Monday, July 28, 2014


"................ বেদ-বেদান্ত  অধ্যায়নকালে তিনি প্রায়ই বলতেন অদ্বৈতবেদান্তের নিগূঢ় রহস্য বুঝতে হলে বিদ্যারণ্য মুণীশ্বর প্রণীত পঞ্চদশী অপরিহার্য। বিদ্যারণ্য মুণীশ্বর সনাতন ব্রহ্ম সংবিদের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছেন --- এই সংবিদের উদয় নেই, অস্তও নেই, এটি স্বপ্রকাশ এবং স্বতঃপ্রমাণ।

পঞ্চদশী ধৃত ঐ সংবিদ যেমন নিয়ত পরিবর্তনশীল জগতে নিত্য  এবং শ্বাশত, তেমনি মদীয় পিতৃদেব প্রদত্ত পঞ্চদশ  উপদেশও শুধু আমার (লেখকের) জীবনে কেন, যে কোন মানুষের জীবনে শাশ্বত আলোক বর্তিকার মত; জীবনে যত পরিবর্তনই আসুক, তাঁর উপদেশের অন্তর্নিহিত সংবিদই যে কোন মানুষের জীবনের ধ্রুব পথটিকে উদ্ভাসিত করে তুলবে। উপদেশগুলি হল ---


1. সব সময় লেখাপড়া করবে। বই এর পর বই, লাইব্রেরীর পর লাইব্রেরী উজাড় করে পড়বে। হাতের কাছে পঞ্জিকা জুটলে তাই পড়বে। তাতেও অনেক শিক্ষণীয় বিষয় থাকে। প্রত্যেকের কিছু না কিছু নেশা থাকে। বই পড়া-ই তোমার নেশা হোক।


2. যা কিছু পড়বে, শুনবে এবং দেখবে তা বিচার পূর্বক গ্রহণ করো।


3. প্রীতির ঘাটে অপরাধ করো না। যে তোমাকে ভালবাসে, তার ত্রুটি বিচ্যুতি উপেক্ষা করতে শিক্ষা কর।


4.
যে তোমাকে দেয় জল, প্রতিদানে অন্ন দিও তারে,
মিষ্ট কথা বলে যদি কেহ, নমস্কার করো বারে বারে।
কড়ি যদি পাও কভু মোহরেতে দিও প্রতিদান,
প্রাণ যে বাঁচাল তব তার তরে দিও তব প্রাণ।
একগুণ পাও যদি তুমি দশগুণ দিও তারে ফিরে,
অপকার পাও যদি কভু, উপকারে রেখো তারে ঘিরে।।

5. সংস্কৃত শাস্ত্রের সেবায় জীবনপাত করবে। সংস্কৃত একাধারে ঞ্জান এবং আনন্দের খনি। "ধন্যা সংস্কৃতবাক্‌ সুধাপরতরা গীর্ব্বাণসংসেবিতা।"

'ধন্য সংস্কৃতভাষা! কি রস তোমার,
সুধাও তাহার কাছে অতি তুচ্ছ ছার।'

6.  বৈদিক  ঋষিদের কেউ অমর্যাদা করলে তা পিতৃ-অপমানের সমতুল্য মনে করবে এবং তার প্রতিবিধানে তৎক্ষণাৎ তৎপর হবে। স্বদেশী, বিদেশী যিনি যত বড় পণ্ডিতই হোক না কেন, তাঁরা যদি কেউ ঋষি বাক্যের বিকৃত অর্থ করেন, তা নির্ভয়ে খণ্ডন করা কর্তব্য। তোপের মুখে উড়িয়ে দিলেও সত্য প্রকাশে কখনও কুণ্ঠিত হবে না।


7.  প্রিয় বা অপ্রিয় কিছু উপস্থিত হলে তাকে আদরে গ্রহণ করতে হয়। তা চলে যাবার উপক্রম করলে নিবারণ করতে নেই। সুখ, দুঃখ অভাব অনটনকে শান্ত চিত্তে গ্রহণ করতে অভ্যাস কর। দারিদ্র্যের কষাঘাতে জীবনের ভিত্‌ পাকাপোক্ত হয়। মহাত্মা যীশুখ্রীষ্টের জন্ম আস্তাবলে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্ম কংসের বন্দীশালায়। মা জানকী, কুন্তীদেবী এবং পঞ্চ পাণ্ডবকে অনেক লাঞ্ছনা ভোগ এবং অনেক কান্না কাঁদতে হয়েছে। এইসবের তাৎপর্য কখনও ভেবে দেখেছ কি? কেবল তোতা পাখীর মত শাস্ত্র মুখস্থ করলেই চলবে না। প্রত্যেকটি ঘটনাও চরিত্র অঙ্কনের মূলে ঋষিদের উদ্দেশ্য কি, তা হৃদয়ঙ্গম করতে চেষ্টা কর। এটাই সর্বোত্তম তপস্যা কেননা জীবন্মুক্তি লক্ষণ-স্থিতি রূপী তপস্যা।


8.  ঈশ্বর আছেন --- এটাই ধ্রুব সত্য।


9.  ভয়, ভাবনা, ভূত, ভোগ ও ভগ --- এই পাঁচটি 'ভ'- কারান্ত শব্দের উপদ্রব থাকলে ভগবানকে লাভ করা যায় না। যেমন --- অন্ধকার থাকলে  আলোর অভাব  এবং  আলো থাকলে অন্ধকারের অভাব সূচিত করে, তেমনি উক্ত পাঁচটি 'ভ'- কারান্ত শব্দের সঙ্গে  ষষ্ঠ 'ভ'- কারান্ত শব্দ ভগবৎ -তত্ত্বের নিত্য বিরোধ বর্তমান।


