Thursday, September 23, 2010

মা নর্মদার কৃপা ---


..................রাত্রি বাড়ছে, গভীর রাত্রে অরণ্যের ভাষা মুখর হয়ে উঠে। মাঝে মাঝে নানা শব্দ কানে ভেসে আসতে থাকল। রাত্রিচর কোন পাখীর ডাক শুনতে পেলাম। মিষ্টি সুর! দূর থেকে একটা কুলু-কুলু ধ্বনি কানে ভেসে আসছে-এ কি কোন ঝরণা? না-নর্মদার স্রোতধ্বনি?উৎকর্ণ হয়ে শুনতে লাগলাম, মনে হচ্ছে যেন বাঁ দিক থেকে ভেসে আসছে। আশ্চর্য সারাদিন দেহে মনে এত পরিশ্রম হয়েছে কিন্তু ঘুম আসছে না কেন? 

চোখ খোলা রেখেই আমি ধ্যানে ডুববার চেষ্টা করছি। এই অবস্থাতেই হয়ত আমি ক্ষণিকের জন্য তন্ময় বা অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম, আমার অঞ্জাতসারেই চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল --- হঠাৎ চোখে আলোর আভাষ জাগল; কেউ যেন বলছে-বাচ্চা রোতে হ্যায় কেঁও?

দেখো বেটি, এ লেড়কা পরিক্রমাবাসী হো। তাঁদের কণ্ঠস্বরে ধড়ফড়িয়ে জেগে উঠলাম। দেখলাম-প্রায় পঞ্চাশ বৎসর প্রৌঢ় এক হাতে মশাল, কাধেঁ বিশাল ধনুক, আর এক হাতে বল্লম নিয়ে কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন। দ্রঢ়িষ্ট, বলিষ্ট পেশী-বহুল কালো মজবুত শরীর, পরিধানে কৌপীন, পাশেই তাঁর অষ্টাদশী কন্যা --- রুক্ষ্ম ধূসর আলুলায়িত চুল, বুকে হ্রস্ব ব্যাঘ্রচর্মের চোলি; নাভির নিচে খয়েরী রঙের খাটো ঘাগরা, হাতের শক্ত কব্জিতে মোটা কঙ্কণ, পায়ে আরো মোটা জুড়িমল; তার পিঠে বাধাঁ তূণে কুড়ি পঁচিশটা লম্বা লম্বা তীর, বাম হাতে বল্লম আর ডান হাতে প্রজ্বলিত মশাল

পিতাপুত্রীর মধ্যে যে ভাষায় কথা হল তা আমার হৃদয়ঙ্গম হল না। প্রৌঢ় মানুষটি আমার হাত ধরে উঠিয়ে তাঁদেরকে অনুসরণ করার ইঙ্গিত করলেন। মিনিট দশেক হাঁটার পরেই জঙ্গলের মধ্যে একটা বাঁক ঘুরতেই দূরে অনেকগুলো মশাল জ্বলছে দেখতে পেলাম। 


আশা ও আনন্দে আমার মন ভরে উঠল। পিতাপুত্রী সেই আলোর দিকে অঙ্গুলি সঙ্কেত করে এগিয়ে যেতে ইঙ্গিত করলেন। তাঁরা অন্য একটা দিকে বাঁক নিলেন। আমি দু’তিন মিনিট তাঁদের যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তারা দ্রুত হাঁটছেন। ঢালু পথে, তাঁদের হাতের মশাল দপ্‌দপ্‌ করে উঠা নামা করছে। আমি মনে মনে বলছি ভগবান নর্মদেশ্বর, তোমার ‘বিপদ বারণ’ নাম সার্থক। মশালের আলো অদৃশ্য হল কিন্তু সেই পথ থেকে ভেসে এল উদাত্ত ধ্বনি --- হর নর্মদে হর। এইত পিতাপুত্রীর  কণ্ঠস্বর। তাঁরা বোধহয় বিদায় জানিয়ে দূর থেকে সাহস দিচ্ছেন

