Monday, January 20, 2014

"দেবভূমি বদ্রী" ------


............ ১৯৪৭ সালের গ্রীষ্মের ছুটিতে প্রথম বাবা আমায় (লেখকে) হিমালয়ের পাদদেশে হরিদ্বার-হৃষিকেশ-কেদারনাথ-বদ্রীনাথ দর্শনে পাঠিয়েছিলেন। বাবা বলতেন --- এতদ্‌ঞ্চল হল মর্ত্যভূমের স্বর্গ, দেবতার বাস। ফুলে ফুলে ভরা সবুজে ছাওয়া এ যেন স্বর্গের নন্দনকানন! সাধু-সন্তের লীলাভূমি হিমালয়ের হিম সৌন্দর্য, নিবিড় অরণ্যানী, ঝরণার সুমধুর তান তোকে মোহিত করে দেবে।


যথাসময়ে ডুন এক্সপ্রেসে চড়ে শিবালিক পাহাড়ের পাদদেশ হতে ৩০০মি উচুঁতে হরির দ্বার হরিদ্বারে পৌঁছালাম। দেবভূমি হিমালয়ের প্রবেশদ্বার পুরাণের মায়াপুরী হরিদ্বারে (অতীত নাম কপিলাস্থান) অজস্র মন্দির, আশ্রম, পুণ্যতোয়া গঙ্গা এবং জয় জয় গঙ্গা মাতা ধ্বনি ও ভজনের তালে তালে গঙ্গার স্রোতে প্রদীপের ভাসান আমি প্রাণ ভরে উপভোগ করে চতুর্থ দিনে ব্রহ্মকুণ্ডে স্নান করে সমবেত পাণ্ডাদের ঐকতান ও মন্ত্রের স্পষ্ট উচ্চারণে মধুস্রাবী গঙ্গা বন্দনা শুনতে শুনতে উত্তরাখণ্ডের শ্রেষ্ঠ তীর্থ হরিদ্বার ত্যাগ করে যাত্রা করলাম হৃষীকেশের পথে।


হৃষীকেশ হৃষীকেশের প্রিয়-নিকেতন। হরিদ্বার যদি হয় তীর্থস্থান তবে হৃষীকেশ হল তার সাধনস্থান। হরিদ্বার তীর্থ হলেও শহর।হৃষীকেশ হল তপোবন। দিন নেই, রাত্রি নেই অবিশ্রান্ত ভাবে পতিতপাবনীর কলনাদিনীর আহ্বান ধ্বনির মাঝে হিমালয় ধ্যানমগ্ন তাপসের ন্যায় অটল অচঞ্চল। একমাত্র এখানেই গঙ্গা ও হিমালয়ের পূর্ণ মূর্তি দেখতে পাওয়া যায়। আত্মোপলব্ধির শ্রেষ্ঠস্থান এই হিমালয়। হৃষীকেশে একদিন কাটিয়ে লছমনঝোলা হয়ে যাত্রা করলাম বদ্রী নারায়ণের পথে।


পথের বৈচিত্র্য ও সৌন্দর্য অতুলনীয়। বিশাল সুউচ্চ পর্বতের প্রাচীর ঘেরা, নির্জনতার রাজ্য, হিমালয়য়ের অন্ত:পুরে প্রবেশকারীর মন আপনা থেকেই কেন্দ্রীভূত হয়ে আসে এক নির্দিষ্ট চিন্তায়। চিত্তের ভাবনা ও বিক্ষেপ কমে আসে। সংসারের ক্ষুধিত- তৃষিত কোলাহল কঠিন পর্বতাবরণ ভেদ করে এই শান্তিধামে প্রবেশ করতে পারে না। নীচতার ধূলি, হিংসা দ্বেষের জ্বালাময় বায়ুপ্রবাহ এই পবিত্র তীর্থকে কলুষিত করতে পারে নি। বিলাস প্রিয়তা এবং পার্থিব লালসার এখানে সম্পূর্ণ অভাব। এখানে উপস্থিত হলেই বহু প্রাচীন নিষ্কলঙ্ক, মঙ্গল কিরণানুরঞ্জিত শান্ত জীবনের এক সুকোমল পবিত্র স্মৃতি হৃদয়ে পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। হিমালয়ের স্পর্শ মানুষের মনে প্রশ্ন ছড়িয়ে দেয়, উত্তরও দেয় জানিয়ে।


খুব ভোরে উঠে বাসে চড়ে রওনা হলাম ব্রহ্মার তপস্যাক্ষেত্র দেবপ্রয়াগের দিকে। মন্দাকিনী ও অলকানন্দার মিলিত সলিলে গোমুখ থেকে আসা ভাগীরথীর মিলন ঘটেছে দেবপ্রয়াগে। গঙ্গা নামের উৎপত্তিও ত্রিধারার মিলনে দেবপ্রয়াগ।