10.  মন  চঞ্চল কারণ সে অখণ্ড আনন্দের প্রত্যাশী। সে অখণ্ড আনন্দের স্বাদ জানে, অথচ পাচ্ছে না। ফলে, বিষয় হতে বিষয়ান্তরে ছোটাছুটি করে। চঞ্চলতা মনের স্বভাব নয়, স্থৈর্যই তার স্বভাব। চাঞ্চল্যটা তার সাময়িক ব্যারাম মাত্র।


11.  একটা  দেশলাই কাঠি যদি সারা বৎসর ধরে অহরহ উল্টো দিকে ঘর্ষণ করা  হয়, তাতে যেমন আলো জ্বলে না, ঠিক তেমনি প্রক্রিয়ামত ধ্যান না করলে কিছুতে ফল পাবে না। প্রক্রিয়ামত এবং অনুরাগ সহকারে ধ্যান করে যাও, আনন্দের সন্ধান অবশ্যই মিলবে।


12.  ভগবানের নিকট কখনও কোন মানৎ --- মানসিক করবে না। ভগবান কারো বাজার- সরকার নন যে, প্রাতঃকালে শয্যা ত্যাগের পর হতে রাত্রিতে পুনরায় শয্যা গ্রহণ পর্যন্ত কেবলই 'এটা দাও ওটা আন' বলে ফর্দের পর ফর্দ পেশ করব আর তিনি তটস্থ হয়ে তদ্দণ্ডে তা করে দেবেন।


13.  অসন্তুষ্টাঃ দ্বিজাঃ নষ্টাঃ। অতএব সর্বাবস্থায় চিত্তের সন্তোষ বজায় রেখে চলবে --- সন্তোষং পরমং ধনম্‌।


14.  জীবনের আদর্শ কি তা জানতে হলে নিজের গোত্রকে ভাল করে জানতে হবে। প্রত্যেকের গোত্রের মধ্যেই নির্দেশ আছে। আমাদের বাৎস্য গোত্র। বাৎস্য গোত্রের প্রবর অর্থাৎ প্রকৃষ্টরূপে বরণীয় ঋষি যথাক্রমে --- ঔর্ব্ব, চ্যবন, ভার্গব, জামদগ্ন্য এবং আপ্লুবান্‌।


a) ঋষি ঔর্ব্ব  ছিলেন  সসাগরা পৃথিবীর অধীশ্বর, সগরের গুরু। তিনিই পৃথিবীতে অগ্নি তত্ত্বের প্রথম উদ্ভাবক; তিনিই বলেছিলেন, 'জীবন তো কেবল জৈব কর্ম নহে --- ইহা বিশ্বদেবের পূজা। সমগ্র মানব জীবনকে বৈশ্বানরের  অগ্নিচয়ন-যঞ্জ বলে মনে করবে।' তাঁর জীবন এই শিক্ষা দিচ্ছে যে --- তত্ত্বঞ্জানের সঙ্গে বিঞ্জান চেতনাও প্রয়োজন।

b)  চ্যবন মুনি অতিরিক্ত ভোগের ফলে অকালে জরাগ্রস্ত হন, পরে সংযম ও সাধনা দ্বারা জরা ব্যাধি জয় করেন। মাত্রাতিরিক্ত ভোগের কুফল এবং তা জয়ের কৌশল এই মুনির জীবন হতে শিক্ষনীয়।

c)  ভার্গব অর্থাৎ শুক্রাচার্য  ছিলেন মৃত-সঞ্জিবনী বিদ্যার কুশলী  আচার্য --- মৃত্যুর উপর জীবনের জয়গানের উদ্‌গাতা।

d)  জামদগ্ন্য (পরশুরাম) ছিলেন তেজ, বীর্য, তপস্যার জ্বলন্ত বিগ্রহ।

e)  আপ্লুবান্‌  ছিলেন দেশ প্রেমিক ঋষি, তিনি মাতৃভূমিকে জড় মাটি, কাঠ পাথরের ভূখণ্ড বলে ভাবতেন না --- তাঁহার ভাবদৃষ্টিতে মাতৃভূমি ছিল মৃন্ময়ী মা।

আমাদের গোত্র-পুরুষ এই সমস্ত ঋষির জীবনাদর্শ মনন করলেই পথের সন্ধান পাবে।

15.  যা কিছু দুর্গম, দুস্তর, দুর্লভ এবং দুঃসাধ্য --- "তৎ সর্বং তপসা সাধ্যং তপো হি দুরতিক্রমম্‌।" তপস্যা দ্বারাই সব কিছু লাভ করা যায়। পরশুরাম  রামচন্দ্রকে বলেছিলেন, তুমি শরনিক্ষেপ করে আমার স্বর্গপথ রুদ্ধ করতে পার, তুমি কেবল আমার তপস্যার পথ নষ্ট কোরো না। কারণ, তপস্যার পথ  খোলা থাকলে আমি তপস্যা দ্বারা সব কিছুই পুনরায় জয় করে নেব। সারকথা --- তপস্যা।  

তপস্যাই ব্রাহ্মণের একমাত্র ধন। মনে রাখবে --- ব্রহ্মবিদ্যা অনায়াস লভ্য নয়, তার জন্য চাই অবিশ্রান্ত যত্ন, চাই অবিরাম তপস্যা।।" 

https://www.facebook.com/pages/tapobhuminarmada/454528151310191



No comments:

Post a Comment