Saturday, September 25, 2010

ওঁকারেশ্বর ---


………….. ওঁকারেশ্বরের নাটমন্দিরের একপাশে গাঁটরী এবং লাঠিটি ফেলে রেখে কমণ্ডলু হাতে এগিয়ে যাচ্ছি গর্ভমন্দিরের দিকে, এমন সময় পেছনে থেকে আলখাল্লায় টান পড়ল। চোখ ফেরাতেই দেখতে পেলাম একজন লোলচর্মবৃদ্ধ সাধু আমার (লেখকের) আলখাল্লাকে ধরে আছেন। আমি থমকে দাঁড়াতেই রামদাসজী সে সাধুকে উদ্দেশ্য করে বললেন --- ক্যা মাঁঙতে হো জী? বৃদ্ধ সাধু উত্তর দিলেন --- মুঝে একদফে রেবাখণ্ডসে ওঁকারেশ্বরজীকা মহিমা শুনা দিজিয়ে।

রামদাসজী --- আভী ইনকো ছোড় দো। পূজা করকে আপকো পাঠ শোনায়েগা।


বৃদ্ধ সাধু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন ---- ঔর ভি দো চার আদমী এ্যাসাই বলকে গয়া। লেকিন্‌ গয়া ত গয়া। পূজাকা বাদ কোঈ আদমী লোটা নেহি। আঁখ হামারা খারাপ হো গয়া। কুছ নেহি দেখাই দেতা।


আমি রামদাসজী বললাম --- কে কখন কোন মূর্তিতে দেখা দেন তার কোন স্থিরতা নেই। ভক্তের কথা না রাখলে, ভক্তকে তুষ্ট না করে পূজা করতে গেলে হয়ত ওঁকারেশ্বর আমার পূজাই গ্রহণ করবেন না। এই বলে আমি মেঝেতে কমণ্ডলু রেখে বৃদ্ধ সাধুর কাছে বসে পড়লাম।


ময়লা গেরুয়া কাপড়ে জড়ানো দেবনাগরী অক্ষরে ছাপানো ‘স্কন্দপুরাণম্‌’ নামক বিরাট পুঁথি খুলে তিনি কম্পিত হস্তে আমার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলতে থাকলেন --- বড়ি কিরপা, বড়ি কিরপা। ভগবান ওঁকারেশ্বর আপকা ভালা করেঁ। আমি পুঁথি খুলে মহামুনি মার্কণ্ডেয় কথিত ওঁকারেশ্বর মহিমা পড়তে লাগলাম ----

স্বয়ং বিশ্বেশ্বর মহাদেব পার্বতীদেবীকে বলছেন --- হে দেবি, যিনি জগতে ওঁকারেশ্বর নামে প্রসিদ্ধ, আমি সেই দ্বিপঞ্চাশত্তম লিঙ্গের মাহাত্ম্য কীর্তন করছি, তুমি শুন। আমি পূর্বে প্রাকৃত কল্পে মুখ হতে এক কপিলাকৃতি পুরুষ সৃষ্টি করি। তাঁকে বলি --- তুমি নিজের আত্মাকে বিভক্ত কর। 'কিভাবে আত্মাকে বিভক্ত করি’--- সেই চিন্তায় যখন ধ্যানবিষ্ট, সেই সময় আমার প্রসাদে তাঁর দেহ ভেদ করে ত্রিবর্ণস্বররূপী চর্তুবর্গফলপ্রদ ঋক্‌-যজুঃ সাম নামক ব্রহ্মা-বিষ্ণু-শিবাত্মক ওঁকার স্বীয় প্রভাবে অখিল লোক পরিব্যাপ্ত করে আবির্ভূত হলেন। ঐ সময় আমার উদার বাণী দ্বারা সমলঙ্কৃত হয়ে ঐ ওঁকারের হৃদয় হতে বষট্‌কার ধ্বনি উত্থিত হল। আর ছন্দঃশ্রেষ্ঠা চতুর্বিংশতি অক্ষর বিশিষ্ঠা পঞ্চশীর্ষা মধুরভাষিণী দেবী গায়ত্রীও তাঁর পাশে প্রকট হলেন। এই গায়ত্রী দেবীই সাবিত্রী নামে জগতে প্রসিদ্ধ। 

