Friday, May 9, 2014

মহর্ষি গালব:------


মাত্র ৯ বছর বয়সে গালব এসেছিলেন সমিৎপানি হয়ে ঋষি বিশ্বামিত্রের আশ্রমে। বালক সমাবর্তনের শেষে গৃহে প্রত্যাবর্তন করেন নি। কারণ গুরুগৃহে থাকাকালে তাঁর পিতামাতা গত হন। সংসারের সকল বন্ধন ছিন্ন হওয়ায় গুরুগৃহে কাল কেটেছে গালবের। ঋষিও প্রাণ দিয়ে ভালবাসতেন এই শিষ্যকে। সর্ববিদ্যায় পারংগম, সেবা-তৎপর গালবের বিশেষ গুণ। বেদের সমগ্র শাখায় তাঁর অনায়াসে বিচরণ ক্ষমতা। অন্তেবাসী মাত্রেই জানেন গালব অসাধারণ বিচারমল্ল।

কিন্তু তাঁর পাণ্ডিত্য এবং অতুলনীয় বিচার ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে ঋষি বিশ্বামিত্রের কাছে  অভিযোগ আসে --- বিচারকালে গালব বয়োবৃদ্ধ এবং ঞ্জানবৃদ্ধদের সম্মান রাখেন না।


প্রিয় শিষ্যের নামে অভিযোগ শুনে জ্বলন্ত পাবকের মত মৃগচর্মে সমাসীন গায়েত্রীর মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি গুরু বিশ্বামিত্রের  মুখাবয়বে দেখা দিল ভ্রূকুটিরেখা। সমগ্র ব্রহ্মবর্তে তাঁর আসন বিশেষ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত। অসংখ্য  তাপস, ঋষি বালক, ঋত্বিক, অধ্বর্যু তাঁকে ঘিরে রয়েছেন। পবিত্র হোম ধূমে চারিদিক সুরভিত। এহেন শান্ত ও স্নিগ্ধ পরিবেশে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে গুরু বলছেন ------  গালব কবে তুমি তর্ক ও জল্প ছেড়ে মৌন অবলম্বন করবে? কবে তুমি মুনি হবে? বৃত্তেন হি ভবত্যার্থো ন ঞ্জানম ন বিদ্যয়া। গালব মনে রেখো পরিশীলিত আর শ্রদ্ধান্বিত জীবনচর্চা দ্বারাই লোকে আর্য হয়। গালবের সতীর্থদের কাছে এ দৃশ্য কল্পনাতীত। বিনীত কণ্ঠে অথচ সপ্রতিভ ভাবে গালব নিবেদন করলেন --- অধুনৈব, অধুনৈব প্রভো! আপনি আশীর্বাদ করলে এখনই পারি।

সেই থেকে গালব হলেন মৌনব্রতী। কখন কুরু, কখন পাঞ্চাল, কখনও বা পুষ্করের গহন অরণ্যে অবধূতের ন্যায় বিচরণ করতে লাগলেন গালব। এইভাবে প্রব্রজ্যা করতে করতে একদিন গালব রাজা অশ্বপাণির অন্তঃপুরে দৈবাৎ প্রবেশ করেন। কোন দিকে দৃক্‌পাত নেই, আত্মানন্দে তিনি বিভোর। প্রতিহারীরা সঙ্গে সঙ্গে এই নির্লজ্জ অবধূতকে বন্দী করে রাজার সম্মুখে উপস্থিত করল।