চড়াই পথের দৃশ্য একেবারে নতূন! যতই উপরে উঠছি, ততই দেখছি পুঞ্জীভূত তুষার রাশি যেন জমে জমে সমগ্র পাহাড়কে ঢেকে ফেলেছে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তুষার- সৌন্দর্য্যের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি পেতে লাগল। চতুর্দিকেই শ্বেতশুভ্র তুষার-কিরীট। মাঝে মাঝে কিছু কিছু দেবদারু, পাইন, চীর। 


প্রকৃতির রাজ্যে একি কেবল বিরাট তুষারের সৃষ্টি! এক রাত্রির বৃষ্টিতে কালো পাহাড় ক্রমশই যেন ছায়াবাজীর মত হঠাৎ একদিনে সাদা হয়ে গেছে। উপত্যকার আশপাশ নিম্নদিকে যতদূর চোখ যায়, পাহাড়ের সর্বত্র যেন শুভ্র বস্ত্রে একেবারে ঢাকা। একদিকে তুষারের এই উঁচু নীচু চমৎকার দৃশ্য, অন্যদিকে পুর্বভাগ থেকে উত্তরভাগ পর্যন্ত অভ্রভেদী তুষার শৃঙ্গের দিকে চোখ ফেরালে স্বর্গের সম্পদ-সুষমাই প্রত্যেককে মুগ্ধ করে দিচ্ছে। 


তুষার-সমুদ্র মন্থন করতে করতে বেলা দশটা নাগাদ পৌঁছলাম শ্রীনগরে। বিকালের দিকে পৌঁছলাম অলকানন্দ ও মন্দাকিনীর সঙ্গমস্থল রুদ্রপ্রয়াগে। অপার্থিব অনুভূতিতে মুগ্ধ হল মন! এখান থেকেই একদিকে গেছে বদ্রীনাথের পথ, অন্যদিকে কেদার ক্ষেত্র। 


বেলা যতই শেষ হয়ে আসছে ততই ভীষণ শীত অনুভূত হতে থাকল। সন্ধ্যার মুখেই ঘন মেঘের সঞ্চার করে বর্ষণ শুরু হল। এই অঞ্চলের মজা হল সূর্য যতই পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়ে ততই যেন প্রকৃতি-রাণীর মুখ গম্ভীর ও ভার হয়ে ওঠে।


বিরাটকায় পাহাড়গুলি একবারেই তুষারমণ্ডিত থাকায়, রৌদ্রকিরণে সর্বদাই যেন চোখের সামনে হীরকের মত ঝলমল করছে। এরূপ অপরূপ বিচিত্র দৃশ্যের মধ্য দিয়ে উৎরাই-এর পথে বাস চলল। বেলা এগারটা নাগাদ পৌঁছলাম কর্ণপ্রয়াগে। অলকানন্দা ও পিণ্ডারী গঙ্গার মিলনস্থান। 


অলকানন্দার প্রচণ্ড গর্জন ও ঝিঁ ঝিঁর একটানা কলতান শুনতে শুনতে কর্ণপ্রয়াগ অতিক্রম করে পৌঁছালাম নন্দ রাজার যঞ্জস্থল নন্দপ্রয়াগে। বদ্রীক্ষেত্রের শুরু এখান থেকে। এরপর এল চামোলী। তারপর পিপলকোঠী, তারপর একে একে গরুড়-গঙ্গা, পাতাল-গঙ্গা অতিক্রম করে বিকাল তিনটা নাগাদ পৌঁছলাম জোশীমঠে।


বাস থেকে নেমেই জোশীমঠের নৃসিংহ মন্দির দেখতে গেলাম। শীতের ৬ মাস যখন বদ্রীনাথের মন্দিরে বরফে ঢাকা থাকে তখন তাঁর পূজা হয় এই নৃসিংহমূর্তিতে। অক্ষয় তৃতীয়ার সময় বদ্রীনাথের মন্দির খোলে। জোশীমঠ থেকে বদ্রীর রাস্তা অত সহজ নয়। বদ্রীনাথ ১১০০০ ফুট। শেষের সাত মাইল চড়াই ঠেলে উঠতে সমতলের মানুষদের দু'দিন লাগে।


হিমালয়ের বিপুল বিশাল বৈচিত্র্যের আকর্ষণে আমার একা একা পথ চলা শুরু। রাস্তাঘাট চিনি না বলে চিন্তা হল। পথে এক পাহাড়ীর সঙ্গে পরিচয় হল। সে বলল, চিন্তার কোন কারণ নেই। এধারে চোর ডাকাত বলতে কিছু নেই। হাঁটা পথ একটাই। সে কিছুদূর পর্যন্ত আমার সঙ্গে এসে পথ দেখিয়ে দিল। 