হে পার্বতি! আমি গায়ত্রী অনুস্যুত ঐ ওঁকারকে বললাম --- তোমরা উভয় বিচিত্র সৃষ্টির প্রবর্তন কর। আমার কথা শুনে হিরন্ময় ত্রিশিখ ওঁকার স্বীয় জ্যোতি থেকে বিবিধ সৃষ্টি প্রকাশ করতে লাগলেন।

সর্বপ্রথম বেদ প্রকট হলেন। পরে ক্রমে ক্রমে ৩৩জন বৈদিক দেবতা, কয়েকজন ঋষি ও মানুষ সৃষ্টি হল ঐ ওঁকার থেকে। 

হে পর্বতাত্মজে! এই জগৎ প্রভু ভগবান ওঁকার কল্পান্তকালে দেবতা অসুর সহ সমগ্র জীবকুল সংহার করে নিজের মধ্যে লীন করে নেন।পুনরায় সমগ্র ভূতজগৎ সৃষ্টি করে থাকেন। 

ওঁকারদেব অব্যক্ত, শাশ্বত এবং সর্বজগতের স্রষ্টা। 

****ওঁকারই কর্তা, বিকর্তা, সংহর্তা ও মহান। ওঁকার হতেই বেদ, যঞ্জ, ঞ্জান ও তপস্যার উৎপত্তি ঘটেছে। ওঁকারই ভুবনাধিপতি স্বয়ম্ভু ব্রহ্মা, বায়ু, বিশ্বদেব, সাধ্য, রুদ্র, আদিত্য, অশ্বিনীকুমার, প্রজাপতি, সপ্তর্ষি, বসু, যক্ষ, রুক্ষ, পিশাচ, দৈত্য, ব্রাহ্মাণ, ক্ষত্রিয়, শূদ্র, ম্লেচ্ছাদি, চতুষ্পদ ও তির্যকযোনি; সর্বভূতে তিনি, ভূতনাথ তিনি। 

সমস্ত সৃষ্টিকার্য সমাপ্ত হলে ওঁকার আমার কাছে তাঁর স্থিতিযোগ্য পবিত্র স্থান নির্দিষ্ট করে দিতে বললে, আমি শূলেশ্বর দেবের পূর্বভাগে (অর্থাৎ শূলপাণি ঝাড়ির শূলপাণির পূর্বদিকে) মহাকাল বনকে (অর্থাৎ ওঁকারেশ্বর ঝাড়িস্থিত এই স্থানটি) তাঁর আবাস্থল হিসাবে নির্দিষ্ট করে দিই। 

এই মহাকাল বনে ত্রিকল্পকালে ব্যেপে যে লিঙ্গ বিরাজমান আছেন ঐ লিঙ্গ তোমার নামে ওঁকারেশ্বর নামে প্রসিদ্ধি লাভ করবেন। 

আমার এই কথা শুনে ওঁকার আনন্দিত হয়ে ঐখানে ঐ লিঙ্গকে দর্শন করে তাতেই লয়প্রাপ্ত হন। তদ্‌বধি ব্রাহ্মণ গণ যাগ যোগ তপস্যা এবং যে কোন পুণ্য কার্যে ওঁকারকেই প্রথমে স্থান দিয়ে আসছেন। সহস্র যুগাদ্যায়, শত ব্যাতিপাত যোগ এবং সহস্র অয়নে তপস্যায় নিমগ্ন থাকলে কিংবা চতুর্বেদ অধ্যয়ন করলে যে পুণ্য হয়, ওঁকারেশ্বর দর্শনে সেই পুণ্যই লাভ হয়। 

দু’চোখ দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। আমি কমণ্ডলু হাতে নিয়ে উঠে পড়লাম। চলেছি গর্ভমন্দিরের দিকে ওঁকারেশ্বরের পূজা করতে। পুঁথি পাঠ করে বৃদ্ধ সাধুর দিকে তাকাতেই দেখলাম, লোলচর্ম বৃদ্ধ মেরুদণ্ড খাড়া রেখে “সমকায়শিরোগ্রীব” হয়ে গভীর ধ্যানে মগ্ন আছেন। তাঁর ওঁকারেশ্বরের যে মহিমার কথা পড়ে এলাম, তাতে ভয়ের সঞ্চার হয়েছে। 

