুতে নিচে কেউ বুঝি আগুন দিয়েছে, তার ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠে আসছে জঙ্গলের ভিতরে। এইভাবে এদিকে ওদিকে ঘুরপাক খেতে খেতে অবশেষে হতাশ হয়ে একটা ফাঁকা জায়গা দেখে বসে পড়লাম গাঁঠরীর উপর।


বড় বড় গাছপালার ফাঁক দিয়ে তির্যকভাবে রোদ এসে পড়েছে গায়ে। আমি হতাশ মনে মা নর্মদার ষড়ক্ষরী মূলবীজ জপ করতে লাগলাম। মিনিট পাঁচেক পরে বনের ভিতরে কোথাও থেকে কানে একটা গান ভেসে এল। কান পাততেই ধীরে ধীরে বুঝতেও পারলাম সেই গানের ভাষা ---



মেরে আখন কে দৌতারে,
পিতা-পুত্রী অভিরাম মনোহর
কৈলাস-কণ্টক মেঁ বাঢ়ে

আমি লাফ দিয়ে উঠে পড়লাম। এ যে ভারোচের সেই 'কঙ্কালসার ভক্ষণাসুর' সাধুর কণ্ঠস্বর! আনন্দে মন নেচে উঠল। গানের সুর লক্ষ্য করে গাছপালা মাড়িয়ে হাঁটতে লাগলাম।

শুক শারদ নারদ বলিহারী
মহিমা বর্ণত হারে।
মেরে আখন কে দৌতারে।

গানের ভাষা ও সুর ক্রমশঃ স্পষ্টতর ও নিকটতর হচ্ছে ---

মেরে আখন কে দৌতারে,
রেবা শিবম্‌, শিবম্‌ রেবা
ইয়ে দৌ, রূপ উজারে।

একটা লতার  ঝোপ অতিক্রম করতেই পরপর তিনটি শিমূল গাছ, বেল ও আমলকী গাছের আড়ালে ভূতনাথের মন্দির চোখে পড়ল। দরজার চৌকাঠে বসে আছেন গায়ক। কিন্তু ইনি ত ভারভূতি বা ভারোচের সেই 'ভক্ষণাসুর' সাধু নন। ইনি যে আমার পরম প্রিয় যোগিরাজাধিরাজ প্রলয়দাসজী! আমার হাত থেকে গাঁঠরী, ঝোলা, লাঠি ইত্যাদি খসে পড়ল। মাথা ঘুরে গেল, আমি ধপ্‌ করে মাটিতে বসে পড়লাম। মিনিটখানিক তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমার বিস্ময়ের ঘোর কিছুতেই কাটছে না, ভাবছি ইনিই কি তিনি অর্থাৎ যাঁর একসঙ্গে প্রায় ৮০টা কলা এবং ৮টা নারকেল খাওয়া দেখে রতনভারতীজী যাঁকে 'ভক্ষণাসুর সাধু' বলে অভিহিত করেছিলেন। তাকাবার সময় উভয়েরই চোখ দুটির অদ্ভুত ধরণের মিজিমিজি ভঙ্গিমা ছাড়া আর কিছু দৈহিক সাদৃশ্য ত চোখে পড়ছে না! 

'আমার কাছে উঠে এসে ভূতনাথকে প্রণাম কর। ভৃগুকচ্ছ ত পরিক্রমা করে এলে তাতে আমি খুব খুশী হয়েছি, তবে কিছু অসন্তোষের কারণ ঘটেছে। মূল শ্রীপতি তীর্থে এবং ভূতেশ্বরের শাম্ভবী পীঠে বিশেষতঃ ফেরার সময় ভারভূতেশ্বরের মহাদেবকে মহর্ষি তণ্ডিকৃত মহাস্তবরাজ শুনিয়ে আসা উচিত ছিল। যাই হোক, এখন মধ্যাহ্ন আসন্ন। মধ্যাহ্নক্ষণ ধরে তোমাকে ভূতনাথের পূজা করতে হবে। মন্দিরের মধ্যে ফুল, বেলপাতা, চন্দন সবই আছে। তুমি পূজা করতে বসে যাও। আমি মহাদেবের জন্য কিছু ভোগ সংগ্রহ করে আনছি।' 


এই বলে তিনি লাঠি হাতে নিয়ে কোথাও যাবার উপক্রম করতেই আমি তাঁর পায়ে লুটিয়ে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলাম। 'শিবং ভূয়াৎ' বলে তিনি লাঠি ঠুকে ঠুকে মন্দিরের পিছন দিকে চলে গেলেন। আমি দু'তিন মিনিট হতভম্ব হয়ে বসে থাকলাম।




To be continued...................







No comments:

Post a Comment