আমি মশালের আলো লক্ষ্য করে এগিয়ে যেতে লাগলাম। কিছুক্ষণ হাঁটার পরেই জঙ্গলের মধ্যেই নর্মদার তীর ঘেঁসে একটা ফাঁকা জায়গায় দেখলাম বহুসাধুর ছাউনি। বিবস্ত্র নাগা সাধু এবং কৌপীন বা অল্পমাত্র বস্ত্রে লজ্জা নিবারণ করে কিছু ভীল জাতীয় লোক শুয়ে আছে। চারটে তাঁবু খাটানো হয়েছে তাঁবুর বাইরে শুয়ে আছেন অন্ততঃ একশ জন মানুষ। ছাউনির চারদিকে ঘিরে বড় বড় মশাল জ্বলছে। ধুনি জ্বেলে কয়েকজন নাগা বসে আছেন; হাতে তীর ধনুক নিয়ে প্রায় জনাদশেক ভীল চারদিক ঘুরে ঘুরে পাহারা দিচ্ছে। তাদের সঙ্গে লম্বা লম্বা ত্রিশূল হাতে কয়েকজন দীর্ঘদেহী নাগাও আছে। 


আমাকে দেখেই একজন ভীল এবং একজন ত্রিশূলধারী আমার কাছে এগিয়ে এসে আমার পরিচয় জানতে চাইলেন। আমাকে পরিক্রমাবাসী জেনে বললেন --- রাত বারা বাজ গিয়ে, আভি লেট জাইয়ে, সবেরে গুরুমহারাজ কা দর্শন মিলেগা। জান পহচান ভি আচ্ছি তরে হোঙ্গে। 

লাখড়াকোটকী মন্দর বহুৎ দূর মেঁ আপ ছোড়কে আয়া। ইহ হ্যায় ভেটাখেড়াকী জঙ্গল, সবেরে ইধরকা শিউজীকো দর্শন করেগা। আপ রাস্তা ভুল কিয়া হোঙ্গা। এখানে কাছাকাছি কোন ভীল বা কোরকাদের মহল্লা আছে কিনা জানতে চাইতে বললেন - হম দো দফে পরিক্রমা করচুকা, হম আচ্ছিতরেসে জানতা হুঁ সাত আট মিলকা অন্দর কোই মহল্লা নেহি হ্যায়। চারো তরফ জঙ্গল হৈ। 

জলের ড্রামে জল ভর্তি আছে। আমি হাত পা ধুয়ে সারি সারি নিদ্রিত নাগাদের শয্যার একপাশে শুয়ে পড়লাম গাঁঠরী মাথায় দিয়ে। সমস্ত মাঠটায় বড় সতরঞ্চি পাতা আছে। ঘুম আসতে দেরী হল না। ঘুমের মধ্যেই শুনতে পেলাম ঠিক যেন সেই পিতাপুত্রীর কণ্ঠস্বর --- "হর নর্মদে হর"। 

ধড়ফড় করে উঠে বসলাম। পাশের এক নাগা বললেন -- ক্যা হুয়া, লেট যাও, আভি সুবা হোনেমে দের হ্যায়। আবার শুয়ে পড়লাম। আবার ঘুমের মধ্যে শুনতে পেলাম, সেই অপার্থিব ধ্বনি, পিতাপুত্রীর কণ্ঠস্বর --- "হর নর্মদে হর"


https://www.facebook.com/pages/tapobhuminarmada/454528151310191

2 comments:

  1. আজ ‘তপোভূমি নর্মদা’র প্রতি প্রণাম জানাই।এই বই আমার পথপ্রদর্শক।দয়ালের কাছে এই প্রার্থনা যেন এই গ্রন্থের আলোতে জীবন ধন্য করতে পারি।

    "ওঁ শম্ভো শিব শিবাকান্ত শান্ত শ্রীকন্ঠ শূলভৃত।
    শশীভূষণ সর্বেশ শঙ্করেশ্বর ধুর্জ্জটে।।
    পিনাকপানে গিরীশ শিতিকন্ঠ সদাশিব।
    মহাদেব নমস্তুভ্যম দেবদেব নমোহস্তুতে।।
    স্তুতি কর্ত্তুং ন জানামি, স্তুতিপ্রিয় মহেশ্বর।
    তব পদাম্বুজং দ্বদে নির্দ্বন্দ্বা ভক্তিরস্তুমে।।"

    ReplyDelete
  2. satti ek adbhut book..aaj ker ei din-e biswas korte mon chay na...abar biswas korte pere valo lage

    anamitra

    ReplyDelete