ত্রিকল্পকাল ব্যেপে যে মহাজ্যোতির্লিঙ্গ এখানে স্বমহিমায় প্রকট আছেন তাঁকে স্বহস্তে পূজা করতে যাচ্ছি, মনের দৈন্য ধরা পড়ছে।সাধন-ভজনের অভাব, তপোবীর্যের অভাব, ভক্তির অভাব --- সব কিছু মনে করিয়ে দিতে লাগল যে আমি অযোগ্য, অযোগ্য! অ উ ম---ব্রহ্ম, বিষ্ণু, মহেশ্বরের সমন্বয় মূর্তি ওঁকার। তাঁর পূজা করার মত উপকরণ আমার নেই। যিনি একাধারে প্রণব ও পরপ্রণবতত্ত্ব। তাঁর সেই অতলান্ত নিগূঢ় তত্ত্ব বা রহস্য আমি ত স্বাধ্যায় করিনি!

ওঁকারের মাহাত্ম্য শুনতে শুনতে বৃদ্ধ সাধুর যেমন ধ্যানলোকে, চৈতন্যভূমিতে উত্তরণ ঘটে গেল; তেমন সাধনা বা সাধ্য আমার কোথায়? দেবোভূত্বা দেবং যজেৎ, দেবং ভজেৎ, দেবং রসেৎ ---ঋষিদের এই চেৎবাণী আমার মনে পড়ে গেল। মনে হচ্ছে আমার গোত্রপুরুষ, সেই প্রকৃষ্ট রূপে বরণীয় ঔর্ব, চ্যবন, জামদগ্ন্য, শুক্রাচার্য প্রভৃতি ঋষিরা আমার দিকে ভ্রূকুটি করে বলছেন --- এই মহাপূজায় তুই অনধিকার!


আমার শরীর থরথর করে কাঁপতে লাগল। হাতের কমণ্ডলুটাও কাঁপছে, এই বুঝি হাত থেকে পড়ে যায়। আমি থমকে দাঁড়িয়ে জলপূর্ণ কমণ্ডলু জাপটে ধরলাম। সহসা চোখের সামনে ভেসে উঠল --- বাবার তেজোদীপ্ত মুখখানি।


তিনি বলছেন --- তুই অনধিকারী কিসে? আমার দীক্ষাবীর্য এবং মহাদেবের সপ্তাক্ষর মহাবীজই ত তোকে মন্ত্রমূর্তি মহেশ্বরের পূজাবেদী মূলে টেনে এনেছে। নিজেকে অযোগ্য এবং অনধিকারী ভাবছিস্‌, লজ্জা করে না? ওঁকারেশ্বরের মহিমা যতই থাক, তাঁর সর্বশ্রেষ্ট মহিমা ---তিনি ভক্তবৎসল আশুতোষ ! তাঁকে পুণ্যপাবন কেউ বলে না, বলে পতিতপাবন। তাঁকে ধনী-বন্ধু আখ্যা কেউ দেয়নি, তাঁকে সবাই ডাকে দীন বন্ধু, দীন দয়াল বলে! এইসব কথা মনে জাগা মাত্রই আমি গর্ভগৃহের চৌকাঠ দ্রুত অতিক্রম করে ওঁকারেশ্বরের সামনে গিয়ে লুটিয়ে পড়লাম।


প্রণাম করে উঠে দু’চোখে ভরে দেখতে লাগলাম, অমল-ধবল ওঁকারেশ্বরের মহালিঙ্গকে। লিঙ্গমূলে নর্মদার সঙ্গে যোগ আছে, তাই নিত্য জলপূর্ণ চতুষ্কোণ ক্ষেত্রের মত একটি কুণ্ডের মধ্যস্থলে জেগে আছেন ওঁকারেশ্বর। ডান দিকে জ্বলছে ঘি এর জাগ-প্রদীপ যার শিখা কখনও নিভে না। পিছনে রয়েছে শ্বেতপাথর দিয়ে তৈরি মা পার্বতীর এক খানি বিগ্রহ। অন্যান্য শিবলিঙ্গের মত ওঁকারেশ্বরের কোন যোনিপীঠ নেই। প্রকৃত জ্যোতির্লিঙ্গে কোন যোনিপীঠ থাকে না।



https://www.facebook.com/pages/tapobhuminarmada/454528151310191

1 comment:

  1. Such places still exist on earth, and always will. Its for us to take cognizance and KNOW.

    ReplyDelete