জোশীমঠের অনেক নীচুতে, খাদের মত একটা জায়গায় দেখা যাচ্ছে নদী। সেই নদীর গা থেকে একটা সরু পথ উঠে পাশের পাহাড়টার মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেছে। পাহাড়ে আড়ালে কি আছে তা দেখার বা জানার উপায় নেই। নিঝুম, নিস্তব্ধ, জনমানবহীন সেই খাদের মধ্যে যে পথের শুরু হল ওই হল বদ্রীধামের পথ। আসল হিমালয়ের স্পর্শ এখান থেকেই শুরু। পাহাড়ী লোকটি ফিরে গেল। 


আমি নামতে লাগলাম, প্রায় একঘণ্টা উতরাই ভাঙ্গার পর নদীর সেই পাড় এল। কিন্তু পাড় বলতে যা বুঝায় তা নেই, আর নদীও একটা নয়। দুই নদীর সঙ্গম হয়েছে। অলকানন্দা ও বিষ্ণুগঙ্গা বা ধবল-গঙ্গার পূত মিলনস্থল বিষ্ণুপ্রয়াগ নাম গ্রহণ করেছে।


বিষ্ণুপ্রয়াগের উপর পুল পার হয়ে পাণ্ডুকেশ্বরের পথ নির্দেশ জানতে চাইলে একজন বলল --- আমার বাড়ী পাণ্ডুকেশ্বর, আমিও পাণ্ডুকেশ্বর যাব। পথে একজন সঙ্গী জুটে গেল। বুঝলাম --- জীবের অসুবিধা হলেই শিব ছুটে আসেন। জোশীমঠ থেকে পাণ্ডুকেশ্বরের দূরত্ব সওয়া আট মাইল। উচ্চতা প্রায় ৩৫০০ ফুট।


ছেলেটি বলল--- সরকারী লোকেরা পাথর ফাটাচ্ছে। মাথায় পাথর পড়ার ভয় আছে। আমাদের সাবধানে দেখেশুনে যেতে হবে। কারণ পায়ে চলার পথটির থেকে দু'তিনশো ফুট উচুঁ দিয়ে মোটর যাবার রাস্তা তৈরী হচ্ছে। রাস্তাটি বদ্রীনাথ পর্যন্ত্য যাবে। দু'বছরের মধ্যে কাজ শেষ হবে। যাত্রীরা হৃষিকেশ হতে বদ্রীনাথ পর্যন্ত সমস্ত পথটা মোটরে যেতে পারেন তার জন্য ও সৈন্য চলাচলের জন্য। শুনলাম বদ্রীনাথ থেকে মাইল পঞ্চাশ দূরেই বসে আছে চীনা সেনা।


ছেলেটি বলল --- মহাভারতে পাবেন, পঞ্চপাণ্ডবগণ অস্ত্র সংবরণ করার অনতিবিলম্বে পীত দস্যুগণ (চীনারা) হানা দেয় ও গোধন হরণ করে। এই চীনা হানাদারদের উৎপাতেই বহু শত বৎসর আগে বদ্রীনাথের পূজারী বদ্রীনাথজীর বিগ্রহ নারদ কুণ্ডের জলে ফেলে দেন। আচার্য্য শঙ্কর যোগবলে মূর্তির অধিষ্ঠান স্থলটি জানতে পারেন এবং মূর্তিটি উদ্ধার করেন।


সন্ধ্যার অন্ধকার নামার আগেই ছেলেটি একটি কাঠের দোতলা বাড়ীতে আমাকে নিয়ে এল। চারদিকে আরও অনেক বাড়ী ও ধর্মশালাগুলি হানাবাড়ীর মত পড়ে আছে। ছেলেটি আমাকে অপেক্ষা করতে বলে উধাও হয়ে গেল। এমন সময় চোখে পড়ল বাড়ীটির রোয়াকের উপর কম্বল গায়ে একজন বসে। কাছে যেতেই লোকটি আমাকে প্রশ্ন করল --- আপ কঁহা যাইয়েগা? 


বললাম --- বদ্রীনাথজী। আপ? সাধুজী কিছুক্ষণ নির্বাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন --- বাঙালী! বেশ। বদ্রীনারায়ণের দরজা যতদিন খোলা থাকে ততদিন ঐখানেই থাকি। বাকী দিন গুলি নিচে ঘুরে বেড়াই। কিছুক্ষণ পর ছেলেটি চাল, ডাল, আলু, তেল, নুন নিয়ে এসে নৈশভোজনের ব্যবস্থা করল। তিনজনের নৈশ ভোজন সমাধা হল। নানা আলোচনার পর শুয়ে পড়লাম।



To be continued......

No comments:

Post a Comment