ক্রুদ্ধ রাজার আদেশে তখনই তাঁর একখানি হাত কেটে ফেলা হল। এতে গালব কোন ভ্রূক্ষেপ করলেন না। মাটিতে ছিন্ন হস্ত পতিত হল। রক্তের ধারা ঝরে পড়ছে। অথচ আহত ব্যক্তি উদাসীন। মুখে কোন ব্যথা বেদনার বিকার নেই। কোন আর্তনাদ নেই। এই অভাবনীয় দৃশ্য দেখে সপারিষদ রাজা স্তম্ভিত। তিনি বুঝলেন যে এই ব্যক্তি নিশ্চয়ই কোন সিদ্ধ তাপস। তাঁরা সবাই পদতলে পড়ে বারংবার ক্ষমা ভিক্ষা করতে লাগলেন। প্রসন্ন হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল অবধূতের মুখ। তিনি অস্ফুট কণ্ঠে বললেন --- অপিধভৎস্ব। ভীত সন্ত্রস্ত রাজা শশব্যস্তে হাতখানি তুলে নিয়ে যথাস্থানে সংলগ্ন করলেন --- ক্ষত চিহ্ন নিমেষে গেল মিলিয়ে --- হাতটি যথাপূর্বং তথাস্থিতং। গালব তাঁদেরকে আশীর্বাদ করে নিষ্ক্রান্ত হলেন সেখান থেকে।


এইভাবে ঘুরতে ঘুরতে গালব একদিন গভীর রাত্রিতে এক তপোবনের ব্রীহি যবাদির গোলার কাছে গিয়ে সমাধিস্থ হয়ে পড়েন। আশ্রমের ব্রহ্মচারীরা ভাবলেন এই ব্যক্তি নিশ্চয়ই তস্কর। তারা লগুড় হস্তে গালবকে প্রহার করতে উদ্যত হতেই তিনিও তাদেরকে নিবারণ করার জন্য হাত তুললেন। আশ্চর্যের বিষয় ধ্যানস্থ যোগী এবং আশ্রম রক্ষকদেরকে সারারাত্রি ঐ অবস্থাতে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। প্রত্যুষে গালব চলে যাবার পর ঐ নিশ্চল অবস্থা থেকে আশ্রম রক্ষকরা মুক্তি পায়।


জনপদে জনপদে ছড়িয়ে পড়ছে গালবের অত্যাশ্চর্য কাহিনীর কথা। আপামর জনসাধারণ গালবকে দেখলেই শ্রদ্ধায় বিগলিত হয়ে পড়ছে। গালবের কিন্তু কোন দিকে লক্ষ্য নেই। অর্ন্তলক্ষ্য বহিঃদৃষ্টি, সর্বত্র সমদর্শন সদানন্দময় গালব এগিয়ে চলেছেন গুরু দর্শনের তীব্র আকাঙ্খা বুকে নিয়ে। পথে আবার এক বিভ্রাট দেখা দিল।


জঙ্গল থেকে কাঠ কেটে বয়ে নিয়ে চলেছে কাঠুরিয়াদের দল। তারা গালবকে চেনে না। দলের সর্দার শক্ত সামর্থ গালবকে জোর করে কাষ্ঠভার বহন করতে বাধ্য করল। মহাপুরুষের কিছুতেই আপত্তি নেই --- কোন ক্লেশেই তিনি কাতর নন। কাঠের বিপুল বোঝা মাথায় নিয়ে তিনি হাঁটতে লাগলেন কাঠুরিয়াদের সঙ্গে। দলনেতা মহাখুশী। দুর্বিপাক দেখা দিল একটু পরেই। গন্তব্যস্থলে পৌঁছে কাঠুরিয়াদের স্তূপীকৃত কাঠের রাশির উপর তিনি বোঝাটি ফেলে দেবার পরেই দেখা গেল আশ্চর্য অগ্নিকাণ্ড। সমস্ত কাঠই ভস্মীভূত হয়ে গেল।


ঘটনাটি ঘটল গুরুর আশ্রম থেকে নাতিদূরস্থ অরণ্যের এক উপান্তে। কাজেই সেসব কথা ঋষি বিশ্বামিত্রের কর্ণগোচর হতে বিলম্ব হল না। গালব আশ্রমে পৌঁছে গুরুর চরণে ভূলুণ্ঠিত হলেন। কিন্তু গুরু প্রণাম গ্রহণ করলেন না। ......



To be continued ...........

No comments:

Post a Comment